ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আতঙ্কে রাত কাটে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৪ জুলাই ২০১৫

আতঙ্কে রাত কাটে

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ কত সরকার আইলো আর গ্যালো। নদীভাঙ্গনের হাত থেইকা মোগো বাঁচাইতে এখনও কেউ কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নিল না। আর এইয়ার লাই¹া মোগো ভাগ্যেরও কোন পরিবর্তন হইল না। আক্ষেপ করে কথাগুলো বললেন কীর্তনখোলা নদীর করাল গ্রাসে একমাত্র আয়ের উৎস সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া ব্যবসায়ী ফারুক মজুমদার। বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই ভয়াবহ ভাঙ্গনে কীর্তনখোলা নদীর পশ্চিম তীরবর্তী বেলতলা ও চরবাড়িয়া পয়েন্টের বাসিন্দারা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে এলেও বৃহস্পতিবার ভোরে পূর্বপ্রান্তের ব্যবসায়ীদের পুরোপুরি নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে সর্বনাশা কীর্তনখোলা। ওই দিন ভোর থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত কীর্তনখোলা গ্রাস করে নিয়েছে চরকাউয়া খেয়াঘাট ও ফেরীঘাটসহ বাজারের মুদি-মনিহারি, ওষুধের ফার্মেসি, কনফেকশনারি, কাঁচামালের দোকান, মাছের আড়তসহ প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা। একমাত্র আয়ের উৎস সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ওই সব ব্যবসায়ী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। এর আগে গত ২৭ জুন ভোরে বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের রফিয়াদি এলাকায় আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে একটি রাইসমিল, একটি স’মিলসহ দুটি বসত ঘর। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমের শুরুতে রাক্ষুসী মেঘনা, তেঁতুলিয়া, কালাবদর, জয়ন্তী, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, কীর্তনখোলা, আড়িয়াল খাঁ, পয়সারহাট, পালরদী, নয়াভাঙ্গনী, মাছকাটা, লতা, আইরখালী, পায়রা নদীতীরের বাসিন্দাদের নদীভাঙ্গন নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। কখন যেন বসতভিটাসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান চলে যায় নদীগর্ভে, সেই আতঙ্কে রাত জেগে কাটাচ্ছেন দক্ষিণের ভয়ঙ্কর ১৫টি নদীপাড়ের কোটি মানুষ। এসব নদীপাড়ের মানুষের স্থায়ী দুঃখই হচ্ছে নদীভাঙ্গন। বিশেষ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে অব্যাহত নদীভাঙ্গনের ফলে বিলীন হয়ে গেছে দক্ষিণের শতাধিক গ্রাম, যে কারণে ক্রমেই বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের স্থলভাগের মানচিত্র ছোট হয়ে আসছে। এক সময় যাদের গোয়াল ভরা গরু, শস্যে ভরা ক্ষেত আর পুকুর ভরা মাছ ছিল, তারাই এখন নদীভাঙ্গনে সর্বস্বান্ত হয়ে নাম লিখিয়েছেন ভূমিহীনদের তালিকায়। ঠাঁই নিয়েছেন কোন বেড়িবাঁধের ওপর কিংবা জীবন-জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছেন ঢাকা অথবা বিভাগীয় কোন বড় শহরের বস্তিতে। উপকূলের কোটি মানুষের সারাবছর ভাল কাটলেও বর্ষাকাল এলেই নদীভাঙ্গন নিয়ে উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পাশাপাশি নদীভাঙ্গনের শিকার হয়ে প্রতি বছর এ অঞ্চলের লাখ লাখ পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। প্রাণহানি ও নিখোঁজের ঘটনাও রয়েছে অসংখ্য। গ্রাম্য প্রবাদমতে, ‘ঘর পুড়লে ভিটেমাটিটুকু থাকে কিন্তু নদীভাঙ্গনে কিছুই থাকে না।’ এমনকি পূর্বপুরুষের কবর জিয়ারতের সুযোগটি পর্যন্ত পায় না ভাঙ্গনকবলিত মানুষেরা। বাড়িঘরের সঙ্গে গাছপালা আর পারিবারিক গোরস্তানও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। খোদ বরিশাল নগরীসংলগ্ন চরবাড়িয়া, চরমোনাই, চরকাউয়া, চরআইচা ও চরবদনার অব্যাহত ভাঙ্গনে ইতোমধ্যে বিপুলসংখ্যক মসজিদ, স্কুল, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ইটভাঁটিসহ কয়েক হাজার ঘরবাড়ি কীর্তনখোলা নদীতে বিলীন হয়েছে। আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গনে শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের কালীগঞ্জ, রাজাপুর ও আটহাজার নামের তিনটি গ্রাম বহু আগেই বিলীন হয়ে গেছে। এসব গ্রামের এখন আর কোন অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। হুমকির মুখে রয়েছে ওই এলাকার নদীতীরবর্তী শতাধিক পরিবার, শত শত একর ফসলী জমি, রাস্তাঘাট। সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শাহিন বলেন, গত বছর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধতন কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে ভাঙ্গণ প্রতিরোধের আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও আজও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বর্তমানে কীর্তনখোলার তিন কিলোমিটার এলাকা নদীতে ধসে পড়ার হুমকির মুখে রয়েছে। এছাড়া বর্ষায় সুগন্ধা নদীর ভয়ঙ্কর ভাঙ্গণে চরম হুমকির মুখে রয়েছে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের দোয়ারিকা এলাকার বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুসহ বরিশাল বিমানবন্দর, মেঘনা সংরক্ষণ বাঁধ, একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, ফেরিঘাট ও সড়ক। সরেজমিন দেখা গেছে, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুর দক্ষিণ-পূর্ব পাশের এ্যাপ্রোচ সড়ক থেকে মহিশাদি সৈয়দ মোশাররফ হোসেন একাডেমি পর্যন্ত এলাকায় ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। একই অবস্থা ওই এলাকার মানিককাঠী ও রাকুদিয়া গ্রামের। স্থানীয় ইউপি সদস্য মোঃ সাদেক জানান, সেতুর গোড়ায় ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও সুগন্ধার ভাঙ্গনে সৈয়দ মোশাররফ হোসেন একাডেমি চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ইতোমধ্যে ভেঙ্গে গেছে একটি মসজিদ। তিনি আরও বলেন, অতিসম্প্রতি পানিসম্পদমন্ত্রী সরেজমিন পরিদর্শন করে ভাঙ্গণ প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। সুগন্ধার ভাঙ্গনে হুমকিতে রয়েছে বরিশাল বিমানবন্দর ও আবুল কালাম ডিগ্রী কলেজ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় সেতু ও বিমানবন্দরকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মেঘনাঘেরা মেহেন্দীগঞ্জের উলানীয়া নদী সংরক্ষণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে চলতি বর্ষায় ব্লক সরে গিয়ে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। একই অবস্থা উপজেলার লেংগুটিয়া, পাতারহাট স্টিমারঘাটের। ঘাট ইজারাদার মনির জমাদ্দার বলেন, পাতারহাট বন্দরসংলগ্ন কয়েকটি দোকান নদীভাঙ্গনের কারণে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নদীভাঙ্গনের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে সেখানকার উলানীয়া মোজাফফর খান ডিগ্রী কলেজ, করনেশন হাই স্কুল, বালিকা বিদ্যালয়, মহিলা মাদ্রাসা, তেতুঁলিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। গত কয়েক বছরের ভাঙ্গনে ভাসানচর, বাগরজা, শিন্নিরচর নদীভাঙ্গনের কবলে মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তৌফিকুর রহমান সিকদার জানান, মেঘনা নদী গ্রাস করে নিয়েছে পুরান হিজলা, চরমেমানিয়া, মৌলভীরহাট, গঙ্গাপুর, হরিনাথপুর, মল্লিকপুর, বাউশিয়া, বাহেরচর, হিজলা-গৌরবদী ও পালপাড়া গ্রামের কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, ১০টি স্কুল এবং তিনটি হাট-বাজার। ওই উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ আজও আশ্রয়হীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। ভাঙ্গনকবলিত পরিবারগুলোর সহস্রাধিক মানুষের আশ্রয় মিলেছে স্থানীয় রিং বেড়িবাঁধে। এখনও চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে হরিনাথপুর বাজার, ধুলখোলা, আলীগঞ্জ বাজার ও বাউশিয়া গ্রাম। সূত্রমতে, ভোলা ও বরিশালের মধ্যবর্তী আলিমাবাদ ইউনিয়ন কালাবদর নদীর স্রোতে বিলীন হওয়ার পথে। পার্শ্ববর্তী চাঁদপুরা ইউনিয়নটি রয়েছে চরম হুমকির মুখে। মুলাদীর জয়ন্তী ও আড়িয়াল খাঁর ভাঙ্গনে উপজেলার নন্দিবাজার, চরলক্ষ্মীপুর, পাতারচর, বানিমদন, নাজিরপুর, মৃধারহাট, ছবিপুর, গুলিঘাট ও বাটামারা গ্রামের দুই হাজার বাড়িঘর, পাঁচটি বাজার ও ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মুলাদী থেকে গৌরনদী যাতায়াতের সড়কটি বিলীন হয়ে যাওয়ার দীর্ঘ ১০ বছরেও বিকল্প সড়ক তৈরি করা হয়নি। মুলাদী উপজেলার সফিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফখরুল আহসান শাহাজাদা মুন্সী বলেন, গত রবিবার চরমেমালিয়া লঞ্চঘাট এলাকায় ৯টি বাড়িঘর ও যাত্রী ছাউনি রাক্ষুসী জয়ন্তী নদী গ্রাস করে নিয়েছে। মৃধারহাট লঞ্চঘাটেও ভাঙ্গন ধরেছে। তিনি আরও বলেন, ভাঙ্গণ প্রতিরোধে দীর্ঘদিন থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধতন কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন সুফল মেলেনি। সন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গনে বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠী সড়কটি ছয় বছরে আগে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যদিও এখন সেখানে বিকল্প সড়ক তৈরি করা হয়েছে। বাবুগঞ্জের সুগন্ধা, আড়িয়াল খাঁ ও সন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গনে রাজগুরু, লোহালিয়া, ক্ষুদ্রকাঠী, বাহেরচর, ঘোষকাঠী, মহিষাদি, রাকুদিয়া, ছানি কেদারপুর, মোল্লারহাট, রহিমগঞ্জ, রফিয়াদি গ্রামের কয়েক হাজার বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বর্তমানে উপজেলা সদর ও মীরগঞ্জ বাজার থেকে সুগন্ধা নদীর দূরত্ব মাত্র ১শ’ গজ। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের পাঁচটিই নদীভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। চরম হুমকির মুখে রয়েছে শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জাদুঘর। উজিরপুরে সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীর ভাঙ্গনে বরাকোঠা ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রাম ও শিকারপুরের ১০টি গ্রাম এবং গুঠিয়া ইউনিয়নের দাসেরহাট, কমলাপুর, সাকরাল, পরমানন্দ গ্রামের ২০ হাজার ঘরবাড়ি ও পাঁচটি স্কুল-মাদ্রাসা নদীতে বিলীন হয়েছে। ওই উপজেলার সাকরাল গ্রামটি সম্পূর্ণ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। শিকারপুর ও শেরেবাংলা ডিগ্রী কলেজ বর্তমানে সন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। এ নদীর ভাঙ্গনে বানারীপাড়া উপজেলার কাজলাহাট, জম্বুদ্বীপ, ব্রাহ্মণকাঠী, নাজিরপুর, শিয়ালকাঠী, মসজিদবাড়ির ১৫ হাজার ঘরবাড়ি, ৭টি স্কুল-মাদ্রাসা ও দুটি বাজার ইতোপূর্বে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। শিয়ালকাঠী, দান্ডয়াট ও নলশ্রী গ্রাম এখন বিলীনের পথে। ভারি বর্ষণে উজিরপুর-সাতলা সড়কটি এখন হুমকির মুখে। ইতোমধ্যে সাকরাল বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যলয়ের সামনের অংশ ভেঙ্গে পড়েছে, পাশের মসজিদটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গত বছর বরাকোঠা ইউনিয়নের প্রায় দেড় হাজার পরিবার নদীভাঙ্গনে সর্বস্ত্র হারিয়ে পথে বসেছে। ওই এলাকার চৌধুরীরহাট বাজারের প্রায় ৫০টি দোকানঘর বিলীন হয়ে যাওয়ায় জমির অস্তিত্বের সঙ্কটে বাজারটি এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দাসেরহাট, হক সাহেবের হাট, কমলাপুর, শিকারপুর এলাকার সহস্রাধিক পরিবার ভাঙ্গন আতঙ্কে রয়েছে। আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট নদীর ভাঙ্গনে খাজুরিয়া, বাগধা, চাত্রিশিরা, আমবৌলা ও সাতলা গ্রামের কয়েক শ’ ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। বর্তমানেও পয়সারহাট নদীর ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। গৌরনদীর পালরদী নদীর ভাঙ্গনে উপজেলার হোসনাবাদ ও মিয়ারচর গ্রামের বাড়িঘর প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে। এখনও অসংখ্য বাড়িঘর, স্কুল ও বাজার ভাঙ্গনের মুখে পড়ছে। বাকেরগঞ্জের তুলাতলা, তা-ব, খয়রাবাদ, বেবাজ, কাতিভাঙ্গা, রাঙ্গামাটি তুলাতলী নদীর ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। ওই নদীর করাল গ্রাসে এখন হুমকির মুখে রয়েছে কলসকাঠী, বোয়ালিয়া, বাখরকাঠী, নীলগঞ্জ, চরামদ্দি এলাকার কয়েক হাজার বাড়িঘর। মেহেন্দীগঞ্জের মেঘনা, তেঁতুলিয়া, মাছকাটা, লতা ও আইরখালী নদীর ভাঙ্গনে উপজেলা সদর, গৌবিন্দপুর, উলানিয়া, চাঁনপুর, আলিমাবাদ, চরগোপালপুর, ভাসানচর, দরিররচর-খাজুরিয়া, চরএকরিয়া এলাকার কয়েক হাজার বাড়িঘর, অর্ধশতাধিক স্কুলসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গোবিন্দপুরের ৯টি গ্রামের মধ্যে বর্তমানে মাত্র একটি গ্রাম রয়েছে। ওই একটি গ্রামকে পুনরায় ৯টি গ্রামে বিভক্ত করা হয়েছে। তাও ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। ভাঙ্গনকবলিতদের অভিযোগ, প্রতি বছর নদীভাঙ্গন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও নামমাত্র কাজ করে সিংহভাগ টাকাই ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের পকেটে চলে যায়। ভাঙ্গন প্রতিরোধে কখনই কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ভাঙ্গনকবলিত এলাকার মানুষেরা জানান, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত যে পরিমাণ টাকা নদীভাঙ্গন প্রতিরোধের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সে টাকায় ভাঙ্গনকবলিত গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষদের পুনর্বাসন করা সম্ভব হতো। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙ্গনের শিকার হয়ে দু-এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে নতুন কোন বেড়িবাঁধে বসতি গড়ে ভাঙ্গনকবলিত মানুষেরা। কিন্তু দেখা যায় দু-এক বছরের মধ্যেই আবার সেখানেও নদী আঘাত হানে। এভাবেই একের পর এক ভাঙ্গনের শিকার হয়ে অসহায় মানুষ গ্রাম ছেড়ে রুটি-রুজির সন্ধানে পাড়ি জমায় ঢাকা কিংবা বিভাগীয় কোন বড় শহরে। এদের ঠাঁই হয় বস্তিতে। কেউ রিক্সা চালিয়ে কিংবা ঠেলাগাড়ি ঠেলে আবার গৃহবধূরা জীবিকার সন্ধানে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালায়। এক সময় যাদের গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর শস্যে ভরা মাঠ ছিল, তারাই নদীভাঙ্গনের শিকার হয়ে এখন নগরজীবনে হতদরিদ্র মানুষের তালিকাভুক্ত হয়ে সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুক্তভোগীরা ভাঙ্গণ প্রতিরোধে সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ার দাবি করেছেন। সরকারী হিসাবমতে, সারাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে ৪০ শতাংশ মানুষ। অথচ নদীভাঙ্গনের শিকার ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় বিভাগ বরিশালে দারিদ্র্যের হার ৫৩ ভাগ। এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই বিরূপ আবহাওয়ার কারণে পানি বৃদ্ধি ও সাগরে নিম্নচাপের কারণে নদীতীরবর্তী জনসাধারণের মাঝে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নদীতীরের বাসিন্দারা জানান, পানি নামতে শুরু করার আগেই ভাঙ্গন ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। বৃহস্পতিবার কীর্তনখোলার চরবাড়িয়া এলাকার নদীভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শন শেষে বরিশালে সদ্য যোগদানকারী জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান বলেন, নদীভাঙ্গন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে তাঁকে জানানো হয়েছে। বরিশাল-৩ আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট শেখ মোঃ টিপু সুলতান বলেন, ভাঙ্গনকবলিত স্থানে শীত মৌসুমে স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রাথমিকভাবে ভাঙ্গন প্রতিরোধে বিমানবন্দরের উত্তর পাশে পার্কো পাইন (বাঁশের খাঁচায় ইট ফেলা) তৈরি করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আপতকালীন বরাদ্দ দেয়া হলেও তারা ভাঙ্গণ প্রতিরোধে গড়িমসি করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) জহির উদ্দিন আহমেদ ভাঙ্গনের তীব্রতার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, চলতি মৌসুমে ভাঙ্গন প্রতিরোধে বড় কোন ব্যবস্থা তাদের হাতে নেই। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি পানিসম্পদমন্ত্রী সরেজমিন পরিদর্শন করে ভাঙ্গন প্রতিরোধে এসব এলাকার সমস্যাগুলো প্রকল্প আকারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেমতে জেলায় ২৬টি স্পটকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প আকারে পাঠানো হয়। এরমধ্যে সুগন্ধা নদীর ভাঙ্গনে দোয়ারিকার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু, বরিশাল বিমানবন্দর, মেঘনা সংরক্ষণ বাঁধ, নগরীর বেলতলা ফেরিঘাট, চরবাড়িয়া, উজিরপুরের সাকরাল চতলবাড়ি, হিজলার হরিনাথপুর, মুলাদীর গুদিঘাটা উল্লেখযোগ্য। তিনি আরও জানান, ২৬টি প্রকল্পের অনুকূলে ৪১০ কোটি টাকার বরাদ্দ চাওয়া হলেও তাতে কোন সাড়া মেলেনি। বরং পাঁচটি প্রকল্পে আংশিক বরাদ্দ হিসেবে ১৫ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।
×