ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজাহান মিয়া

সাংবাদিক মিলন ভাই

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ২৮ জুন ২০১৫

সাংবাদিক মিলন ভাই

কিছুদিন আগে না ফেরার দেশে চলে গেলেন দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতা হাবিবুর রহমান মিলন। হৃদরোগ ও কিডনিতে সমস্যার কারণে গত মাসে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায়ও ফিরেছিলেন। পুরোপুরি সুস্থ না হয়েও মেয়ে অদিতিকে নিয়ে তার সেকেন্ড হোম প্রেসক্লাবেও এসেছিলেন মিলন ভাই। কিন্তু হঠাৎ আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ২ জুন পুনরায় তাকে ল্যাবএইডে ভর্তি করা হয়। কিন্তু এবার আর ফিরে আসা হয়নি তার। ১৩ জুন শনিবার ৮০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার মূর্ত প্রতীক ও ক্ষুরধার লেখনীর অধিকারী এই বরেণ্য সাংবাদিক। পেশার প্রতি অবিচল নিষ্ঠা ও অঙ্গীকার, সীমাহীন সাধনা এবং নিজ সামর্থ্যরে প্রতি দৃঢ় আস্থা এই সাংবাদিককে নিয়ে গিয়েছিল অনেক উচ্চতায়। স্পষ্টবাদিতা ও নির্ভীকতা ছিল মিলন ভাইয়ের চরিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য। ১৯৬৩ সালে দৈনিক সংবাদে সহ-সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করে তিনি দৈনিক পয়গাম, আজাদ ও দৈনিক বাংলায়ও কাজ করেন। ১৯৬৫ সালে সিনিয়র সহ-সম্পাদক হিসেবে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে যোগদান করে প্রায় ৫০ বছর পত্রিকাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইত্তেফাকের উপদেষ্টা সম্পাদক ও প্রেস ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ছিলেন। দীর্ঘ তিন দশক দৈনিক ইত্তেফাকে ‘সন্ধানী’ ছদ্মনামে ‘ঘরে-বাইরে’ শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয় লিখে সাংবাদিকতা পেশার খ্যাতির শিখরে ওঠেন। কিংবদন্তি এই সাংবাদিকের মৃত্যুর মাধ্যমে সাংবাদিক সমাজ একজন অভিভাবক হারাল। শুধু সাংবাদিকতার জগতই নয়, সুবক্তা ও সাহসী সাংবাদিকের মৃত্যু জাতীয় জীবনেও হলো অপূরণীয় ক্ষতি। ২০১২ সালে একুশে পদকপ্রাপ্ত দিকপাল এই সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে পুরো মিডিয়া জগত আচ্ছন্ন হয়ে যায় গভীর শোকের ছায়ায়। ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২৬ দিন সারাদেশের সংবাদপত্রে ঐতিহাসিক ধর্মঘট পালিত হয়। তখন দেশের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পত্রিকা শিল্পে সফল ধর্মঘটের পর ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ বাস্তবায়নসহ অনেক দাবি-দাওয়া আদায় হয়। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদের বোনের মালিকানাধীন দৈনিক জনতা পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইউনিয়নের সঙ্গে বিবাদ লেগেই ছিল। তাই সম্ভবত ১৯৮৫ সালের জুলাই বা আগস্ট মাসে দৈনিক জনতায় আমাদের ধর্মঘট ডাকতে হয়। জোর করে কর্তৃপক্ষ পত্রিকা প্রকাশ করার উদ্যোগ নেয়। ইউনিয়নও গর্জে ওঠে। সিদ্ধান্ত হয় মালিকপক্ষের ষড়যন্ত্র নস্যাত করে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করতে হবে। তখন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী। আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন হাবিবুর রহমান মিলন এবং মহাসচিব ছিলেন সৈয়দ জাফর। দৈনিক জনতার অফিসটি তখন ছিল কমলাপুর বাজার এলাকার মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি বিশাল ভবনে। ইংরেজী দৈনিক মর্নিং সান পত্রিকাটিও একই ভবন থেকে বের হতো। সম্ভবত প্রতিভাধর সাংবাদিক ও দৈনিক মর্নিং সান পত্রিকার মালিক সম্পাদক আনোয়ার ইসলাম ববি ভবনটির মালিক ছিলেন। ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নির্ধারিত দিনে পত্রিকা অফিসে হানা দিতে গিয়ে আমাদের আক্কেলগুড়ুম। কমলাপুর বাজার এলাকাটির চারদিকে কয়েক শ’ পুলিশের প্রহরা। কোনমতে গাড়ি চলাচল করছিল। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি সুকৌশলে অফিস ভবনের সামনে চলে যেতে সমর্থ হয়। ইউনিয়নের আরও অনেক কর্মকর্তা ও সদস্য আগে থেকেই পত্রিকা অফিসের কাছাকাছি অবস্থান করছিল। আমরা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তারা অফিসের সামনে চলে আসে। শুরু হয় অফিসের সামনে অবস্থানকারী পুলিশের সঙ্গে তুমুল বাক-বিত-া। এক পর্যায়ে জোয়ান মর্দ দীর্ঘদেহী এক পুলিশ অফিসার মিলন ভাইয়ের কাঁধে হাত দেয়। আমি ঝটকা টানে তার হাতটি সরিয়ে দিয়ে বলি, ‘জানিস কার গায়ে হাত রেখেছিস?’ এরি মধ্যে পুলিশের আরেক অফিসার তা-ব শুরু করে দেয়। ফাঁক বুঝে আমি এবং দৈনিক অবজারভারে তখন কর্মরত শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব বেলায়েত হোসেন গেরিলা কায়দায় বিদ্যুত গতিতে পত্রিকা অফিসের ভেতরে ঢুকে মাত্র দুই থেকে আড়াই মিনিটের মধ্যে রাখা তখনকার দিনে পত্রিকা প্রকাশের জন্য অপরিহার্য উপাদান পত্রিকার ম্যাটার ভেঙ্গে ফেলে পরের দিন পত্রিকা বের করার অপপ্রয়াস নিশ্চিত বন্ধ করে আমরা বের হয়ে আসি। ঝটিকা বেগে নিচে নেমে ঐ এলাকা ছেড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে একত্রিত হই। পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে কিছু কথাবার্তা বলে আমরা যে যার বাসায় চলে যাই। আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম যে, পুলিশ ঐ রাতে সাংবাদিক নেতাদের ধরতে আসবেই। আমার মনে হয়েছিল যে, এরশাদের বোন ভাইকে (এরশাদ) ফোন করে বলবে সাংবাদিকরা আমার পত্রিকার ম্যাটার ভেঙ্গে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করেছে। সেটা কি হয়েছিল জানি না, তবে মতিঝিল থানার তৎকালীন ওসি আখলাককে রাষ্ট্রপতি এরশাদ নিজে ফোন করেছিলেন সেটা আমি নিশ্চিতভাবেই জেনেছিলাম। এরশাদ আখলাককে ফোন করে ইংরেজীতে বলেছিলেন, ‘পিক দেম আপ’। আমার ধারণা মোতাবেক পুলিশ আমার বাসায়ই আসে প্রথম। রাতে ধরা দিতে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। রাত ২টা পঁয়ত্রিশ মিনিটে পুলিশ আসে। বারান্দায় পায়চারিরত অবস্থায় টের পেয়ে আমি বাসার পাশেই একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করি। ঘরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে না পেয়ে রাগ দেখিয়ে ওরা চলে যায়। আমার কনিষ্ঠ ভাই শাহনেওয়াজ ওদের কথোপকথনে বুঝতে পারে যে, আমাকে না পেয়ে ওরা মিলন ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছে তাকে গ্রেফতার করতে। আমার বাসায় তখন টেলিফোন না থাকায় মিলন ভাইকে জানাতে পারছিলাম না বলে আমার প্রিয় ছোট ভাইটির সে যে কি দুঃখ তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। পুলিশ ঠিকই মিলন ভাইয়ের বাসায় যায় এবং তাকে গভীর রাতে নিয়ে যায় মতিঝিল থানায়। এ খবর ভোর হওয়ার আগেই সংবাদপত্র শিল্পের মানুষের মধ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেসক্লাবে বিপুলসংখ্যক সাংবাদিক, কর্মচারী ও প্রেস শ্রমিক ফেডারেশনের লোকজন জমায়েত হতে শুরু করে। উত্তেজনা ওঠে তুঙ্গে। কারণ প্রেসক্লাব থেকে মিছিল করে গিয়ে মতিঝিল থানায় রাখা মিলন ভাইকে কোর্টে চালান দেয়ার আগেই ওখান থেকে ছিনিয়ে আনতে হবে। মিলন ভাইয়ের গ্রেফতারের পরিণতি সম্পর্কে এরশাদের প্রেস সেক্রেটারি তাজুল ইসলামকে ইকবাল সাহেব সাবধান করেছিলেন। আমরা মিছিল করে মতিঝিল থানায় গিয়ে মিলন ভাইকে কোর্টে চালান দেয়ার আগেই তাকে একরকম জোর করেই প্রেসক্লাবে নিয়ে আসি। মিলন ভাইয়ের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে শেষ করছি। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
×