ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক রিপোর্ট

বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৭ জুন ২০১৫

বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এছাড়া এখানে প্রগতিশীল সুশীল নাগরিকের উপস্থিতি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, মত প্রকাশের সীমাবদ্ধতা, দুর্বল শ্রম অধিকারই বাংলাদেশের প্রধান মানবাধিকার সমস্যা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রকাশিত ২০১৪ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে প্রণীত আইনানুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রতিবছর সারা বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিবরণ দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এই মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদন প্রকাশকালে জন কেরি বলেন, যখন কোন দেশের নাগরিকরা তাদের প্রাপ্য অধিকার ও স্বাধীনতা পরিপূর্ণভাবে ভোগ করতে পারে, তখনই দেশটি ভাল থাকে। সন্ত্রাসবাদ এবং সংঘাত-সহিংসতা বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকারের জন্য প্রধান হুমকি। মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশের সময় প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাব দেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী টম ম্যালিনাস্কি। টম ম্যালিনাস্কি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের সব মহলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার জন্য রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক সহিংসতার মাধ্যমে জনজীবন বিপর্যস্ত করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র শক্তভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে ৩৫ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে গত সংসদীয় নির্বাচন, নির্বাচন বর্জন এবং পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচীতে সহিংসতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন নিয়ে অধিকাংশ আন্তর্জাতিক পরিদর্শকের সমালোচনার কথাও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এছাড়া ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিবরণ, অনলাইনে মত প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপসহ সভা-সমাবেশে বাধা প্রদান, সরকারের অস্বচ্ছতার কথাও উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে গুম হয়েছে প্রায় ৮০ জন। ২০১৩ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৫৩ জন। ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং গতিশীল সুশীল নাগরিকদের দেশ হিসেবে উল্লেখ করে মানবাধিকারের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া নিরাপত্তাকর্মীদের নির্যাতনসহ ক্ষমতার অন্যান্য অপব্যবহার, বিস্তৃত দুর্নীতি, দুর্বল বিচার ব্যবস্থা, বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতার কথাও উঠে আসে তাদের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান মানবাধিকার সমস্যা। কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা এনজিওগুলোও বাংলাদেশে তাদের কাজের ক্ষেত্রে বিশেষ সমস্যার মুখোমুখি হয়। এদেশে নারীরাও তীব্র বৈষম্যের শিকার। অনেক শিশুকেই জোর করে কাজে বাধ্য করা হয়। কেউ কেউ টাকার প্রয়োজনে কাজ করে আবার কোন কোন শিশু মানবপাচারকারীদের কবলে পড়ে এই সমস্যার মুখোমুখি হয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে মানবাধিকার বিষয়ক এই প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনে বলা সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ, অনলাইনে মত প্রকাশের সীমাবদ্ধতাসহ দুর্বল শ্রম অধিকার এবং নিম্নমানের কর্ম পরিবেশকেও বাংলাদেশের মানবাধিকার সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেদনে নারী ও সংখ্যালঘুদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনে কোন বাধা নেই বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০০ ও সংরক্ষিত ৫০ আসনে নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারে। সংসদে ৭০ নারী সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে ২০ নারী সরাসরি ও ৫০ নারী সংরক্ষিত আসনে জয়লাভ করেছেন। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা, জাতীয় সংসদ উপনেতা ও দুজন নারী মন্ত্রী রয়েছেন। এছাড়া জাতীয় সংসদের স্পীকার নারী। তবে সংখ্যালঘুদের জন্য কোন সংরক্ষিত আসন নেই। ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে বিএনপির এখন সংসদে কোন আসন নেই। সরকারীভাবে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদে আসন ৩৬টি। আর ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৩৫টি আসন রয়েছে। এছাড়া সংসদে অন্যান্য বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের আসন রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী প্রকাশকালে কোন কোন সময় সরকার হস্তক্ষেপ করেছে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যে আপীল করা হয়েছিল, আদালত সেটা খারিজ করে দিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ১৬তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ অন্যান্য কমিশনের অধিকার খর্ব করেছে। এ বিষয়ে সুশীল সমাজের লোকেরা মনে করেন, সরকার দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিয়ে এই সংস্থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চায়। বাংলাদেশের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল মনে করে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি নখদন্তহীন বাঘ। এছাড়া পদ্মা সেতুর দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন যে চার্জশীট দিয়েছে সেখানে কাউকেই দোষী বলে চিহ্নিত করা হয়নি বলেও সমালোচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’এর বিষয়ে বলা হয়, অধিকারের সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান ও চেয়ারম্যান নাসিরুদ্দিনকে উচ্চ আদালত জামিন দিয়েছে। তবে সংস্থাটি বিদেশী অর্থসহায়তা পেতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এছাড়া অধিকারের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় তাদের সকল কার্যক্রম সরকার নজরদারি করছে। প্রতিবেদনে শিক্ষা অধিকারের বিষয়ে বলা হয়েছে, পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। এছাড়া দশম শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েদের জন্য তার পরিবারকে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। যদিও অনেক পরিবারই শিক্ষকদের বেতন ও ইউনিফর্ম যোগান দিতে আর্থিক সমস্যায় পড়েন। সরকার তিন কোটি ১৮ লাখ বই বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। এছাড়া সরকার শিক্ষা বিকাশের জন্য প্রাধ্যান্য দিচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের বিষয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। এসব হামলা অর্থনৈতিক অথবা রাজনৈতিক কারণে হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, বছরের প্রথম সাত মাসে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭১৯টি বাড়ি, ১৮২টি দোকানপাট, ১৬৪টি মন্দির ভাঙচুর করা হয়। মারা যান একজন। আর আহত হন ১৯৩ জন। যশোরের মালোপাড়ায় হামলাসহ বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে।
×