ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হোতা লন্ডনের বকুল মিয়া, ভারতের রাজু অর্থ যোগানদাতা

প্রকাশিত: ০৭:০১, ৫ জুলাই ২০১৫

হোতা লন্ডনের বকুল মিয়া, ভারতের রাজু অর্থ যোগানদাতা

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম বন্দরে লাতিন আমেরিকার বলিভিয়া থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে এবং এলসিবিহীন ভোজ্যতেলের চালানের সঙ্গে কোকেন পাচারের ঘটনার নেপথ্যে জড়িত আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্র। এ পর্যন্ত তদন্ত ও আসামিদের বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে সানফ্লাওয়ার ব্র্যান্ডের ভোজ্যতেল বাংলাদেশেই থেকে যেত। কোকেন চলে যেত যুক্তরাজ্যে। লন্ডনে অবস্থানরত বাংলাদেশী ব্রিটিশ নাগরিক বকুল মিয়া এ তরল কোকেন প্রেরণে কাজ করেছে। এতে অর্থ যোগান দিয়েছে বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত রাজু নামের এক ব্যক্তি; যাদের সঠিক ঠিকানা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এদের গ্রেফতারে ইন্টারপোল ও স্কটল্যান্ডইয়ার্ড পুলিশের সহায়তা নেবে বাংলাদেশ পুলিশ। ঘটনাকে কেন্দ্র করে শনিবার ১০ সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার কুসুম দেওয়ানকে এ কমিটির তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। শনিবার সকালে অনুসন্ধান টিমের সদস্যরা একটি জরুরী বৈঠক করেছেন। সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য এতে সভাপতিত্ব করেন। অনুসন্ধান কমিটির প্রধান হচ্ছেন গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এসএম তানভীর আরাফাত। অন্যান্যের মধ্যে আছেন সহকারী কমিশনার মোঃ কামরুজ্জামান, ফয়জুল ইসলাম, মোঃ মঈনুদ্দিন, নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী ও এসএম কামরুল হুদা। এছাড়া দুই ওসি বন্দর থানার একেএম মহিউদ্দিন সেলিম, আকবর শাহ থানার সদীপ কুমার দাশ এবং নগর গোয়েন্দা পুলিশর পরিদর্শক আবদুর রউফ ও জাহেদুল ইসলাম। এদিকে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া থেকে এলসি ছাড়া ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে জাহাজীকরণ হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হওয়া ভোজ্যতেলের সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় থাকা কোকেন শনাক্তের ঘটনায় এ পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত ৪ জনের রিমান্ড শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে। এদের একজন ছাড়া তিনজনের জিজ্ঞাসাবাদ শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে। এরা হচ্ছেন চট্টগ্রামের খানজাহান আলী গ্রুপের মালিকানার প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেল, গার্মেন্ট পণ্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ঢাকার ম-ল গ্রুপের বাণিজ্যিক নির্বাহী আতিকুর রহমান, কসকো বাংলাদেশ শিপিং লাইন লিমিটেডের ব্যবস্থাপক একে আজাদ ও একটি ডেভেলপার কোম্পানির কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল। এদের মধ্যে আতিকুর রহমান, একে আজাদ ও মোস্তফা কামালকে দশ দিনের এবং গোলাম মোস্তফা সোহেলকে পাঁচ দিনের রিমান্ড দিয়েছে আদালত। প্রসঙ্গত, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা সানফ্লাওয়ার ব্র্যান্ডের ভোজ্যতেলের ১০৭ ড্রাম গত ৬ জুন রাতে সিলগালা করে দেন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এরপর ৮ জুন ১০৭ ড্রামের প্রতিটিতে ১৮৫ কেজি করে সানফ্লাওয়ার তেল পাওয়া যায়। প্রথমদিকে চট্টগ্রামে কেমিক্যাল পরীক্ষায় কোকেনের কোন আলামত পাওয়া না গেলেও পরবর্তীতে ঢাকায় দুটি ল্যাব টেস্টে একটি ড্রামের নমুনায় কোকেনের আলামত পাওয়া যায়। এরপর থেকেই এ নিয়ে হৈ চৈ শুরু হয়। প্রথমে গ্রেফতার করা হয় প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেলকে। পরবর্তীতে অন্য তিনজনকে ঢাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে তাদের চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। চট্টগ্রামের আদালত প্রথমে এককভাবে সোপর্দ করা গোলাম মোস্তফা সোহেলকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। পরে ২ জুলাই আতিকুর আজাদ ও মোস্তফা কামালের দশ দিনের রিমান্ডে দেয়া হয়। ওই দিন থেকেই তাদের গোয়েন্দা হেফাজতে নেয়া হয়েছে। গোলাম মোস্তফা সোহেলকে গত ৩০ জুন রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দিলেও তাকে আজ রবিবার গোয়েন্দা হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হবে বলে পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে। এদিকে, দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া থেকে এ কোকেন নিয়ে আসার নেপথ্যে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দুই বাংলাদেশী ও এক ভারতীয় রয়েছেন বলে নিশ্চিত হয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে তরল এ কোকেন পাঠিয়েছিল লন্ডনে অবস্থারত বকুল মিয়া। আর এ তরল কোকেন প্রেরণে অর্থ যোগান দেয় বকুলের ব্যবসায়িক পার্টনার ভারতে অবস্থানরত জনৈক রাজু। পুলিশ জানায়, বকুল ও রাজু কোকেন চোরাচালানের গডফাদার। এছাড়া লন্ডন ও ভারতে অবস্থানরত আরও কয়েকজনের তথ্য পুলিশের হাতে এসেছে। তবে বকুল মিয়া ও রাজুই হচ্ছে হোতা। তাই তাদের ধরতে ইন্টারপোল ও স্কটল্যান্ডইয়ার্ডের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। নগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত চারজনকে আজ গোয়েন্দা দফতরে মুখোমুখি করা হবে। ইতোমধ্যে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে মিলিয়ে নেয়া হবে। পুলিশের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বকুল মিয়া লন্ডন থেকে তার নিকটাত্মীয় বাংলাদেশে অবস্থানরত গোলাম মোস্তফা সোহেল এবং আতিকুর রহমানের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের সঙ্গে আসা কোকেন খালাসের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছিল। এ প্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে যুক্ত হন একে আজাদ ও মোস্তফা কামাল। অনুসন্ধানী দলের প্রধান অতিরিক্ত উপ কমিশনার এসএম তানভীর আরাফাত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গ্রেফতারকৃত চারজনই এ তরল কোকেন চোরাচালান নেটওয়ার্কের সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী তরল এ কোকেন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত ছিল এ চক্রের। প্রসঙ্গত, যে ১০৭ ড্রামভর্তি ভোজ্যতেল আটক করা হয়েছে এর প্রতিটিতে ১৮৫ কেজি করে সানফ্লাওয়ার তেল রয়েছে। কেমিক্যাল পরীক্ষায় একটি ড্রামে তরল কোকেনের অস্তিত্ব মিলেছে। পুলিশ জানায়, এ সপ্তাহের মধ্যে ইন্টারপোল এবং স্কটল্যান্ডইয়ার্ড পুলিশের সহায়তা চাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। এজন্য পুলিশ সদর দফতরে ইন্টারপোল ডেস্কের সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগাযোগ করা হয়েছে। আর স্কটল্যান্ডইয়ার্ডের সহায়তা চাওয়ার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চাওয়া হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ে আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরকে অবহিত করা হবে। উল্লেখ্য, কোকেনের ঘটনা নিয়ে গত ২৮ জুন বন্দর থানায় একটি মামলা হয়। এতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে খানজাহান আলী গ্রুপের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ ও এ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেলকে আসামি করা হয়। সোহেল এর আগেই গ্রেফতার হয়। পরে তাকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। মামলার পর খানজাহান আলী গ্রুপের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। মামলার আগে তিনি শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে জানিয়েছেন, তার প্রতিষ্ঠানের সিল-প্যাড ব্যবহার করে ভোজ্যতেল ও কোকেন আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন এলসিও হয়নি। সবক্ষেত্রেই তার গ্রুপের নাম ব্যবহার করা হয়েছে এবং এর জন্য কাজ করেছে প্রাইম হ্যাচরির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেল। তবে তিনি যে বক্তব্যই দিন না কেন, এ মামলায় আসামি হওয়ার পর পুলিশ এখনও তাকে গ্রেফতার না করলেও তাকে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। বিচার প্রক্রিয়ায় তাকে প্রমাণ করতে হবে এ কাজে তার সংশ্লিষ্টতা নেই। পুলিশের বড় একটি অংশ মনে করে, নুর মোহাম্মদের অজ্ঞাতসারেই তার অফিসের কাগজপত্র জাল করে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কিন্তু আরেকটি অংশ মনে করে, তার জড়িত থাকার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়। তাই তাকে বিচার প্রক্রিয়ায় প্রমাণ করতে হবে তার বিষয়টি। পুলিশের ধারণা, বাংলাদেশে তরল কোকেন আটকের ঘটনা এই প্রথম। তবে আসার ঘটনা প্রথম নাও হতে পারে। কেননা, ইতোপূর্বে পাউডার আকারে কোকেন বহুস্থানে ধরা পড়েছে। কিন্তু তরল কোকেন কখনও ধরা পড়েনি। চট্টগ্রাম বন্দরে ভোজ্যতেলের সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় প্রথম ধরা পড়লেও আগে যে অনুরূপ কায়দায় আসেনি তা হলফ করে বলা যাবে না। প্রসঙ্গত, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, দক্ষিণ আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে কোকেনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে এসব দেশে কোকেন প্রবেশে কঠোর নজরদারি থাকায় বিভিন্ন দেশে ট্রানজিট হয়ে কোকেন প্রবেশ করে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরে আটক এ কোকেন মূলত বাংলাদেশকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়াস নেয়া হয়েছিল; যা শেষ পর্যন্ত ইন্টারপোলের খবরের ভিত্তিতেই আটকা পড়ে যায়।
×