ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিশুশ্রম

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৫ জুন ২০১৫

শিশুশ্রম

এ পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন এক কবি। শিশুদের পৃথিবীটা কখনও কখনও নির্মম হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায়, যে বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা বই-খাতা হাতে, খেলাধুলা আর আনন্দ-উল্লাসে থাকার কথা, সেই বয়সে তাদের নামতে হয় রোজগারে। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার যোগাড় করা যেমন নিজেদের জন্য, তেমনি কারও কারও পরিবারের জন্যও। অভাবের তাড়না, দারিদ্র্য, বেঁচে থাকার সংগ্রাম শিশুকে বাধ্য করে শ্রম বিক্রিতে। আর এ অবস্থাই সহায়ক শিশুশ্রম বাড়িয়ে তুলতে। জাতীয় শিশুনীতিতে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শিশুরা নানা শ্রমে নিয়োজিত হয়। এ ক্ষেত্রে ভেদ নেই শহর, নগর, গ্রাম ও বন্দরের। সর্বত্র অপুষ্ট দেহে শিশুকে করতে হয় গতর খাটানোর কাজ। আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নামতে বাধ্য করা হয় অনেককে। বিনিময়ে যথাযথ পারিশ্রমিক জোটে না অনেকেরই। উপরন্ত হতে হয় নিপীড়নের শিকার। জাতীয় শিশুনীতি অনুসারে ৫ থেকে ১৮ বছরের কোন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না। ৫ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত শিশুশ্রম নিয়োগকর্তার জন্য দ-নীয়। শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ আইনটি। বাংলাদেশে শিশুশ্রম কমছে। এটা স্বস্তির খবর। বলা হচ্ছে, সরকারী, বেসরকারী প্রচেষ্টায় ছিন্নমূল ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিদ্যালয়ে গমনের হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে জড়িত এই সাফল্য। কিন্তু অভাব, দারিদ্র্য দূর না হলে চরম দারিদ্র্যের শিকার শিশুদের শ্রম বিক্রি বন্ধ হবে না। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়িত হলেও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা এখনও উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়ে গেছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে অল্প বয়সী এসব শিশু অমানবিক পরিশ্রম করছে। গৃহকর্মে শিশুরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়ে আসছে। অন্যান্য পেশায়ও তারা নিগৃহীত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী ৫৭ শতাংশ শিশুশ্রম দিচ্ছে কেবল খাদ্যের বিনিময়ে। ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুকে মজুরি দেয়া হলেও এর পরিমাণ শিশু আইনের তুলনায় নগণ্য। আইএলওর হিসেবে বিশ্বে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ। প্রতি ৬ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশুশ্রমে নিযুক্ত। পাচার, সন্ত্রাস, নির্যাতন প্রভৃতি কারণে প্রতিবছর প্রায় ২২ হাজার শিশু মারা যায়। বাংলাদেশের মোট শ্রমিকের মধ্যে অন্তত ১২ শতাংশই হচ্ছে শিশুশ্রমিক। শহরাঞ্চলে অতি দারিদ্র্যের কারণে শিশুরা শ্রমে নিয়োজিত হয়। কিন্তু শিশুনীতির বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় শিশুশ্রম কমানোর বিষয়টি আমলে নেয়ার উদ্যোগ নেই। বলা হচ্ছে, দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। দশ বছর আগে দেশে এই সংখ্যা ছিল ৪৯ লাখ ১০ হাজার। বর্তমানে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ২৪ লাখ ৮০ হাজারে। এমনিতে শিশুরা অল্প বয়সে শ্রমে নিযুক্ত হওয়ায় তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আবার এর কারণে শিক্ষাপ্রাপ্তির সুযোগও সীমিত হয়। তারা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খেতেই থাকে। শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে এসব শিশুকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আইন করে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সবাইকে মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে শিশুশ্রম বন্ধে শক্তিশালী কমিশন গঠন করে বিষয়টি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা। যারা শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের সচেতন করার পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সরকারকে যেমন একদিকে শিশু অধিকার সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে, তেমনি দারিদ্র্য হ্রাসে আরও মনোযোগী হতে হবে। বিপুলসংখ্যক শিশুকে মানবেতর অবস্থায় রেখে নিজেদের কোনভাবেই সভ্য, মানবিক ও গণতান্ত্রিক দাবি করা যায় না।
×