ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষায় মূসক ॥ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৩ জুন ২০১৫

শিক্ষায় মূসক ॥ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা

এবারের বাজেটে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর ১০% মূসক ধার্য করা হয়েছে। বাজেট পাশ হওয়ার আগেই বিগত ০৪/০৬/২০১৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে এই কর কার্যকর করা হয়েছে। অর্থাৎ উপরিউক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার্থীদের জুন মাসে প্রদত্ত ফিসে ১০% হারে কর দিতে হবে। ২০১০ সালে ৪.৫ হারে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ওপর এমনি কর ধার্য করায় বেশ ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ ও ভাংচুরের সূচনা করে। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ তুলে নেয়। তারপর অবশ্য ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের ওপর কর ৭.৫ শতাংশ চালু করা হয়, যা এবারে ১০ ভাগে উন্নীত করা হয়েছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের উদাহরণ টেনে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষার্থীদের ওপর মূসক ধার্য করাটা কতটা সঙ্গত ও বিবেচনা প্রসূত হয়েছে, তা সময়ই বলবে। তবে উদ্যোক্তারা এমন কর ধার্যকরণকে স্থিতিশীলতা বিনষ্ট ও রাজনৈতিক নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্যে সরকারের অভ্যন্তরে অদৃশ্য এক সরকারকে দায়ী করছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাগণ এই মূসককে বোঝার ওপর শাকের আঁটি, মরার ওপর খাড়ার ঘা কিংবা গোদের ওপর বিষফোঁড়া বলে অভিহিত করেছেন এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে এফবিসিসিআই এই অযৌক্তিক, বৈষম্যমূলক ও স্থিতিবিনষ্টকারী মূসক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। এই কর প্রায় ৮৪টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় একশত ষাটটি কলেজের ওপর আরোপিত হলো, যা ৫ লক্ষ শিক্ষার্থীকে করাক্রান্ত ও ভারাক্রান্ত করবে। প্রচলিত মিথের বিপরীতে সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য হচ্ছে যে, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজে শুধুমাত্র ধনাঢ্যদের সন্তানরা পড়াশোনা করে না। সরকারী প্রতিষ্ঠানে আসন সঙ্কটের কারণে বিত্তশালী বা নিশ্ববিত্তের মেধাবী সন্তানরা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যাল কলেজে বাধ্য হয়ে ভর্তি হয়। এমনিতে শিক্ষার ব্যয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে অধিক আর অধিক ব্যয়ের পর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার ন্যায় মূসক আরোপিত হওয়ায় অনেকেই চোখে অন্ধকার দেখবে। এখন বেসরকারী এসব প্রতিষ্ঠান গ্রামেগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানের বিকল্প হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। সে কারণে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পড়াশুনার দায়িত্ব থেকে সরকার বেঁচে গিয়েছে। শিক্ষায় বাজেটের অর্থ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রী লেভেলে শিক্ষার্থীদের জন্যে বিভিন্ন খাতে ব্যয় করছে। সরকারকে যদি এ দায় ভার গ্রহণ করতে হতো তাহলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য ১০৬৬৬.৮ বিলিয়ন অর্থ ব্যয় করতে হতো। তাই নূন আনতে গিয়ে পান্তা ফুরাতো। এক অর্থে শিক্ষায় অভূতপূর্ব গতিশীলতা ও অর্জনের অন্যতম ক্রিয়াশীল চলক হচ্ছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় খাত। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের স্থিতি অন্তত ১২ বিলিয়ন কমে যেত কেননা বিত্তশালীদের সন্তানরা এ অর্থ নিয়ে বিদেশী নি¤œমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ারেও অতীতের ন্যায় হানা দিত। তাই বেসরকারী শিক্ষায়তনগুলো শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সঙ্কট মুক্ত করেনি; সেগুলো দেশে প্রচলিত সেশন জটের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করছে। পৃথিবীর অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের ন্যায় সুদীর্ঘকাল করমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল এবং বলা যায় এখনও আছে। কেবলমাত্র সাইফুর রহমান সাহেব অর্থমন্ত্রী হয়ে গত শতাব্দীর শেষ ভাগে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বৃত্ত আয়ের ওপর প্রথমে ৪০ ভাগ এবং পরে আন্দোলনের মুখে ১৫ ভাগ আয়কর ধার্য করেন। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিক্যাল শিক্ষা এ করের আওতার বাইরে ছিল। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর কালে উদ্বৃত্ত আয়ের ওপর সংশোধিত আকারে ১৫ ভাগ করের ভার মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায়ও সম্প্রসারিত করা হয়। ব্যক্তিগতভাবে অর্থমন্ত্রী বরাবরই শিক্ষায় করের বিরোধিতা করেছেন। তারপরও তিনিই শিক্ষায় করের হার পূর্বরত রেখে কর ও ভ্যাটের পরিধি বিস্তৃত করেছেন। তার আমলে ক’একটি ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন ছাড়াও বাড়ি ভাড়া, প্রিন্টিং-স্টেশনারি, বিজ্ঞাপন, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও ল্যাব সামগ্রীর ওপর উৎসে করসহ শতকরা ৯ ভাগ থেকে ১৫ ভাগ পর্যন্ত মূসক আরোপ করা হয়। ২০১৫-২০১৬ সালের বাজেটে উৎসে এসব কর ৩ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৫ ভাগ করা হয়েছে এবং অতীতের স্তরভিত্তিক হার সম্পূর্ণ বিলোপ করা হয়েছে। এসব করারোপের কারণে অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্যে জমি ক্রয়ে ব্যর্থ হয়। যারা কায়ক্লেশে জমি ক্রয়ে সমর্থ হয়েছে, তারা আবার ক্যাম্পাস নির্মাণে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্য একটি কারণেও জমি ক্রয় ও ক্যাম্পাস নির্মাণ বিলম্বিত হচ্ছে। ২০১০ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ কিংবা স্থায়ী আমানত বন্ধক রেখে উদ্যোক্তাগণ ঋণ গ্রহণে অসমর্থ। আইনে বলা হয়েছে, উদ্যোক্তারা নিজস্ব উৎস থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অর্থায়ন করবেন। ধারণা করা হয়েছিল যে, এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল উপার্জন কর মুক্ত হবে। আইনে এমন একটি ধারা প্রথমে সংযোজিত থাকলেও, শেষকালে কার পরামর্শে এমন একটি ধারা পরিহার করে আইনটি প্রণীত হয়, তা অজানা রয়ে গেছে। তবে সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো যে, আইনটির একটি ধারায় এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠানই রাখা হয় এবং তার আয় কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট করা আছে। ২০১০ সালের আইনের আর একটি ধারায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার দায়িত্ব ১৮৮২ সালের আইন দ্বারা সৃষ্ট ট্রাস্টের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। ট্রাস্ট আইনে ট্রাস্টের সকল উপার্জন সকল প্রকার আয়কর মুক্ত বিধায় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর যে কোন করারোপ অযৌক্তিক ও অবৈধ। তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্বৃত্ত আয় ডিভিড্যান্ড আকারে উদ্যোক্তরা নেন না। এই দৃষ্টিকোণ থেকেও উদ্বৃত্তের ওপর করারোপ আইনত অসিদ্ধ। এসব অবৈধ পদক্ষেপের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংযোজনকে গোদের ওপর বিষফোঁড়া বললে কি অন্যায় বলা হবে? দেশে দক্ষ মানব-সম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষাখাতে যেখানে সরকারের ভর্তুকি দেয়াটা যুক্তিসঙ্গত এবং সরকারীখাতে তা দেয়াও হয়; সেখানে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর যে কোন প্রকার করারোপ নিম্নোক্ত কারণে যুক্তিহীন, বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক ঃ ১) ২০১০ সালের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করা বা এগুলোর ওপর কর বা ভ্যাট আরোপের কোন অবকাশ নেই। ২) আরোপিত কর ও ভ্যাট প্রকৃতপক্ষে যারা নিজেদের শিক্ষার ব্যয় নিজে বহন করছেন তাদের ওপরেই অতিরিক্ত বোঝা চাপানোর চেষ্টা এবং ব্যক্তিগত অধিকারের পরিপন্থী। ৩) বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি যদি ভ্যাটযোগ্য হয় তাহলে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কর্তৃক মূল্য সংযোজনও ভ্যাটযোগ্য। অন্যথায় বেসরকারী শিক্ষায় ভ্যাট আরোপ নাগরিকদের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ এবং দেশের সংবিধানের পরিপন্থী। ৪) আরোপিত ভ্যাট বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ব্যয় ভার বহনের কৌশল হিসেবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে প্রতীয়মান হওয়ার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। ৫) সর্বোপরি এই বৈষম্যমূলক ভ্যাট বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করবে এবং আন্দোলন করার সাংবিধানিক অধিকার প্রদান করবে। ৬) বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ না থাকলে সরকারের শিক্ষাবৃত্তি কর্মসূচীসহ প্রতিমাসে শিক্ষকের বেতন ও কিছু শিক্ষাকে জাতীয়করণ অসম্ভব হতো। এই বিবেচনায় বেসরকারী সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো ভর্তুকির ন্যায্য দাবিদার। যে সমস্ত দেশে উচ্চ শিক্ষার হার ৪০% এরও বেশি সেসব দেশেও সরকার বেসরকারী খাতে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তুকি প্রদান করে। বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার হার মাত্র ১০.৬% এবং ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে তার উন্নয়ন নিরুৎসাহিত করা সম্পূর্ণ বিবেক বহির্ভূত এবং উন্নয়নের টুঁটি চেপে ধরার সামিল। করারোপ ছাড়াও সরকার অপর একটি কাজ করেছে। নীতি হিসেবে ভ্যাটের সংগ্রাহক ও কোষাগারে জমা দেয়ার দায়িত্ব পণ্য কিংবা সেবা বিক্রেতার। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ফি-এর ওপর মূসক সংগ্রহ ও আয়কর প্রদানের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেয়া হয়েছে। এটা ভ্যাট ও করনীতি মোতাবেক হলেও বাড়িওয়ালা, বিজ্ঞাপন প্রচারক, প্রিন্টিং ও স্টেশনারি বিক্রেতা ও ল্যাব সামগ্রী বিক্রেতাকে যেখানে মূসক সংগ্রহ করে সরকারী কোষাগারে জমা দেয়ার কথা, সেখানে দায়িত্বটা দেয়া হয়েছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়কে। ফলত বহিরারোপিত সঙ্ঘাত শিক্ষায়তনগুলোকে গ্রাস করে সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সরকার একদিকে শিক্ষাকে অবাণিজ্যিক সেবা বলছে, আবার শিক্ষাকে বিভিন্ন কর-এ জর্জরিত করে বাণিজ্যিক পণ্যের মতো ব্যবহার করে দ্বৈততার নীতি অনুসরণ করছে। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জয়েন্টভেঞ্চার ও শাখা ক্যম্পাসকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারের এসব দ্বৈততা ও সিদ্ধান্তহীনতা শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে সহায়ক হবে বলে মনে করার কারণ আছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা মনে করেন যে, শিক্ষার ওপর সকল প্রকারের কর অবিলম্বে পরিহার করা হোক। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে ভর্তুকি দেয়া হোক, তাদের জন্যে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হোক, হরতাল ও নৈরাজ্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ও অনার্থিক সুবিধাদি দেয়া হোক এবং দুর্মূল্যের বাজারে জমি ক্রয়ে সহায়তা দেয়া হোক। লেখক : শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা
×