ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সারাদেশে দেড় লাখ অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২১ জুন ২০১৫

সারাদেশে দেড় লাখ অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার

নিখিল মানখিন ॥ দেশের অবৈধ ও প্রশ্নবিদ্ধ সকল বেসরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার। অনুমোদনপ্রাপ্ত সেন্টারসমূহের তালিকা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তালিকা তৈরির কাজ শেষ হলেই অবৈধ ও প্রশ্নবিদ্ধ সেন্টারসমূহের বিরুদ্ধে সারাদেশে একযোগে অভিযান চালাবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশজুড়ে অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি। অধিকাংশ সেন্টারের নেই সরকারী অনুমোদন। কোথাও কোথাও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে সাজিয়ে বসেছে হাসপাতালের ব্যবসা। ভর্তি করা হয় রোগী। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। এমন ফাঁদে পড়ে নানা হয়রানি শিকার হয়ে আসছে অনেক রোগী। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই, হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব সেন্টার থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারী হাসপাতালের একশ্রেণীর ডাক্তারদের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। ডায়াগনস্টিক প্রতারণার শিকার মানুষজন। বার বার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না। অভিযোগ উঠেছে, কমিশনের লোভে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বেশিরভাগ সরকারী হাসপাতালের প্যাথলজিক্যাল বিভাগটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেয়া হয় না। এখানে সবচেয়ে দামী দামী আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলেও অজ্ঞাত কারণে দ্রুততম সময়েই সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারী অনুমোদন নেয়ারও প্রয়োজনবোধ করে না। কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবেদন পাঠিয়েই বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রোগ নিরাময় কেন্দ্র খুলে বসেছেন। ভুঁইফোড় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল বিভাগটি বরাবরই চরম উদাসীন। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রও নেয়নি অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার। প্রতিনিয়ত রক্ত মিশ্রিত ব্যান্ডেজ, মাংসের টুকরা, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ও অন্যান্য আবর্জনা ফেলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের আশপাশে, খোলাস্থানেই। নিয়ম অনুযায়ী এগুলো ইনসিনেটরে পোড়ানোর কথা। এসব বর্জ্য থেকে সিরিঞ্জসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ধুয়েমুছে আবার ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ঘটছে। অপরদিকে এই বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে খোলা জায়গায় ফেলে রাখার কারণে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত সিøপে টিক মার্ক দিয়ে দেন কোন কোন টেস্ট করাতে হবে। রোগী তার পছন্দমতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে ডাক্তার সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। ওই সেন্টার তাকে কমিশন দেয়। কমিশন নিশ্চিত হলে পরেই চিকিৎসা। পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছে মাফিক টাকা-পয়সা আদায় করা হচ্ছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। নিয়ম আছে রেট চার্ট স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়ার মতো স্থানে লাগিয়ে রাখার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে বৈধ লাইসেন্সে মাত্র সাত হাজার ৬০০ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং ছয় হাজার ৮৬৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় দেড় লাখ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাসেবার নামে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য। শুধু রাজধানীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ৪০৫টি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ৬৬০টি। কিন্তু বাস্তবে রাজধানীতে রয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কাঁচামাল ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মাছ ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক বনে গেছেন। তাদের কাছে আধুনিক চিকিৎসাসেবার কোন গুরুত্ব নেই, আছে শুধু লাভের ফন্দিফিকির। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ দীন মোহাম্মদ জানান, রাজধানীসহ সারাদেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তালিকা তৈরির কাজ চলছে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান মহাপরিচালক। হাতুড়ে টেকনিশিয়ান : এসব প্রতিষ্ঠানের সামনে সুপরিচিত ডাক্তার বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ তালিকাযুক্ত বিরাট মাপের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হলেও সরেজমিন গিয়ে তাদের কাউকে পাওয়া যায় না। জানা যায়, রোগী আকর্ষণের জন্যই শুধু বিশেষজ্ঞদের নাম সাইনবোর্ডে লেখা হয় এবং নাম ব্যবহার বাবদ মাসিক ফি দেয়া হয় তাদের।
×