ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মর্যাদাহানির অভিযোগ;###;দ্রুত সংশোধন না করলে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলো অস্থির হবে

বেতন স্কেল নিয়ে পাবলিক ভার্সিটি শিক্ষকদের ক্ষোভ বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ৯ জুলাই ২০১৫

বেতন স্কেল নিয়ে পাবলিক ভার্সিটি শিক্ষকদের ক্ষোভ বাড়ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রস্তাবিত অষ্টম বেতন কাঠামোকে কেন্দ্র করে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক অস্থিরতার আশঙ্কা করেছেন উপাচার্যরা। বুধবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে সাক্ষাত করে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদাহানির অভিযোগ এনেছেন তাঁরা। উপাচার্যরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, দ্রুত প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো সংশোধন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মর্যাদা না বাড়ালে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলো অস্থির হয়ে পড়বে। অস্থিরতা শুরু হলে আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে জানিয়ে তাঁরা বলেছেন, এক শ্রেণীর আমলা ও সরকারের ভেতরে থাকা বিশেষ কোন গোষ্ঠী চায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অশান্ত হয়ে উঠুক। উপাচার্যরা শিক্ষকদের দাবি পূরণে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। মন্ত্রী জানান, বেতন বৃদ্ধিসহ শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টি তিনি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করেছেন। আর নতুন বেতন কাঠামো এখনও সরকারীভাবে চূড়ান্ত হয়নি। শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা বাড়াতে সরকার সচেষ্ট আছে। এ নিয়ে আলোচনাও চলছে। তবে এখনও চূড়ান্ত কিছু হয়নি। বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন উপাচার্যরা, যেখানে দেশের ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ উপাচার্যই উপস্থিত ছিলেন। সপ্তম বেতন স্কেলে সচিব, সিলেকশন প্রেডের অধ্যাপক ও মেজর জেনারেল এক নম্বর গ্রেডে থাকলেও প্রস্তাবিত বেতন স্কেলে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও অধ্যাপকদের বেতন আগের তুলনায় নেমে গেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করে প্রস্তাবিত বেতন স্কেল সংশোধন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ঘোষণারও দাবি জানিয়েছেন। দাবি পূরণে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তারা। সভার শুরুতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আলাউদ্দিন মন্ত্রীর কাছে বেতন কাঠামো পুনর্বিবেচনার বিষয়ে তাদের যুক্তি তুলে ধরে স্মারকলিপি দেন। এরপর উপাচার্যদের মতমত শোনেন শিক্ষামন্ত্রী। বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রণালয়ের কোন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না। উপাচার্যদের মধ্যে ছিলেনÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম, বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক খালেদা ইকরাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফায়েকউজ্জামা, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোঃ আব্দুস সাত্তার, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম অহিদুজ্জামান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহীত উল আলম প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক মোঃ আলাউদ্দিন বলেন, শিক্ষকদের মর্যাদাহানি হবে আর তাদের (আমলা) বেতন বেড়ে যাবে, এটা হতে পারবে না। এটা আমরা মেনেও নেব না। পৃথিবীর কোথাও সুবিধা কমানোর ইতিহাস নেই। কিন্তু আমাদের দেশে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেলায় তাই করা হয়েছে। মন্ত্রীকে দেয়া স্মারকলিপিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদমর্যাদা জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ বিশেষ স্কেলের সমান করে অন্য সুবিধাদি নিশ্চিত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন, রাষ্ট্রীয় ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্টে (মর্যাদাক্রম) উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রত্যাশিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী পদমর্যাদা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। উপাচার্যরা জানান, ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে বেতন কাঠামো নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। সপ্তম বেতন কাঠামোতে অধ্যাপকদের সমান বেতন পাওয়া কর্মকর্তাদের প্রস্তাবিত অষ্টম কাঠামোতে যেভাবে বেতন বেড়েছে সে অনুযায়ী অধ্যাপকদের বেতন বাড়েনি। একই সঙ্গে সিলেকশন গ্রেড না থাকায় অধ্যাপকরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ‘কোন কুচক্রী মহল শিক্ষকদের স্বার্থে আঘাত করেছে’ উল্লেখ করে উপাচার্যরা বলেন, তারা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। এসব চক্রান্ত নস্যাত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সপ্তম বেতন কাঠামোতে যেভাবে বেতন পেতেন, তাতে নতুন কাঠামোতে তাদের আরও এগিয়ে যাওয়ার আশা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। কিন্তু এর থেকে পেছনে যাওয়া মেনে নেয়া কষ্টকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষকরা কোনভাবেই সপ্তম বেতন স্কেল থেকে পেছনে যেতে পারে না। এটা হয় না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তাল হবে। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয় তা বিবেচনা করে আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। অষ্টম বেতন কাঠামো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে ‘ষড়যন্ত্র’ কিনা- প্রশ্ন রেখে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক একেএম নূর-উন-নবী বলেন, বেতন বৈষম্য এনে শিক্ষকদের অবদমিত করা হচ্ছে, শিক্ষকদের তুচ্ছ করতে এটা করা হচ্ছে। সরকারের ভেতর যারা এটা করছে তারা আসলে কী চায় তা দেখা দরকার। বেতন কাঠামোতে শিক্ষকদের বেতন নিয়ে ‘চতুরতা’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ আনেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফায়েকউজ্জামান। তিনি বলেন, এটা শিক্ষকদের নিচে নামানোর একটা প্রায়স। এ বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন হলে বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হবে। এটা দমানো কঠিন হবে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আব্দুস সাত্তার বলেন, নিয়োগের সময়ও উপাচার্যদের কোনো সুবিধার কথা সুনির্দিষ্ট করা থাকে না। সবকিছু চেয়ে নিতে হয়, আমাদের অসম্মান করা হচ্ছে। তিনি বলেন, উপাচার্যদের মর্যাদা কী তা কেউ জানে না। সরকারী কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, একটি সরকারী অনুষ্ঠানে এক আরডিসি আমাকে দেখেও এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ভিসি সাহেব বলে পেছনে বসতে বলেছিলেন যে, তখন থেকে আর সরকারী অনুষ্ঠানেই যাই না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম উপাচার্যদের পদমর্যাদা বাড়ানো উচিত মন্তব্য করে জানান, কোন অনুষ্ঠানে গেলে তাদের বসতে দিতেও জটিলতা সৃষ্টি হয়। এতে বিব্রতবোধ করেন তারা। একটি অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে লেখা ছিল মেজর, সরকারী কর্মকর্তারা কে কোথায় বসছেন। আর আমাদের অবস্থান ছিল ‘অন্যান্য’দের কাতারে। পরে আমি নারী বলে দয়া করে সামনে বসতে দেয়া হয়। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম অহিদুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো চাইলেও সেটা হচ্ছে না। কেন? বাধা কোথায়? দীর্ঘ সময় ধরে সকল উপাচার্যের বক্তব্য শুনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষকদের সম্মান, মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়টি আমার একার ব্যাপার নয়, এটা পুরো শিক্ষা পরিবারের দাবি। নতুন বেতন কাঠামো এখনও চূড়ান্ত হয়নি উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, তাই রাস্তায় নেমে আপনাদের কষ্ট করার দরকার নেই। আমি চিঠি দিয়ে আপনাদের দাবিগুলো রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিবসহ সংশ্লিষ্টদেরও ডিও লেটার দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এগুলো বিবেচনা করা হবে।
×