ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনুবাদ : এনামুল হক

সর্বত্র ভেজাল খাদ্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৪ জুলাই ২০১৫

সর্বত্র ভেজাল খাদ্য

ভেজাল নিয়ে আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশীদের আজ নাভিশ্বাস অবস্থা। কোথায় নেই ভেজাল। চাল, আটা, তেল, ঘি থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ফলমূল, শাকসবজি সব কিছুতেই ভেজাল। এমনকি জ্যান্ত মাছ, মুরগি, গরুও ভেজালের হিংস্র ছোবল থেকে মুক্ত নয়। এভাবে ভেজাল সর্বগ্রাসী থাবা বিস্তার করে আছে আমাদের জীবনে। কিছু মানুষের অতি মুনাফাখোরীর কারণে আমাদের জনস্বাস্থ্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। আশ্চর্যের বিষয়, এই ভেজাল শুধু আমাদের দেশেই নয়, প্রতিবেশী ভারতেও প্রবল প্রতাপে মাথা তুলে আছে। শুধু ভারতেই বা কেন, চীন, আমেরিকা, ফ্রান্স, মেক্সিকো, ভিয়েতনাম কোথায় নেই ভেজাল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু’র ২০১৫ সালের রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বের যাবতীয় রোগব্যাধির এক বিরাট অংশজুড়ে আছে খাদ্যবাহিত রোগ যা ভেজালের কারণে ঘটে। এভাবে ভেজাল দুনিয়াজুড়ে ক্রমবর্ধমান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যের একটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যূনতম মান আছে। ভেজাল দেয়া হলে সেই মান লঙ্ঘিত হয়। এই মান লঙ্ঘনের দিক দিয়ে বিশ্বের সর্বশীর্ষে রয়েছে ভারত। সেখানে লঙ্ঘনের হার ১১.১ শতাংশ। এরপর চীন ৯.৯ শতাংশ, মেক্সিকো ৭.৫ শতাংশ। এ ধরনের শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে ফ্রান্সের স্থান চতুর্থ ৫.৫ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্থান পঞ্চমÑ লঙ্ঘনের হার ৫.৪ শতাংশ। যেসব খাদ্যে সর্বাধিক মান লঙ্ঘন করা হয় সেগুলোও হলো কাঁচা বা ন্যূনতম প্রক্রিয়াজাত খাবার, যার মধ্যে আছে সামুদ্রিক খাদ্য ২৩.৫ শতাংশ, সবজি ২০ শতাংশ, ফলমূল ১৩.৮ শতাংশ, মসলা ৮.৯ শতাংশ, ডেইরি পণ্য ৭.৫ শতাংশ, শস্য ৭.১ শতাংশ, মাংসে ৭ শতাংশ। এক-তৃতীয়াংশের বেশি খাদ্য জালিয়াতির ঘটনার জন্য দায়ী অত্যধিক মাত্রায় কিংবা বেআইনীভাবে কীটনাশক ব্যবহার, জীবাণু সংক্রমণ এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ভারতে ভয়াবহ ভেজাল ভারতে খাদ্য জালিয়াতি অর্থাৎ ভেজাল, দূষণ, জীবাণু সংক্রমণের হার বেড়ে ২০ শতাংশে পৌঁছেছে। ম্যাগী নুডলস নিয়ে এখন তো ওখানে এক তুলকালাম কা- চলছে। সুইস কোম্পানি নেসল্্ ইন্ডিয়া সেদেশের খাদ্যমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘এফসালের’ পরীক্ষার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলেও বাজার থেকে এক হাজার কোটি রুপী মূল্যের ২ কোটি প্যাক তুলে নিচ্ছে। তবে ম্যাগী নুডলসের এই কেলেঙ্কারি ভারতে খাদ্যে ভেজালের গোটা সমস্যার একটা সামান্য অংশ মাত্র। এই কেলেঙ্কারি ভারতে খাদ্য শিল্পের চেহারা নগ্ন করে দিয়েছে। বলাবাহুল্য ম্যাগী নুডলসে মনোসোডিয়াম গ্লুাটামেট ও সিসা মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে পাওয়া গেছে। ভারতীয়দের পাতে নেয়া কোন খাদ্যই এখন আর সন্দেহের উর্ধে নয়। খাদ্যচক্রের পুরোটাই হয়ে পড়েছে কিছু অসৎ ও অর্থগৃধœু মানুষের সীমাহীন লোভের শিকার। রাতারাতি বিপুল মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টায় এরা খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে। মিশাচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক। খাদ্য সরবরাহ চক্রের কোন না কোন স্তরে কেউ না কেউ এমন সর্বনাশটি ঘটিয়ে মানুষের জীবনকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। চা কফি দুধে ভেজাল ভারতে চা কফি দুধ এই সাধারণ পানীয়গুলো নির্ভেজাল ভেবে নিশ্চিন্তে মনে গ্রহণ করার উপায় নেই। কফিতে মেশানো থাকতে পারে কফির ঘ্রাণযুক্ত কর্দম, স্টার্চ এবং পুড়িয়ে গুঁড়ো করা তেঁতুল, খেজুর ও টেন্ডুর বীচি। চায়ের ভেজাল হলো ফেলে দেয়া চাপাতা শুকিয়ে তাতে আলকাতরার রং মিশিয়ে দেয়া। এ কাজে কাঠের গুঁড়োরও ব্যবহার আছে। এতে ফুসফুস ও ত্বকের ক্যান্সার হতে পারে। আগে দুধে ভেজাল বলতে বুঝানো হতো পানি মেশানো দুধ। এখন দুধে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক ফরমালিন। গো-খাদ্যে নির্বিচারে মেশানো হয় এন্টিবায়োটিক ও জেন্টামাইসিন। গরুকে খাওয়ানো ঘাস, খড় ও অন্যান্য খাদ্যে কীটনাশক হিসেবে ছিটানো হয় বরিক এসিড। এতে গরুর দুধের সঙ্গে এসব উপাদান মানুষের শরীরেও চলে আসে। দুগ্ধজাত যে কোন খাবার এমনকি আইসক্রিমেও এগুলো পাওয়া যেতে পারে। ফলের রসও নিরাপদ নয় চা কফি দুধে ভেজাল আছে ভেবে কেউ ফলের জুসের দিকে হাত বাড়াবে তারও উপায় নেই। আপেলের জুসে মেশানো থাকতে পারে বীট সুগার থেকে শুরু করে ইয়েলোভ, সানসেট ইয়োলা কিংবা সুদান ১ নামক কালার এডিটিভ যা অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। এগুলো অতিমাত্রায় ক্যান্সার উপাদান সমৃদ্ধ। অন্যান্য ফলের জুসেও প্রিজারভেটিভ হিসেবে মিশানো থাকতে পারে ফরমালিন যাতে কিডনির স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। পানীয় দ্রব্যে ভেজালের কথা ভেবে ওসব বাদ দিয়ে কেউ যদি শুধু পানিকে অবলম্বন করতে চায়, সেক্ষেত্রেও নিস্তার নেই। বোতলজাত পানিতে পাওয়া গেছে ব্রোমেটের মতো বিপজ্জনক রাসায়নিক। সায়ানাইড ও আর্সেনিকও কিঞ্চিৎ মাত্রায় পাওয়া গেছে। সাধারণ খাবার পানিতেও ব্রোমেট পাওয়া গেছে যা ক্যান্সার ঘটাতে পারে। ডিমে স্যালমোনেলা এক নমুনা সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারা ভারতের ৫ থেকে ৭ শতাংশ ডিমে মারাত্মক ক্ষতিকর জীবাণু স্যালমোনেলা রয়েছে। এই জীবাণু চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই শুধু যে সংক্রমিত হয় তা নয়, এর জন্য অতি মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ীর অসৎ ব্যবসায়িক অপকৌশলও কম দায়ী নয়। পাউরুটি-চাপাতিও অনিরাপদ ভারতে পাউরুটি, রুটি, চাপাতি, পরোটা এগুলোও নিরাপদ নয়। কারণ ওগুলো যে আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরি তাতে মেশানো থাকে কর্দম, ধুলোবালি, কীট ও ছত্রাক। এতে আটা-ময়দার রং ময়লা দেখানো স্বাভাবিক। তবে সেটাতে সাদা ঝকঝকে দেখানোর জন্যই মেশানো হয় ২৫ ধরনের রাসায়নিক। এ থেকে লিভার সমস্যা, ডায়াবেটিস, কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটা তো অসৎ ব্যবসায়ীদের কর্মকা-ের পরিণতি। তবে এটা ছাড়াও চাষাবাদের সময় গম, ওট, ভুট্টা, বার্লি প্রভৃতি খাদ্য মাইকোটক্সিন দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। ফলমূলেও একই অবস্থা ফলের দিকে কেউ হাত বাড়াতে চাইলে সেখানেও দেখা যাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের ভেজালের হিংস্র থাবা। গত এপ্রিলে ভারতের গোয়ায় ১২ হাজার কেজি আম ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। কারণ ওগুলো ইথেফন নামে এক রাসায়নিকের সাহায্যে কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হয়েছিল। ইথেফন মানবদেহের জন্য বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর। প্লাস্টিকের চাল ভারতে আরেক অভিনব খাদ্য জালিয়াতি হলো প্লাস্টিকের চাল। চীনের শানসি প্রদেশ থেকে সরাসরি আনা এমন চালে কেরলের বাজার সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। এক নজর দেখলে স্বাভাবিক চালের মতোই দেখায়। তাই কেউ অত খুঁটিয়ে দেখতে যায়নি। মসৃণ, পিচ্ছিল, দুধের মতো সাদা এই চালের প্রতিটি দানা নিখুঁতভাবে তৈরি। পানিতে ভেজালে ভাসবে। সিদ্ধ করলে ওয়াক্স পেপারের মতো শক্ত আঠালো বস্তুতে পরিণত হবে। আগুন লাগলে সরাসরি জ্বলে উঠবে। খেলে মারাত্মক পেটের পীড়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে এবং ঠিক ঘটেছিলও তাই কেরলে। আলু, মিষ্টি আলু ও পলিমার দিয়ে তৈরি তথাকথিত এই চাল নামমাত্র মূল্যে তৈরি। ভারতে এটাই সর্বশেষ খাদ্য জালিয়াতির ঘটনা। সর্বত্রই ভেজাল ও দূষণ ভারতের শহরাঞ্চলের লোকের সংসারের বাজেটের ৫০ শতাংশ যায় খাদ্যের পিছনে। অর্থব্যয়ের এটাই সবচেয়ে বড় আইটেম। এই খাদ্য তালিকায় শীর্ষে চাল, গম, যব, ভুট্টা এবং ডাল। তারপর শাকসবজি ও ফলমূলের স্থান। এরপর আসে দুধ, মাংস, ডিম, মাছ ইত্যাদি। কিন্তু যেখানে সবকিছুই ভেজাল সেখানে সংসার খরচের একটা বড় অংশ এই ভেজাল সামগ্রী কেনার মাধ্যমে স্রেফ পানিতে ফেলে দেয়া হয় এবং বিনিময়ে জীবন ও স্থাস্থ্য বিপন্ন করে ফেলা হয়। মাছের কথাই ধরা যাক। মাছ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে এ্যামোনিয়া ও ফরমাল ডিহাইড। খামারের গরু ছাগলকে মোটাতাজা করতে ও দ্রুত বেড়ে উঠতে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে গ্রোথ হরমোন ও এন্টিবায়োটিক। অথচ রাখা হচ্ছে চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। ফলমূল ও সবজি তাজা ও আকর্ষণীয় দেখাতে কপার সালফেটে রঞ্জিত করা হচ্ছে এবং হরমোন অক্সিটোসিন দেয়া হচ্ছে। কৌশল আধুনিক হচ্ছে ভারতে ভেজালের কৌশল সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে। দিনকে দিন আধুনিক থেকে আধুনিকতর হচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল বলতে আগে বোঝাত দুধে বা জুসে পানি মেশানো, চালে কাঁকর মেশানো। সে জায়গায় এখন এসেছে মারাত্মক ক্ষতিকর কীটনাশক, সিনথেটিক রং ও হরমোন। বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এন্টিবায়োটিক ও ডিএনএ পরিবর্তনকারী কার্সিওজেন। এতে ক্রেতারা শুধু ঠকছে না, তারা ধ্বংসের পথে এগুচ্ছে। সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে
×