ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পকেটমার, বোরকা পার্টি ধাক্কা পার্টির দৌরাত্ম্য ঈদ ঘিরে তুঙ্গে

শপিংমল টার্মিনাল ঘিরে তৎপর অজ্ঞান টানা ও মলম পার্টি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৪ জুলাই ২০১৫

শপিংমল টার্মিনাল ঘিরে তৎপর অজ্ঞান  টানা ও মলম পার্টি

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ঈদ সামনে রেখে রাজধানীর অভিজাত শপিংমল, টার্মিনাল ঘিরে ফের বেপরোয়া অজ্ঞানপার্টি, টানাপার্টি ও মলমপার্টির সদস্যরা। প্রতিনিয়তই এরা যাত্রী ও হকারবেশে সাধারণ যাত্রীকে টার্গেট করে কৌশলে নেশাদ্রব্য খাইয়ে নগদ টাকাসহ সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনকি এসব মার্কেট ঘিরে রয়েছে বোরকা পার্টি, পকেটমারের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। ছিনতাই, টানাপার্টিসহ নানা ধরনের দুর্বৃত্তের উৎপাতের ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। কখনও মাইক্রোবাস, কখনও প্রাইভেটকার, আবার কখনওবা মোটরসাইকেলে ছিনতাইকারীরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে যানের গতিরোধ করে অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি প্রতিদিনই কেউ না কেউ অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, থুথু, টানাপার্টি, ধাক্কাপার্টি ও পকেটমারের সদস্যসহ নানা প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। ঈদ কেনাকাটা শেষে অথবা কেনার জন্য মার্কেটের যাবার সময় এসব প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সব খুইয়ে অনেকের ঈদ আনন্দই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ছিনতাই প্রতিরোধে ঢাকা মহানগরীর ৪৭ থানায় একাধিক মোবাইল চেকপোস্ট ছাড়াও সাদা পোশাকের দল, একাধিক থানায় বোরকাপার্টি নামের বিশেষ দল তৈরি করা হয়েছে। তারপরও প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না টানাপার্টির দৌরাত্ম্য। প্রতিদিনই নগরীর অভিজাত বিপণিকেন্দ্র ঘিরে এদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিদিনই এদের খপ্পরে পড়ে প্রায় দুই শতাধিক নারী-পুরুষ নগদ টাকা ও মূল্যবান মালপত্র হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আবার গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথে বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে এসব প্রতারকের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকেই। এমনকি এদের সর্বনাশা নেশার পণ্য খেয়ে অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন। আবার অনেকে দীর্ঘ সময় অচেতন থাকছেন। এতে অনেকে মানসিক রোগ ও বিকলাঙ্গসহ নানা শারীরিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। শুক্রবার (১৫ রোজা) দুপুরে বড় মগবাজার এলাকার বাসিন্দা গৃহবধূ রৌশনী তার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে অরনীকে নিয়ে গাউছিয়া মার্কেটে ঈদের কেনাকাটার জন্য যান। এ সময় তার ছোট বোন মনি ছিলেন। রিকশায় নিউমার্কেট ১ নম্বর গেটে নামেন তারা। পরে তারা হেঁটে গাউছিয়া মার্কেটে যাবার জন্য রাস্তা পার হবার সময় কিশোর বয়সী দুজন তাদের পিছু নেয়। রাস্তা পার হবার সময় তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়া সময় বোন মনি দেখে চিৎকার দেন। কিন্তু অদূরে টহল পুলিশের সামনে দিয়ে ওই পকেটমার কিশোররা ভৌঁ দৌড় দিয়ে বলাকা সিনেমা হলের পেছনে নীলক্ষেত বই মার্কেটের গলি দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মনি অভিযোগ করেন, বড় বোন ও তার কলেজ পড়ুয়া মেয়ের কেনাকাটার প্রায় ১০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। পুলিশের সামনে দিয়ে ওরা পালিয়ে গেলেও তারা নীরব ভূমিকা পালন করেছে। এখানকার আগত ক্রেতা, দর্শনার্থী ও ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, এখানে টানাপার্টি ও পকেটমারের দৌরাত্ম্যে তারা অতিষ্ঠ। থানার মাত্র ১০০ গজের মধ্যে এই টানাপার্টি ও পকেটমারের উৎপাত নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে বলেছেন, পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে এসব প্রতারক চক্রের উৎপাত কমছে না। প্রতিদিন এসব মার্কেট ঘিরে পকেটমারের সদস্যরা মেন সড়ক থেকে মহিলাদের ফলো করতে থাকে। প্রকাশ্যে এরা পেছন থেকে মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। সেখানে দর্শনার্থীরা এর প্রতিবাদ করলে, উল্টো তাদের ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। এমনকি পকেটমাররা কৌশলে প্রতিবাদকারী দর্শনার্থীকে চোর বানিয়ে গণধোলাইয়ের ফাঁদে ফেলে সটকে পড়েন। এদিকে ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই এদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তবে নিউমার্কেট থানার পুলিশ জানিয়েছেন, পকেটমার, টানাপার্টি ও ইভটিজিং রোধে ধানম-ি হকার্স মার্কেটের সামনে পুলিশের মনিটরিং টিম বসানো হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল, সায়েদাবাদ, মহাখালী, গাবতলী, গুলিস্তান, ফার্মগেট, মালিবাগ ও মগবাজারসহ প্রায় ৩০টি স্পটে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে দুর্বৃত্তরা। সুযোগ পেলেই এসব প্রতারক চক্র চড়াও হচ্ছে শিকারের ওপর। টাকাপয়সা, মূল্যবান সম্পদ; যা-ই পাচ্ছে হাতিয়ে নিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, থুথু পার্টির চক্রের সদস্যরা প্রথমে কোন নিরীহ পথচারীকে টার্গেট করে তার শরীরে থুথু ছিটিয়ে দেয়। এ নিয়ে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে ওই পথচারীর ওপর একযোগে হামলা চালিয়ে চক্রের সদস্যরা টাকাপয়সা, মোবাইল ফোনসেট ছিনিয়ে নেয়। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীকে কখনও কখনও গণপিটুনির শিকারও হতে হয়। থুথুপার্টিতে যোগ দিচ্ছে নতুন নতুন সদস্য। তারা এখন আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে মাঠে নেমেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নগরীতে র্দীঘদিন ধরে মতিঝিলে সাবের আলীর নেতৃত্ব মোলন্টা রনি, কালু ও মিজান এখন এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। এর আগে এরা পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিল। মহাখালীতে ধাক্কাপার্টির দৌরাত্ম্য বেড়েছে। ঢাকায় নতুন আগতরা নিয়মিতই পড়ছেন বিপদে। এখানকার সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীচক্রের নেতৃত্বে রয়েছে স্থানীয় সন্ত্রাসী আলেক। পথচলা মানুষকে অযথা ধাক্কা দিয়ে বা নিজেরাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে প্রথমে সহযোগীরা এসে ‘মীমাংসার নামে’ ওই পথচারীকে মহাখালী কাঁচাবাজারসংলগ্ন গলিতে নিয়ে গিয়ে সবকিছু লুটে নেয়। গুলশান থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ধাক্কাপার্টির সদস্যদের ধরতে দফায় দফায় অভিযান চালিয়েছেন। এখানকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা জানিয়েছে, ঈদ উপলক্ষে দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও উত্তরাঞ্চল থেকে আসা গরিব ও সহজ-সরল যাত্রীই তাদের খপ্পরে পড়ছে বেশি। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে অজ্ঞান পার্টি। দূরপাল্লার যাত্রীকে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয় এ চক্র । কিছুক্ষণের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়া যাত্রীকে হাসাপাতালে নেয়ার নাম করে সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়ে। সম্প্রতি, গাবতলী-আরিচা রুট, মহাখালী-টাঙ্গাইল ও সায়েদাবাদ-কুমিল্লাা রুটের এই চক্রের তৎপরতা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েছে। প্রতিটি টার্মিনালে ১৫/১৬ জনের সংঘবদ্ধ গ্রুপ এ অপকর্ম করে চলেছে। অভিযোগ রয়েছে, একশ্রেণীর পরিবহন শ্রমিকের সহায়তা পাচ্ছে অজ্ঞানপার্টি। যাত্রীদের সামনে অজ্ঞানপার্টি তৎপরতা ॥ তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ঈদ সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানের জনাকীর্ণ বাস-ট্রেন-লঞ্চ টার্মিনাল, ফেরিঘাট ঘিরে অজ্ঞান ও টানাপার্টির সদস্যরা বেশি তৎপর। তাদের প্রধান টার্গেট নগদ অর্থ ও মুল্যবান পণ্যসামগ্রী বহনকারী নানা শ্রেণীপেশার লোকজন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অজ্ঞানপার্টির এক সদস্য জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে ছয়মাস কারাভোগের পর সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পায়। বলেন, অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা অত্যন্ত চতুর প্রকৃতির। নানা কৌশলে যাত্রী-হকার ও ক্রেতা-বিক্রেতাবেশে বাস-ট্রেন-লঞ্চ টার্মিনাল এমনকি ফেরিঘাটে শিকারের সন্ধানে দলবেঁধে ওঁৎ পেতে থাকে। এসব চক্রের সদস্যরা প্রথমে দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন স্পটে অবস্থান নেয়। পরে শিকার চিহ্নিত করলে তারা তার পিছু নেয়ার সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে একে অপরকে না চেনার ভান করে যাত্রীবেশে বাস-ট্রেন ও লঞ্চে ওঠে। মাঝেমধ্যে তাদের মিশন সফল করতে অন্যান্য চতুর যাত্রীর কবল থেকে নিজেদের আড়াল করার কৌশল অবলম্বন করে। এজন্য তাদের দলের একজন জানালার পাশের সিট খালি রেখে অপর সিটে বসে। অপর সদস্যরা ওই সিটের আশপাশের সিটে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে। এ সময় তারা সাংকেতিক ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে টার্গেটকৃত যাত্রীকে নিরাপদে কাবু করতে খালি সিটে বসতে দেন। যাত্রাপথে বাস-লঞ্চ-ট্রেন ছাড়ার পর নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার আগেই কৌশলে ওই যাত্রীর নাম-পরিচয় পদবি এমনকি ব্যবসার ধরনও জেনে নেন। এরই মধ্যে সামনে একটি বাসস্ট্যান্ড থেকে হকারবেশে তাদের এক সহকর্মী উঠে জুস-পানি, সর্দি-কাশি উপশমের নামে লজেন্স, শক্তিবর্ধক বড়ি বা হালুয়া-চাটনি বিক্রির ক্যানভাস করেন। তখন যাত্রীবেশে বসে থাকা তাদের একজন নগদ টাকায় ওই হকারের কাছ থেকে ওই সব লোভনীয় পণ্য (চেতনানাশক বিহীন) কিনে তা খেতে থাকেন। একপর্যায়ে সুস্বাধু বলে দরদাম করে আরও কয়েকটি কিনে আশপাশের যাত্রীদের উৎসাহিত করেন। তখন কোন না কোন যাত্রী তাদের ফাঁদে পড়ে হকারের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করেন। হকার বিষয়টি বুঝতে পেরে চেতনানাশকদ্রব্য মিশ্রিত পণ্য হাতে ধরিয়ে দিয়ে নেমে যান। ওই যাত্রী তা কিনে মুখে দেন। কিছুক্ষণ পরই জ্ঞান হারিয়ে অচেতন হয় যাত্রীটি। তখন তারা ওই অচেতন যাত্রীর পকেট কেটে নগদ টাকাসহ মালামাল হাতিয়ে নিয়ে দ্রুত সটকে পড়েন। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীর ২৩৩ মার্কেট তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এসব মার্কেটের সামনে পোশাকে ও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর। যেসব মাকের্টে পকেটমারের ঘটনা ঘটে সেসব মাকের্টের আলাদা আলাদা তালিকা করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী মার্কেটগুলোতে সারাক্ষণ টহল দিচ্ছে গোয়েন্দারা। এসব গোয়েন্দা রয়েছে ক্রেতার বেশে। যেখানেই বেশি ভিড় সেখানেই গোয়েন্দা। শতাধিক পুরুষ ও মহিলা গোয়েন্দার সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে দশটি বিশেষ টিম। টিমগুলো মার্কেটে মার্কেটে বিশেষ বিশেষ সময়ে টহল দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু নারী পকেটমারকে গ্রেফতার করেছে তারা।
×