ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আকাশছোঁয়া স্বপ্নের টানেল ॥ বদলে যাবে দৃশ্যপট-চট্টগ্রাম হবে টুইন সিটি

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২ জুলাই ২০১৫

আকাশছোঁয়া স্বপ্নের টানেল ॥ বদলে যাবে দৃশ্যপট-চট্টগ্রাম হবে টুইন সিটি

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণে বাংলাদেশ-চীন সরকারী পর্যায়ে বেইজিংয়ে দুদেশের পক্ষে স্বাক্ষরিত চুক্তি চট্টগ্রামের উন্নয়নে দেশের ইতিহাসে একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। দু’লাইন বিশিষ্ট এ টানেল নির্মিত হলে এটিই হবে দেশের প্রথম টানেল। আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটি হবে নতুন প্রাপ্তি। বর্তমান সরকারের দূরদর্শিতা ও উন্নয়নমুখী তৎপরতার অংশ হিসেবে এবং চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ টানেল যখন নির্মিত হয়ে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে তখন চট্টগ্রাম অঞ্চলের দৃশ্যপট বদলে যাবে ভিন্ন আঙ্গিকে। চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের মতে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এ সরকারের উন্নয়ন তৎপরতায় যুক্ত হবে বড় ধরনের একটি অর্জন। কর্ণফুলী দক্ষিণ পাড় এ টানেলের মাধ্যমে সরাসরি সংযুক্ত হওয়ার পর সেই দক্ষিণ এলাকায় গড়ে উঠবে নতুন শহর। যেখানে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি কাফকো, সিইউএফএল (চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড), মেরিন একাডেমি এবং সর্বশেষ কেইপিজেড (কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন)। ইতোমধ্যেই স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানার প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকসন কোম্পানি (সিসিসিসি) এ টানেল নির্মাণ করবে। বাংলাদেশ সেতু বিভাগের পক্ষে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে টানেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল সিসিসিসি ও হংকংয়ের একটি প্রতিষ্ঠান। কর্ণফুলী নদীর ১৫০ ফুট নিচ দিয়ে সাড়ে তিন কিলোমিটারেরও বেশি দৈর্ঘ্যরে দুই লাইন বিশিষ্ট এ টানেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম সম্পন্ন হয় এবং এতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১৪ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে টানেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। চুক্তি অনুযায়ী আগামী নবেম্বরের দিকে এ টানেল নির্মাণের প্রাথমিক পর্ব শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। প্রসঙ্গত, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে সিসিসিসির সঙ্গে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের এমওইউ স্বাক্ষর হয় ২০১৪ সালে। এমওইউ স্বাক্ষরের পর গত জানুয়ারি মাসে চীন সরকার এ প্রকল্প অনুমোদন করে। সে দেশের এক্সিম ব্যাংক এ প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দেয়। সব মিলিয়ে চার শতাংশ সুদ পরিশোধ করবে বাংলাদেশ। এ সুদসহ ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বিশ বছর। চুক্তি অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর উত্তর অংশের অর্থাৎ পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে এ টানেলের শেষপ্রান্ত হবে নদীর দক্ষিণ পাড়ের সিইউএফএল পয়েন্ট পর্যন্ত। চট্টগ্রম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম জানিয়েছেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরে যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে এ টানেল বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে ইতোমধ্যে গড়ে উঠে বিভিন্ন শিল্প কারখানার পণ্য সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ টানেলের ভূমিকা হবে অনন্য সাধারণ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে পতেঙ্গা মেরিন ড্রাইভ দিয়ে এ টানেল সংযুক্ত হয়ে তা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে যুক্ত হবে। যা এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে। কর্ণফুলী নদীর ওপর তৃতীয় সেতু অর্থাৎ শাহ আমানত সেতু পিলার সংবলিত হওয়ায় বর্তমানে এর দুঃখজনক জের টানতে হচ্ছে কর্ণফুলী নদীকে। উজান থেকে আসা প্রতিনিয়ত পলি আটকে যাচ্ছে কর্ণফুলী সেতুর পিলারের সঙ্গে, যা নদীর আয়তন ও গভীরতাকে ক্রমশ হ্রাস করছে। কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর আগে রেল চলাচলের জন্য নির্মিত কালুরঘাট সেতু কয়েক যুগ আগে থেকে কর্ণফুলী নদীর গতিধারাকে ব্যাহত করে আসছে। কিন্তু ওই সময়ে এ সেতু ছাড়া চট্টগ্রামের দক্ষিণ অংশ অর্থাৎ বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার সঙ্গে যোগাযোগের ভিন্ন কোন ব্যবস্থা ছিল না। দীর্ঘ সময় পর নির্মিত হয় কর্ণফুলী দ্বিতীয় সেতু, যেটা ছিল স্টিল স্ট্রাকচারের তৈরি। শাহ আমানত সেতু নির্মিত হওয়ার পর এটি অপসারণ করে নেয়া হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর নাব্যতাকে ধরে রাখতে এবং দক্ষিণাংশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে বর্তমান সরকার এ নদীর ওপর আর কোন ধরনের সেতু নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি এ নিয়ে শুরুতেই মনোযোগ দেয়া হয় টানেলের প্রতি। কিন্তু বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য নেই সরকারের। তাই শুরুতে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। তাতে বেরিয়ে আসে বেশ কয়েকটি পয়েন্ট। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে সিসিসিসির বিশেষজ্ঞরা এসব পয়েন্টের ওপর দীর্ঘ সমীক্ষা চালানোর পর শেষ পর্যন্ত পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি হয়ে অপর প্রান্তে সিইউএফএল পয়েন্ট শেষ প্রান্ত হিসেবে বিবেচনায় আসে এবং তা নিয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট করা হয়। এ সম্ভাব্য রিপোর্ট নিয়ে আরও দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এ টানেল নির্মাণের। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে গেলে সে দেশের পক্ষে এ প্রকল্পে ঋণ সহায়তা ও বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয়া হয়। আর তখন থেকেই বাংলাদেশের প্রথম টানেল নির্মাণের স্বপ্নের জাল বুনা শুরু হয়। বর্তমানে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু হয়ে যে মেরিনড্রাইভ নির্মিত হচ্ছে এবং অপরদিকে সীতাকুন্ড-ফৌজদারহাট থেকে পতেঙ্গা সাগর উপকূলজুড়ে যে লিঙ্ক রোড নির্মাণ কাজ চলছে এর সবই সংযুক্তি ঘটবে এ টানেলের সঙ্গে। উল্লেখ্য, টানেলের সম্ভাব্যতা জরিপ কাজ হয়েছে চউকের অর্থায়নে। বর্তমানে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে সেতু বিভাগের উদ্যোগে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এটি পরিচালিত হবে সওজ বিভাগের মাধ্যমে। ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে, এটি হবে টোল টানেল। অর্থাৎ এ টানেল পারাপারে নির্দিষ্ট অঙ্কের টোল পরিশোধ করতে হবে। তবে এটি কোন বিশেষ ব্যক্তির নামে হবে কিনা তা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী ২০১৮ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এ প্রকল্প বাস্তবায়নের চিন্তা ভাবনা করা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে এগিয়ে গেলে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থায় সূচিত হবে নব দিগন্তের। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে চট্টগ্রাম। দেশের আমদানি ও রফতানির ৯০ শতাংশেরও বেশি পণ্য সমুদ্র পথে পরিবাহিত হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। এছাড়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সরকারী কোষাগারের একক বৃহত অভ্যন্তরীণ রাজস্ব যোগানদাতা। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে এ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস রাজস্ব আদায় করেছে ২৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর পাশাপাশি চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের প্রথম এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন। এছাড়া নৌ বাণিজ্যে চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্টতা এত বৃহত যে, সাগর পথে পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এর সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। স্বপ্নের এ টানেল বাস্তবায়িত হবে এক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রাখবে বলে সংশ্লিষ্ট সেক্টরসমূহের বিশেষজ্ঞ সূত্রসমূহের মত রয়েছে। পতেঙ্গা এলাকায় চট্টগ্রাম বন্দর মালিকানাধীন জমিতে নতুন একটি বে-টার্মিনাল প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের অদূরে এটি হবে ছোট আকৃতির নতুন একটি বন্দর। আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে অব্যাহত অগ্রগতির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ দশ শতাংশেরও বেশি হারে প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। বন্দরে পণ্য আসার পর তা সড়ক পথে বাল্ক আকারে আবার পুরো কন্টেনার লরি ও রেলযোগে চলে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ টানেল নির্মিত হওয়ার পর চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটবে, যা এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে সে দেশের পরিবহন মন্ত্রণালয়ে এ ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বাংলাদেশের পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং চীনের পরিবহনমন্ত্রী ইয়ান চুয়ান তাগ এর উপস্থিতিতে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে সাক্ষর করেন বাংলাদেশের সেতু বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এবং চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কোম্পানির চেয়ারম্যান লিউ কুইতাও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম ফজলুল করিম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক রুহুল আমিন সিদ্দিক, সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমদও চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রসঙ্গত, বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনের পূর্বে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠের জনসভায় শেখ হাসিনা চট্টগ্রামবাসীকে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন। আজ তা বাস্তবায়নের পথে একধাপ এগিয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের বড় ধরনের উন্নয়ন তৎপরতায় অবদান ব্যাপক। এর সঙ্গে চট্টগ্রামে টানেল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তা হবে উল্লেখযোগ্য বড় ধরনের সফলতা। বাংলাদেশ-চীন-ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে কানেক্টিভিটি গড়ার ক্ষেত্রে এ টানেলের গুরুত্ব হবে অপরিসীম।
×