ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পোশাক শিল্পের গলার কাঁটা ॥ হঠাৎ গজানো শ্রমিক নেতা, ইউনিয়ন ও বিদেশী পরিদর্শক

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৮ জুন ২০১৫

পোশাক শিল্পের গলার কাঁটা ॥ হঠাৎ গজানো শ্রমিক নেতা, ইউনিয়ন ও বিদেশী পরিদর্শক

রহিম শেখ ॥ দিন দিন পোশাক শিল্পে গলার কাঁটায় পরিণত হচ্ছে নামে-বেনামে শত শত ‘ট্রেড ইউনিয়ন’। নিরাপত্তার ও অধিকারের নামে শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা হলেও এখন সুবিধা আদায়ে বেশি ব্যস্ত ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা। যেন হঠাৎ করেই দ্রুতগতিতে বাড়ছে এ শিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা। গত দুই বছরে অন্তত ৩শ’টি ট্রেড ইউনিয়ন নতুন নিবন্ধিত হয়েছে। অথচ দুই বছর আগে মাত্র ২টি ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধিত হয়। আরও অন্তত ৩শ’টি নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এসব শ্রমিক সংগঠনের শ্রমিক নেতারাও জীবনে একটি দিনের জন্যও কখনও কারখানায় কাজ করেননি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পোশাক শিল্পশ্রমিক সংগঠনের ৫৬ শীর্ষ নেতার কেউ-ই শ্রমিক নন। এঁদের মধ্যে ৪১ শ্রমিক নেতা জীবনে কোনদিনই পোশাক শিল্পশ্রমিক ছিলেন না। এ খাতের সঙ্গে জড়িত শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, নিরাপত্তার ও অধিকারের নামে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা হলেও এসব সংগঠনের অপতৎপরতায় বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক গার্মেন্টস কারখানা। জানা গেছে, বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক পণ্য রফতানিকারক হিসেবে বাংলাদেশ এখন এক নম্বর স্থান দখলের চেষ্টা করছে। এর সঙ্গে টার্গেট- বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রফতানি। এমন সাহসী উদ্যোগ নিয়ে যখন এগোচ্ছে বাংলাদেশ, তখন শ্রমিকদের নিরাপত্তা ইস্যুতে বিদেশী ক্রেতাদের পরিদর্শনের নামে বন্ধ করা হচ্ছে গার্মেন্টস কারখানা। গত দুই বছরে ৩২টি কারখানা তাদের অপতৎপরতায় বন্ধ হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক গার্মেন্টস মালিক অভিযোগ করছেন, কিছু শ্রমিক সংগঠনের এই কাজে সরাসরি ইন্ধন দিচ্ছেন। এতে মালিকদের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সরকারী কল-কারখানা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন জিএসপি ফিরে পাওয়ার ১৯ শর্তের অন্যতম প্রধান এ শর্ত পূরণে ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ খাতে মোট ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪২৫টি। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩২টি। মার্কিন শর্তানুযায়ী, ২০১৩ সালের জুলাইতে শ্রম আইন সংশোধনের পর ওই বছরের বাকি ছয় মাসে নতুন নিবন্ধন হয়েছে ৮৩টি। ২০১৪ সালে নিবন্ধিত হয় ১৮৭টি এবং চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ২৩টি ইউনিয়ন নিবন্ধিত হয়েছে। আওয়াজ ফাউন্ডেশন নামে এমনি একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার। তিনি বিদেশী বিভিন্ন দাতা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছেন। সম্প্রতি এই সংগঠনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবত জিম্মি অবস্থায় ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে বলে এমন একটি অভিযোগ তুলেছেন জিন্স কেয়ার নামের গার্মেন্টস কোম্পানির কর্মকর্তারা। ওই কোম্পানির দাবি, তাদের কারখানায় ১৪-১৫ জন শ্রমিকদের নিয়ে আওয়াজ ফাউন্ডেশন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন দাবি আদায়ের অজুহাতে কারখানা বন্ধ করার জন্য তাদের শ্রমিকদের ইন্ধন দিচ্ছে আওয়াজ ফাউন্ডেশন। এ প্রসঙ্গে জিন্স কেয়ার কোম্পানির প্রশাসনিক কর্মকর্তা বদরুল হক জানান, প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে ব্যবস্থাপনা পরিচালককেও প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে আওয়াজ ফাউন্ডেশন। এ ব্যাপারে আওয়াজ ফাউন্ডেশনের কর্ণধার নাজমা আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শত শত শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের কেউ করছেন ওকালতি, কেউ নিয়োজিত ডাক্তারি পেশায়। আবার কেউ করছেন কনসাল্ট্যান্সি। পোশাক শিল্পশ্রমিক হিসেবে জীবনে একটি দিনের জন্যও কখনও কাজ করেননি তাঁরা। তবে এখন তাঁরা তাঁদের নিজস্ব পেশাগত পরিচয়ের গ-ি পেরিয়ে একজন পোশাক শিল্পশ্রমিক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। আর এসব অশ্রমিকই নিয়ন্ত্রণ করছেন পোশাক শিল্পশ্রমিক আন্দোলন। পোশাক শিল্পশ্রমিক সংগঠনের ৫৬ শীর্ষ নেতার কেউ-ই শ্রমিক নন। এঁদের মধ্যে ৪১ শ্রমিক নেতা জীবনে কোনদিনই পোশাক শিল্পশ্রমিক ছিলেন না। অপরদিকে ১৫ নেতা এক সময়ে পোশাক শিল্পশ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে এখন তাঁরা কেউ-ই শ্রমিক নন। অথচ এসব নেতা শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতো শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এত ট্রেড ইউনিয়ন দিয়ে কি হবে আমি বুঝি না। কম্বোডিয়ায় আমরা দেখেছি বেশি বেশি ট্রেড ইউনিয়নের অনুমতি দেয়ার কারণে সেখানকার গার্মেন্ট সেক্টরে বিপর্যয় নেমে এসেছে। যেভাবে শ্রমিক সংগঠন বাড়ছে তাতে বাংলাদেশেও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তিনি বলেন, আমি প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর দেখেছি যে সব গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে চায়। কিন্তু তাদের অনেকেরই ট্রেড ইউনিয়ন আইন সম্পর্কে জানা নেই। বেশি হারে ট্রেড ইউনিয়ন শিল্পে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, শ্রমিক ইউনিয়ন পোশাক খাতের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বাংলাদেশ গার্মেন্ট এ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, পোশাক শিল্প শ্রমিক নেতাদের শ্রমিক হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। পোশাক শিল্প শ্রমিক হয়ে নেতৃত্ব দিলে শ্রমিকদের প্রতি দরদ থাকবে। আর অ-শ্রমিক হয়ে নেতৃত্ব দিলে শ্রমিকদের প্রতি দরদ থাকবে না। তিনি বলেন, শুধু পোশাক শিল্প শ্রমিকদেরই এই খাতের নেতৃত্বে আসা প্রয়োজন। আর সেটা না হলো এ শিল্পের শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা সম্ভব নয়। জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার জনকণ্ঠকে বলেন, শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি শিল্পের সুরক্ষায় সব সময় সচেতন ইউনিয়নগুলো। তবে আমরা কারখানা বন্ধের পক্ষে নই বলে তিনি দাবি করেন। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, শ্রমিক রাজনীতিকে বিদেশী মদদপুষ্ট সুবিধাবাদী ধারা এবং হঠকারী ধারায় আটকে আছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে শ্রমিকদের স্বার্থ আদায় নিশ্চিত হবে না। পোশাক শিল্পের শ্রমিক হিসেবে কখনও কাজ না করেই এখন একজন শ্রমিক নেতা হিসেবে কেন কাজ করছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক তপন সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, বেশিরভাগ পোশাক শিল্পশ্রমিক লেখাপড়া কম জানেন। অপরদিকে মালিকপক্ষ অনেক বেশি শিক্ষিত। সে কারণে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলার মতো মেধা তাদের (শ্রমিক) নেই। সে কারণে শ্রমিকদের পক্ষে লড়াই করতেই শ্রমিক নেতা হয়েছি। দেশের যে কোন নাগরিক শ্রমিকদের পক্ষে কাজ করতে পারেন। বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি হেলেনা বেগম ও সাধারণ সম্পাদক জাহানারা বেগম। হেলেনা বেগম এক সময় শ্রমিক ছিলেন। তবে এখন আর শ্রমিক নন। আর জাহানারা বেগম কখনই শ্রমিক ছিলেন না। শ্রমিক না হয়েও কেন শ্রমিক আন্দোলন করছেনÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে জাহানারা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত রয়েছি। শ্রমিকদের পাশে রয়েছি। এটা তো দোষের নয়।
×