ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মেডিক্যাল শিক্ষার অন্ধকার বলয়

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ৭ জুলাই ২০১৫

মেডিক্যাল শিক্ষার অন্ধকার বলয়

দীর্ঘদিন ধরে মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিবিএস ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝে বিরাজমান অবস্থা, অবজ্ঞা, পক্ষপাতিত্ব, শ্রেণীস্বার্থের সংঘাত, দলবাজি ও দাস প্রথার মতো শোষণ ও নির্যাতন সম্পর্কে সোচ্চার হওয়ার জন্য শুধু ভুক্তভোগী নয়, এই সমাজের সুধীজনও অনুরোধ করেছেন। এই অনুরোধের পেছনেও একটি বাস্তব পটভূমি আছে। যে পটভূমি আলোচনা করলে আঁধারে হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধ ধীরে ধীরে জনসমক্ষে দৃশ্যমান হবে। ২০০৩ সালের কথা। সরকারে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট। সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। প্রতিমন্ত্রী সাবেক ছাত্রনেতা আমানউল্লা আমান। লিখিত পরীক্ষায় ৮০ নম্বর ও মৌখিক পরীক্ষায় ২০ নম্বর। লিখিত পরীক্ষা শেষে মন্ত্রণালয় মৌখিক পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়। চরম অসন্তোষ উপেক্ষা করেই ফলাফল ঘোষণা করে মন্ত্রণালয়। ওই পরীক্ষায় আমার মেয়েও প্রার্থী ছিল। সে ভিকারুননিসা থেকে ম্যাট্রিকে সাত সাবজেক্টে লেটার পেয়েও ভর্তির সুযোগ পেল না। সোনার হরিণ ধরবার জন্য ভারতীয় দূতাবাসে দরখাস্ত করলাম। সে সময় এসএফএস নিয়মে ভারত সরকার বাংলাদেশকে একটি কোটা প্রদান করতেন। এখন সে পদ্ধতি বন্ধ হয়ে গেছে। দরখাস্তকারীর সংখ্যা চল্লিশ। মেয়ের অবস্থান দুই নম্বরে। মেয়ের স্থানীয় অভিভাবক ভারতের আজকের মাননীয় রাষ্ট্রপতি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাপতি শ্রী অশোক শিংগেল, আরএসএস প্রধান কে সুদর্শন, বৃন্দাবনের মহারাজ শ্রী বিজয় পুরকৌশল, দিল্লীর বাংলাদেশ দূতাবাস এবং অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী হয়ে ফাইলটি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিলে পৌঁছায়। আমার মেয়ের রেজাল্ট প্রথম প্রার্থী থেকে কয়েক মিলিমিটার দূরে। তা সত্ত্বেও আইএসসি প্রথম প্রার্থীকে ভর্তির জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তখন আরএসএস বিনা ডোনেশনেই মেয়েকে তাদের প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। দিল্লীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দৃষ্টিনন্দন কলেজ ও ছাত্রাবাস। ভর্তি প্রক্রিয়ায় দৌড়াদৌড়ি করতে করতে তিনবার ঢাকা-দিল্লী সফর করে যেমন ক্লান্ত, তেমনি আরএসএস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েকে ডাক্তার বানাব কিনা এই মর্মে কংগ্রেসের কোন কোন বন্ধু একটু ভাবতে বলায় ভীষণ বিব্রত। ইতোমধ্যে তিন মাস অতিক্রান্ত। সরকারী কলেজে ভর্তির সময় শেষ। গোটা ভারতে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা সামান্য। আরএসএস কলেজের চাকচিক্য এবং ভর্তি সংক্রান্ত বেগতিক অবস্থায় প্রাইভেট কলেজে পড়াবারই সিদ্ধান্ত নিলাম। হঠাৎ ২২ জুন ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস এই মর্মে অবগত করল যে, ভারত সরকার আপনার মেয়েকে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আইএমএসএ ভর্তির অনুমোদন দিয়েছে। যেখান থেকে আপনার মেয়ে শুধু এমবিবিএস বা এমডি/এমএস নয়, ডিলিটও করতে পারবে। তবে ৩০ জুনের মধ্যে ভর্তি না হলে এই আদেশ বাতিল হয়ে যাবে। মেয়ের ওখানে এমবিবিএস করবার কারণে আমাদের স্বামী-স্ত্রী মিলে ২২ বার বেনারস যাওয়া ও ২২ বার ঢাকা আসতে হয়। ১৩ কিলোমিটারের ওপর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি এবং কলা বিভাগ একই চত্বরের বিভিন্ন অঞ্চলে। সাথে ১২ শত বেডের হাসপাতাল। বিএইচইউ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৪টি দেশের ছাত্রছাত্রী এখানে অধ্যয়নরত। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও পরিবেশ থেকে অনেক কিছু শেখবার আছে। ভারত কত বিশাল দেশ, অথচ মেডিক্যাল শিক্ষা ও সেবাদানে একটি মাত্র মেডিক্যাল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত, যার প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়/মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় গভীর শ্রদ্ধাশীল। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মৌলিক ও মানবাধিকারের সর্বোচ্চ প্রাধান্য বহুদিন পূর্ব থেকে স্বীকৃত। শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীরা ভেতরে রাজনীতি করেন না। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে মানবসম্পদ হিসেবে বিবেচনায় রেখে তার বুদ্ধিবৃত্তি, দৈহিক ও মানবিক বিকাশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পূর্ণ চর্চা করা হয়। ব্যতিক্রম মানসিকতা একদম নেই এমনটি বলা ঠিক হবে না, তবে সাম্প্রদায়িকতা, পক্ষপাতিত্ব কিংবা নিগ্রহের মতো ক্ষতিকর উপসর্গসমূহ উচ্ছেদে কর্তৃপক্ষ সদা সজাগ দৃষ্টি রাখেন। সরকারী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা প্রাইভেট প্র্যাকটিস থেকে বিরত থাকেন। শিক্ষকতার বাইরে যথাসময়ে হাসপাতাল ডিউটিতে উপস্থিত থেকে নবীন ডাক্তার ও ছাত্রছাত্রীদের পিতৃসুলভ ভালবাসা ও সতর্কতা প্রদানে কখনও গাফিলতি করেন না। অর্থলিপ্সার প্রতি তেমন কোন দৃষ্টান্ত নজরে পড়েনি। ফাঁকফোকরে যদি কোন প্রফেসর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন তা হলে তা হতে পারে বিশেষ কারণে সরকার অনুমোদিত। নতুবা ওই নিয়ম ভঙ্গকারী প্রফেসরকে উপযুক্ত মূল্য দিতে হয়। প্রচলিত পদ্ধতিই ওখানে পাঠ গ্রহণকারী ডাক্তারদের মানবিক মূল্যবোধের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। যেমন এমবিবিএস কোর্সের কোন এক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের গ্রুপভিত্তিক ঝুঁকিপূর্ণ দুর্গম অঞ্চলে পাঠানো হয়। যেখানে গিয়ে তারা ডাক্তারি জ্ঞান অর্জন ছাড়াও মাটি, মানুষ আর প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় হতে পারে। ওখানে অভিভাবকদের মতামত যথেষ্ট মূল্য বহন করে। আমার মেয়ে ভর্তির সময় প্রফেসর মোহান্তি অবসরে গেলেন। সিনিয়র একাডেমিসিয়ান হিসেবে চলতি দায়িত্ব পেলেন প্রফেসর গজেন্দ্র সিংহ। রাজনীতি নিরপেক্ষ প্রফেসর সিংহ জেনারেল জগজিৎ সিংহ অরোরার নিকটাত্মীয়। এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি বিধাতার কৃপায় পরিচিত হলাম প্রফেসর ও পরিচালকম-লীর অধিকাংশ বিজ্ঞ সদস্যের সঙ্গে। মাঝখানে হাজির হলেন অর্থনীতির সাবেক প্রফেসর রাজনীতিবিদ দীপক মালিক; যিনি নবীন লেকচারার হয়েও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে সোভিয়েত রাশিয়ার মহান নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভের সান্নিধ্য পেতে সহায়তা করেছিলেন। তাঁর উপদেশে আমি নেতা প্রণব মুখার্জীকে এ মর্মে অনুরোধ করলাম যে, প্রফেসর গজেন্দ্র সিংহ সিনিয়র শিক্ষাবিদ। তিনি মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক। আইএমএসে ভারসাম্য নেতৃত্বের জন্য এমন একজন অধ্যাপকের অতীব প্রয়োজন। আমার স্লিপ নিয়ে নেতা দেখা করতে বললেন প্রফেসর সাহেবকে। সাক্ষাতের সময় তিনি যথেষ্ট সম্মান পেয়েছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মহোদয় থেকে। তারপরও তিনি শতভাগ সুনিশ্চিতের জন্য ম্যাডাম সোনিয়া গান্ধীকে অনুরোধ করতে বললেন। সে অনুরোধও রক্ষা করলাম। অনুরোধের সাত দিনের মধ্যে প্রফেসর গজেন্দ্র সিংহ চার বছরের মেয়াদে ডিরেক্টর পদে নিয়োগ পেলেন। আমার মেয়ের কোটা প্রাপ্তির পর ভারত সরকার আরও ২ বার কোটা অনুমোদন করেছিল। সৌভাগ্যক্রমে পরবর্তী দুজন প্রার্থীই বিএইচইউতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। কৃতজ্ঞতার দায়ভার হালকা করতে প্রফেসর সিংহ ওই দু’জন ছেলেমেয়েকে নিজ সন্তানের মতো লালন করে ডাক্তার বানিয়ে দিয়েছেন। ওখানে দেখেছি ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে মধুর সম্পর্ক। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের প্রফেসর মহোদয়রা এমনকি ডিরেক্টর নিজেও ‘ইয়ার’ বলে সম্বোধন করতেন। শিক্ষকের বাসায় কোন প্রয়োজনে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট গেলে খানা গ্রহণ ছিল বাধ্যতামূলক। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিল কোন সময়ই ছাত্রদের স্বার্থবিরোধী প্রস্তাব গ্রহণ বা সংশোধনী অনুমোদন করে না। কোন কারণে সংঘাতের সূচনা হলে কোমল ও কাঠিন্যের সমন্বয়ে সমাধান কামনা করে। ১৯১৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ওহফরধহ সবফরপধষ পড়ঁহপরষ আটবার সংশোধনী এনেছে এবং ২০১৩ সালে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে সর্বশেষ সংশোধনী প্রবর্তন করেছে, যার ভিত্তি হচ্ছে চড়ংঃ মৎধফঁধঃব সবফরপধষ বফঁপধঃরড়হ ৎবমঁষধঃরড়হং, ২০০০। এই রেগুলেশন মতে চড়ংঃ মৎধফঁধঃব (গ.ঝ, গ.উ, উ.গ, গ.ঈঐ) ডিগ্রীতে পাসের নম্বর হতে হবে সর্বনি¤œ ৫০% এবং কোর্স সময় তিন বছর। তবে এ সমস্ত ডিগ্রীর বিশেষ কোর্স আছে, যার মেয়াদ আরও ২ বছর। কিন্তু এই কোর্স অপশনাল। যারা চাকরি করেন তাদের জন্য ফলপ্রসূ; কিন্তু যারা স্বাধীন প্র্যাকটিস করেন তাদের জন্য এমডি, এমএস কোর্স তিন বছরেই সীমাবদ্ধ এবং ওই দুই বছরের কোর্স থেকে অবমুক্ত। (চলবে)
×