ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নেপথ্য কথা

পরেশ বড়ুয়ার দেহরক্ষী- বাংলাদেশে জঙ্গী কানেকশন!

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২১ জুন ২০১৫

পরেশ বড়ুয়ার দেহরক্ষী- বাংলাদেশে জঙ্গী কানেকশন!

শংকর কুমার দে ॥ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসমের (উলফা) সামরিক শাখার প্রধান পরেশ বড়ুয়ার দেহরক্ষী বাংলাদেশের হরকত-উল জিহাদের (হুজি) দুই সদস্যকে যেভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার নেপথ্য কাহিনী বের হয়ে এসেছে গোয়েন্দা তদন্তে। গোয়েন্দা নথি অনুযায়ী, বনানীর তৎকালীন হাওয়া ভবনের কর্ণধার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ডিল ও ঘনিষ্ঠতার সুবাদে পরেশ বড়ুয়া বাংলাদেশের দুই জঙ্গীর দেহরক্ষী নিয়োগ পেতে সমর্থ হয়েছে। তারেক রহমান ও পরেশ বড়ুয়া-দু’জনই চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলার মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি। বাংলাদেশের দুই হুজি জঙ্গী উলফার সামরিক প্রধান পরেশ বড়য়ার দেহরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত থাকার খবরে তোলপাড় শুরু হয়েছে গোয়েন্দা মহলে। গোয়েন্দা সংস্থার নথির তথ্যে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান আসার আগে হাওয়া ভবনে বৈঠক হয়েছে। হাওয়া ভবনে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসমের (উলফা) সামরিক শাখা প্রধান পরেশ বড়ুয়া। এই বৈঠকের কথা জানতেন বলে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানে সহযোগিতা করেছেন যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক শিল্পমন্ত্রী নিজামী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। মামলায় অন্যতম আসামিও তারা। সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছেÑ এই বৈঠকের সাক্ষী হচ্ছেন চট্টগ্রাম ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান খালাসের দায়িত্বে থাকা হাফিজুর রহমান। হাফিজুর রহমানকে হাওয়া ভবনের কাছে রাখা একটি গাড়িতে বসিয়ে রেখে পরেশ বড়ুয়া গিয়েছিলেন হাওয়া ভবনে। উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়ার হাওয়া ভবনের বৈঠকের অংশ নেয়ার বিষয়ে সহযোগিতা করেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার সাহাবউদ্দিন। প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে হাওয়া ভবনে তাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম ইউরিয়া সারকারখানার ঘাটে চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান আটকের পর তখন প্রকৃত ঘটনাটি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ক্ষমতায় থাকাকালে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হলেও পরবর্তীতে তদন্তে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, তখন চীন থেকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য এই অস্ত্রের চোরাচালান আনা হয়। বাংলাদেশে এই অস্ত্র খালাস করার পর তাদের হাতে তুলে দেয়ার কথা ছিল। চট্টগ্রামে অস্ত্রের চোরাচালানটি আসার পর উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে উলফার আরেক নেতা এ্যান্টনি শিমর উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রাম ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় যুদ্ধাপরাধী সাবেক মন্ত্রী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গোয়েন্দা তদন্তে জানা যায়, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার একদিকে জঙ্গী গোষ্ঠী আরেক দিকে ভারতের বিচ্ছিনতাবাদী সংগঠন উলফার ব্যাপক তৎপরতা বেড়ে গিয়ে বাংলাদেশের মাটি সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। ভারতের উলফার যত কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছে তখন বাংলাদেশের মাটিতে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবাইকে নিয়ে তারা বসবাস, পড়াশোনাসহ সবকিছুই করেছেন। অপরদিকে জঙ্গী সংগঠন জেএমবি, হুজি, হিযবুতসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের তৎপরতা এতই বেড়ে যায় যে, বাংলাদেশের ৩৬৪ জেলার মধ্যে ৩৬৩ জেলায় একযোগে বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে জঙ্গী গোষ্ঠী। মূলত এই সময়টাতেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সহায়তায় উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া তার দেহরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশের দুই জঙ্গী সদস্যকে নিয়োগ পেতে সক্ষম হন। পরেশ বড়ুয়ার দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করছেন আলমগীর হোসেন ও তার আত্মীয় গোলাম নবী। তারা দুজনই নোয়াখালীর করাতখিল গ্রামের বাসিন্দা। পাসপোর্ট অনুযায়ী দুজনেরই বয়স ২৯ বছর। তাদের পাসপোর্ট নম্বর হলোÑ এএ৮৩৯২২৬৪ এবং এএ১৪৬৩৪৪৮। হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের এই দুই জঙ্গী আলমগীর ও গোলাম নবী চীন-মিয়ানমার সীমান্তের রুইলি ঘাঁটিতে পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে থাকেন, তার খাবারও রান্না করে দেন তারা। পরেশ বড়ুয়ার দেহরক্ষী বাংলাদেশের দুই জঙ্গীর নাম পরিচয় ঠিকানা প্রকাশের পর তদন্ত শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর পরেশ বড়ুয়াসহ উলফা নেতারা বাংলাদেশের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান ধরা পড়া ছাড়াও বহু অস্ত্র গোলাবারুদ গোপনে বাংলাদেশের মাটিতে আনা হয়েছে, যা এখনও মাঝে মধ্যেই উদ্ধার হচ্ছে। তখনকার বিএনপি-জামায়াত সরকারের মদদে উলফার সঙ্গে জঙ্গী কানেকশন হয়। ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে মিসর দূতাবাসের কাছে থাকার সময় পরেশ বড়ুয়া তখনই হুজির দুই জঙ্গী আলমগীর হোসেন ও গোলাম নবীকে দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ পান, এখনও তারা বহাল তবিয়তে আছে বিদেশের মাটিতে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উলফার ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়াসহ উলফা নেতৃবৃন্দকে স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। বর্তমানে চীন, মিয়ানমারের গভীর অরণ্যে ঘেরা অঞ্চলে অবস্থান বদলকারী পরেশ বড়ুয়া বাংলাদেশ এবং ভারত-দুই দেশেরই মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি।
×