ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাণিজ্য ও যোগাযোগের নতুন অধ্যায়

থিম্পুতে চুক্তি হলো-সড়ক ও আন্তঃ আঞ্চলিক সম্পর্কের নয়া দিগন্ত

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৬ জুন ২০১৫

থিম্পুতে চুক্তি হলো-সড়ক ও আন্তঃ আঞ্চলিক সম্পর্কের নয়া দিগন্ত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নিজের গাড়িতেই বেড়ানো যাবে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানে। এসব দেশসমূহের মধ্যে চলবে পণ্যবাহী যান ও যাত্রীবাহী বাস। এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে আগামী অক্টোবরে এই চার দেশের মধ্যে গাড়ির শোভাযাত্রা হবে। আগামী বছরের শুরুতে যান চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এমন আশার বাণী শুনিয়েই চার দেশের মন্ত্রীরা স্বাক্ষর করলেন বহু প্রতীক্ষিত মোটরযান রূপরেখা চুক্তিতে। এর মধ্য দিয়েই উন্মোচিত হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনার দ্বার। সোমবার ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে চোরতেনলাম সড়কের পাঁচতারকা হোটেল লা মেরিডিয়ানের বেজমেন্টের কনফারেন্স হলে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে চার দেশের মধ্যে আঞ্চলিক যোগাযোগ আরও নিবিড় হবে। জনগণের মাঝে বাড়বে পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধ। চুক্তি স্বাক্ষরের আগে চার দেশের আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন স্বাগতিক ভুটানের ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন মন্ত্রী ডি এন ডুঙ্গেল। বক্তব্য দেন বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ভারতের পরিবহনমন্ত্রী নিতিন গড়করি, নেপালের ফিজিক্যাল ইনফ্রাস্টাকচার ও ট্রান্সপোর্ট মন্ত্রী বিমলান্দ নিধি। সভা শেষে নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন সংশ্লিষ্ট দেশের সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহনমন্ত্রীরা। পরে পতাকা নেড়ে উদ্বোধন করা হয় মোটর শোভাযাত্রার। চুক্তিটি সইয়ের পর লন্ডন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করে চার দেশের পরিবহনমন্ত্রীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। গত সোমবার বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় রূপরেখা চুক্তিটি অনুমোদন পায়। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রূপরেখা চুক্তির পর কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে চলতি বছরের শেষের দিকে মূল চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে চলাচলের পথের সমীক্ষা, পরীক্ষামূলক চলাচল ও অভিবাসন-সুবিধা পর্যালোচনা করা হবে। চুক্তির অধীনে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক-লরি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলতে পারবে। শুল্ক ও অভিবাসন কর্তৃপক্ষের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে নিজ নিজ দেশের আইনে। তবে ট্রানজিট ও চলাচলের অনুমতি-সংক্রান্ত ফি নির্ধারণ আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হবে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক (সাসেক) কৌশলগত বাণিজ্য সম্প্রসারণ রূপরেখার ওপর ভিত্তি করেই এ চুক্তি সই হয়েছে। সাসেক রূপরেখা ২০১৪ সালের মার্চে এই চার দেশ অনুমোদন করে। চুক্তির বিস্তারিত ॥ শুধু স্থলবন্দর দিয়েই এই যাতায়াত হবে। ভবিষ্যতে নতুন কোন বন্দর নির্মিত হলে সেটিও চুক্তির আওতায় আসবে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করছে। নতুন চুক্তি হলে এক দেশ অন্য দেশের ভূমি ব্যবহার করে তৃতীয় দেশেও যেতে পারবে। অনেকটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে চুক্তি। খসড়া রূপরেখা চুক্তি অনুসারে যানবাহনের বৈধ মালিকানা, ফিটনেস ও ইনস্যুরেন্সের হালনাগাদ দলিল থাকতে হবে। চালকের স্থানীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যে কোন এক ধরনের লাইসেন্স থাকলেই চলবে। আর যাত্রীর থাকতে হবে বৈধ ভ্রমণ দলিল। প্রয়োজন হলে পথে যে কোন দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ যানবাহন পরিদর্শন করতে পারবে। নিষিদ্ধ কিংবা তালিকাভুক্ত স্পর্শকাতর মালামাল বহন করা যাবে না। ব্যক্তিগত, যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলের অনুমতি পাওয়ার জন্য আলাদা আলাদা ফরম পূরণ করতে হবে। বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত যানের দীর্ঘমেয়াদী অনুমোদন লাগবে। আর ব্যক্তিগত গাড়ির অনুমতি হবে সাময়িক এবং তা তাৎক্ষণিকভাবে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ দিতে পারবে। যানবাহন চলাচলের পথ ॥ বাংলাদেশে এখন ২০টি স্থলবন্দর রয়েছে। এর ১৯টিই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত। টেকনাফ বন্দরটি মিয়ানমারের সঙ্গে। বিদ্যমান সব বন্দর দিয়েই বাংলাদেশ-ভারত যোগাযোগ রক্ষা করতে পারবে। তবে বাংলাদেশ থেকে নেপাল ও ভুটানে যাওয়া-আসার জন্য প্রাথমিকভাবে দুটি করে চারটি পথ ঠিক করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে নেপালে যেতে ঢাকা-বাংলাবান্ধা-জলপাইগুড়ি-কাকরভিটা এবং ঢাকা-বুড়িমারী-চেংড়াবান্দা এ দুটি পথ ব্যবহার করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আর ভুটানের পথ দুটি হচ্ছে ঢাকা-বুড়িমারী চেংড়াবান্দা এবং অন্যটি ঢাকা-সিলেট-শিলং-গুয়াহাটি। সম্প্রতি ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি পথে পরীক্ষামূলক বাস চালু করা হয়েছে, সেটি দিয়ে ইতোমধ্যে কয়েকজন ভুটানি ভ্রমণ করেছেন। সূত্র জানায়, চুক্তিতে যাত্রীবাহী যানবাহন বলতে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত বাস, ভাড়ায় চালিত বাস-কার ও ব্যক্তিগত গাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর পণ্যবাহী যানের মধ্যে রয়েছে কনটেইনার বহন করা যায় এমন ট্রেইলর ও ট্রাক। কোন যান কীভাবে চলবে ॥ ব্যক্তিগত গাড়ি অনিয়মিত যান হিসেবে বিবেচিত হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাঁরা যেতে চান, তাঁদের ৩০ দিন পর্যন্ত ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হবে। যাত্রার যেসব উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে পর্যটন, তীর্থযাত্রা, বিয়ে অনুষ্ঠান, চিকিৎসা, শিক্ষা সফর, রেলস্টেশনে যাওয়ার জন্য যাত্রা। এ ধরনের যাত্রীদের যাত্রাকালে জ্বালানি ভরে যেতে হবে। কোন শুল্ক না দিয়েই নিতে পারবেন প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশ। পথে জ্বালানির দরকার হলে ভর্তুকিবিহীন দামে জ্বালানি নিতে পারবেন। দুর্ঘটনায় পড়লে নিজ নিজ দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই গাড়ি নিয়ে যতবার ভ্রমণ করবেন, ততবার অনুমোদন নিতে হবে। পুরনোদের বেরিয়ে যাওয়া ॥ খসড়া রূপরেখা চুক্তিতে বলা হয়েছে, উল্লেখিত চার দেশের বাইরে অন্য কোন দেশ চাইলে এই অবাধ যান চলাচল প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবে। তবে চার দেশের কেউ দ্বিমত করলে অন্তর্ভুক্তি আটকে যাবে। চুক্তিতে সই করা কোন দেশ এই প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে অন্যদের লিখিতভাবে জানাতে হবে। এরপর চার দেশের পরিবহন সচিবরা ৩০ দিনের মধ্যে আলোচনায় বসে পরবর্তী করণীয় ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবেন। চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার লিখিত আবেদন বাকি তিন দেশের হাতে পৌঁছানোর দিন থেকে পরবর্তী ছয় মাস পর তা কার্যকর হবে। বাণিজ্যিক যানের রং ॥ চুক্তিতে বলা হয়েছে, যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহনগুলো হবে সাদা রঙের। দুই পাশে হলুদ রং দিয়ে ইংরেজি এবং নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিবহনের নাম, দেশের নাম, যাত্রা শুরু ও শেষের স্থানের নাম এবং পথ লেখা থাকবে। চুক্তি শেষে ভুটানের ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন মন্ত্রী ডিএন ডুঙ্গেল বলেন, আজকের দিনটি ঐতিহাসিক। বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বেশ ভাল লাগছে আজকের এই চুক্তিতে সই করতে পেরে। এর মাধ্যমে আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে। তিনি আরও বলেন, আজ আমরা আঞ্চলিক সংযোগের এক অনন্য অধ্যায় শুরু করতে একত্রিত হয়েছি। ভারতের পরিবহনমন্ত্রী নিতিন গড়করি বলেন, আমরা মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করতে যাচ্ছি। এর মাধ্যমে বিস্তৃত সড়কে পৌঁছে যাবে আমাদের উদ্যোগ। আর নেপালের ফিজিক্যাল ইনফ্রাস্টাকচার ও ট্রান্সপোর্ট মন্ত্রী বিমলান্দ নিধি বলেন, আমি আনন্দিত। আমরা এ অঞ্চলের মানুষের আশা আকাক্সক্ষার যাত্রী হলাম আজ। অনুষ্ঠানে যোগ দেন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়েনচাই ঝ্যাং। অক্টোবরের মধ্যে চুক্তির পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন এবং আগস্টের মধ্যে প্রটোকলসহ চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে চূড়ান্ত বাস্তবায়ন জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। চুক্তির খসড়া অনুযায়ী, চার দেশের মধ্যে চলাচলের রুট পারমিট নিতে হবে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার সময় মাঝপথে কোন যাত্রী বা মালামাল তোলা যাবে না। যে দেশের ওপর দিয়ে মালামাল যাবে, সেই দেশের কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে সার্চ ইন্সপেকশন করতে পারবে। যান চলাচলের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ নিজেদের নির্ধারিত হারে ট্রানজিট ফি আদায় করতে পারবে। তিন বছর পর পর এই চুক্তি নবায়ন করতে হবে একথা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপের মতো এই চার দেশের মধ্যে ২০১৬ সালে মোটরযান চলাচল শুরু হবে। চুক্তি সই হওয়ার পর এর প্রটোকল নিরাপত্তাসহ বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে জানিয়ে সেতুমন্ত্রী বলেন, প্রটোকল হতে কয়েক মাস লাগবে। আশা করছি ২০১৬ সালে আমরা নতুন যাত্রা শুরু করতে পারব। যাতায়াতে ভিসা বা ইমিগ্রেশন আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে করা হবে।
×