ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

ফেলে আসা দিনের রাজনীতি বনাম আজকের রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১৫ জুন ২০১৫

ফেলে আসা দিনের রাজনীতি বনাম আজকের রাজনীতি

এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ভারতীয় কোন প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নিয়ে বাঙালিরা উদ্বেল হলো। ১৯৭২ সালে, ইন্দিরা গান্ধী যখন ঢাকায় এলেন তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নৌকার আকারে নতুন একটি মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল জনসভার জন্য। মঞ্চের নাম ছিল ইন্দিরা মঞ্চ। তাঁকে বাঙালিরা প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, তাতে কোন খাদ ছিল না, ছিল শুদ্ধ আবেগ। ১৯৭৫ সালের পর সে আবেগ ক্রমে অন্তর্হিত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। জিয়াউর রহমান একটি মিনি জঙ্গী পাকিস্তান গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ১৯৪৭-এর সঙ্গে ১৯৭৫ যুক্ত হয়েছিল। বলা হয়েছিল এটিই মূল ধারা। ১৯৭১ ব্যত্যয় মাত্র। তারপর জেনারেল এরশাদ সে ধারা এগিয়ে নিলেন। খালেদা জিয়া ১৯৭১ সালের খুনীদের ক্ষমতায় নিয়ে এলেন। এই সময় রাজনীতির প্রধান ধারা হয়ে উঠল ভারত বিরোধিতা। ১৯৪৭ সালের সমীকরণটি আবার প্রাধান্য পেল। ভারত=হিন্দু। পাকিস্তান+বাংলাদেশ = মুসলমান। নরেন্দ্র মোদির অভ্যন্তরীণ পাটাতনটিও ছিল সে রকম। ভারত = হিন্দু। মোদির প্রবল জয়, ভারতে নব্য হিন্দুত্ববাদের বিজয়। মোদির জয় পাকিস্তানীমনা বিএনপি-জামায়াতকে খুশি করেছিল। কারণ, মৌলবাদ মৌলবাদকে পছন্দ করে। ২০০১ সালে পাকিস্তানী-বাঙালিদের প্রতিনিধি খালেদা জিয়া ও ১৯৭১ সালের আলবদর প্রধান নিজামীকে ক্ষমতায় আনতে সমর্থন করেছিল। বিনিময়ে খালেদা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্থান দিয়েছিলেন বাংলাদেশে। তাদের অস্ত্র সরবরাহের পথ সুগম করেছিলেন, জঙ্গীবাদকে উৎসাহিত করেছিলেন, টেকনাফ থেকে মেঘালয় সীমান্ত পর্যন্ত জঙ্গীরা যাতে দুই দেশে কাজ করতে পারে তার পথ সুগম করেছিলেন এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ভারত বিরোধিতা চরম করে তুলেছিলেন। মনমোহন সিং তখন অনুধাবন করেছিলেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক থাকবে। তবে রাষ্ট্র কারা পরিচালনা করছে সেটিও ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে। শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর সে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে তুলেছিলেন ভারত সফরে গিয়ে, অনেকগুলো চুক্তি করে। আজ ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক যে নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে তার ভিত রচনা করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেই থেকে খালেদা ক্রুদ্ধ কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের প্রতি। সেই ক্রোধ পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছে ২০১৩-১৪ সালের নির্বাচন সমর্থন করায়। মোদির নির্বাচিত হওয়ার পর তাই বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা ঢাকার মিষ্টির বাজার খালি করে দিয়েছিল। তারা প্রথম ধাক্কাটি খেলেন যখন দেখলেন, মোদির কোন দূত ঢাকায় এসে খালেদার সঙ্গে বৈঠক করলেন না, যা ঘটেছিল বাজপেয়ী ক্ষমতায় আসার পর। অথচ, বিজেপিকে খুশি করার জন্য খালেদা ভারতীয় প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখোপাধ্যায়কে অপমান করেছিলেন। খালেদা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেলেন যখন দেখলেন, মোদি ঘোষণা করলেন, পূর্বতন সরকারের নীতিই বহাল থাকবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। নির্বাচিত হওয়ার পর মোদি তার ইমেজ বদলাতে চাইছেন। এক বছরে ন’টি দেশ সফর এবং ‘ভাই-ভাই’ নীতি তাকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নতুন শক্তিশালী খেলোয়াড় হিসেবে তুলে ধরছে। আমেরিকানরাও তার হাত থেকে ধান খুঁটেই খাচ্ছে পোষা পায়বার মতো। মোদি অনুধাবন করেছেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা এখন মধ্যযুগীয় বলে বিবেচিত হচ্ছে। তাই, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও তিনি মৌলবাদ নিয়ে এখন আর বেশি নাড়াচাড়া করছেন না। তার বাইরের ইমেজ অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও সহায়তা করছে। তাই মোদিকে বরণ করে নিতে কারও দ্বিধা ছিল না। বিএনপি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল মোদির সাক্ষাত পাওয়ার জন্য যে, তারা ঘোষণা করলÑ তারা কখনও ভারত বিরোধিতা করেনি, এখনও করছে না, ভবিষ্যতেও করবে না। বিএনপির রাজনীতি মিথ্যার ওপর রচিত, সুতরাং তাদের নতুন মিথ্যাচারে কেউ অবাক হয়নি। বরং ঐ মিথ্যাচার তাদের মরিয়া ভাবটিই তুলে ধরেছে। যে আমি খালেদার সমালোচক, সেই আমিও লজ্জা পাচ্ছিলাম। কীভাবে ভুলি যে, খালেদা তিনবার আমাদের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন! মোদি ফেরাননি খালেদাকে। মিনিট দশেকের সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন। মোদিকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যম ও ভদ্রলোক মহলে প্রবল উচ্ছ্বাস বয়ে গেছে। তাদের মুগ্ধ করেছে মোদির বক্তৃতা। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মোদি যেদিন বক্তৃতা দেন সেদিন একটি প্রবেশপত্রের জন্য ভদ্র মহলে হাহাকার পড়েছিল। ঐ বক্তৃতার প্রবেশপত্র পাওয়া না পাওয়া প্রেস্ট্রিজ ইস্যু হয়ে উঠেছিল। দর্শকদের মধ্যে শেখ হাসিনা বিরোধী ড. কামাল হোসেন, মওদুদ আহমদ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতারাও ছিলেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ছিল সেখানে। মোদির দু’টি বক্তৃতাই দর্শকদের আপ্লুত করেছে। ১৯৭২ সালের পর এই প্রথম দেখলাম সব বিষয়ের সমালোচক ও ছিদ্রান্বেষী বাঙালি কোন ভারতীয় নেতার আগমন ও বক্তৃতা শুনে আপ্লুত। কারণটি কী? কারণ, তিনি বুঝেছেন বাঙালিরা মাড়োয়ারি বা গুজরাটি নয়। তাদের সঙ্গে একটু ভালভাবে কথা বললে, একটু প্রশংসা করলে তারা পাগল হয়ে যায়। এবং সে সব কথা বিশ্বাস করে। বক্তৃতা মঞ্চে আমরা যা ভালবাসি তাই তিনি বলেছেন। ভালভাবে পরামর্শ করেছেন। তবে, নেপথ্যে ভারতীয় আমলাদের এফিসিয়েন্সি কাজ করেছে। আমাদের উচ্চপদধারীদের সঙ্গে তাদের উচ্চ ও মাঝারি পদধারীদের তফাত যে কত বিশাল তার প্রমাণ পেলাম আবার। সে কথাও বলছি। বঙ্গভবনে অটলবিহারী বাজপেয়ীর মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা গ্রহণের সময় মোদি প্রথম বক্তৃতাটি দেন। ঐ অনুষ্ঠানে স্বল্প কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। সে বক্তৃতায়ই তিনি কিস্তিমাত করে ফেললেন। বাজপেয়ী ১৯৭১ সালে কী কী বলেছিলেন তা তিনি উদ্ধৃত করলেন যা আমরাও ভুলে গেছি। এসব তথ্য তার ব্যক্তিগত সচিব বা অন্যরা খুঁজে দিয়েছেন। বাজপেয়ী ঐ সময় বলেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশ যে বন্ধুত্বের সূত্রপাত হলো তা কূটনীতিও ছিন্ন করতে পারবে না। এর সঙ্গে তিনি যোগ করলেন, ভারতীয় সেনাদের রক্ত, মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত একই সঙ্গে এই মাটিতে মিশে আছে। সুতরাং, বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব তো স্বাভাবিকভাবেই অটুট থাকবে। তারপর জানালেন, বাংলাদেশের প্রতি তার এত আবেগ কেন? কারণ, তার রাজনীতির শুরুটা ১৯৭১ সাল থেকে। তিনি থাকতেন গ্রামে। বাজপেয়ী শহরে বাংলাদেশের পক্ষে সত্যাগ্রহ করবেন। মোদি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু, বাজপেয়ী বা জনসংঘের সত্যাগ্রহের কথা শুনে গ্রাম থেকে শহরে ছুটে এসেছিলেন তাতে যোগ দেয়ার জন্য। আমরা অভিভূত। যদিও মোদি সম্পর্কিত কোন বইয়ে এ তথ্য নেই। কারণ, এই প্রথম তিনি তথ্যটি জানালেন। আমরা অবশ্য জানলাম, জনসংঘের মতো ক্যাডারভিত্তিক দলের জনসভায় দলীয় দর্শনে আগ্রহী না হয়েও সেই গ্রাম থেকে পয়সা খরচ করে একেবারে শহরে এসে এক ভিনদেশের জন্য সত্যাগ্রহ করা তুমুল একটি ব্যাপার। এরপর করতালিতে হলঘর মুখর করা ছাড়া কোন উপায় আছে। বস্তুত, মোদি বিনয়সহকারে সম্মাননাটি গ্রহণ করে জানালেনÑ একই সঙ্গে চলব আমরা, আগে পিছে নয়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রেও এই কথাটি পুনরাবৃত্তি করেন। আর ঐ বক্তৃতা এত মুগ্ধ করেছে এলিটদের যে, তিনি বলেছিলেন ভারতীয় সেনাদের কাছে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করেছিল। এটি যে ঐতিহাসিক এবং পলিটিকালি কারেক্ট নয় এ কথাও কারও মনে হয়নি। ভারতীয়রা এ ভুলটি প্রায়ই করে। বেশ ক’বছর আগে ফোর্ট উইলিয়ামে মুক্তিযোদ্ধাদের যে মিলন মেলা হয় বিজয় দিবসে সেখানে আমি আর শাহরিয়ার কবিরও আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। জাঁকালো অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে সেখানকার ফোর্ট উইলিয়াম অধিপতি একই কথা বললেন। পরে, আমি আর শাহরিয়ার ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানালাম। তিনি মেনে নিলেন এবং কথা দিলেন এরপর থেকে এ ভুল আর হবে না। যাক সে প্রসঙ্গ। মোদির ‘সাথ সাথ’ নীতির কথা আমরা অনেকদিন থেকে বলে এসেছি। আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির মূল বিষয় হলো মুরুব্বিয়ানা, তেমনি দক্ষিণ এশীয় বা সার্কভুক্ত দেশগুলোর প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ‘পিছে পিছে’ অথবা ‘দাদা’ সুলভ। এতে, অন্য রাষ্ট্রগুলো খুশি যে ছিল না তা বলাই বাহুল্য। এখন ‘সাথ সাথ’ নীতি অনেককেই তুষ্ট করবে। আমরাও ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে এটাই আশা করেছিলাম। ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’-এর তকমা আমাদের দরকার নেই। সমমর্যাদায় আলোচনা চালাতে পারলেই দু’পক্ষের স্বার্থহানি হওয়ার সম্ভাবনা কম। মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের ভারত বিরোধী অংশ দু’টি বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছে। এক. গোপন চুক্তি হয়েছে এবং বাংলাদেশ কী পেল? দুই. তিস্তার চুক্তি তো হলো না। পাকিস্তানী-বাঙালি অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতভুক্ত মিডিয়া ও ‘বুদ্ধিজীবীরা’ই এ প্রশ্ন তুলছেন। এদের হাহাকার দেখে পুরনো ঢাকার সেই রসিকতাটি মনে হয়Ñ ভাঙ্গা ছাদ দিয়া পানি পড়ব না তো কি শরবত পড়ব? যে ভারতের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত কখনও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় আলোচনার সাহস পায়নি, কোন রকম উন্নয়নমূলক চুক্তি করতে পারেনি, তারা যখন বলে কী পেল বাঙালিরা তখন মনে হয়, যদি কোন চুক্তি স্বাক্ষরিত নাও হতো তাহলেও বলা হতো, গোপন চুক্তি হয়েছে, ভারতকে দেশ বিক্রি করে দিয়েছে। এটি এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা যার দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা ছাড়া উপায় নেই। সীমান্ত চুক্তি ৭০ বছরেও হয়নি, এবার তা কার্যকর হলোÑ এটি সাফল্য নয়। বিদ্যুত, বিনিয়োগ ইত্যাদি নিয়ে চুক্তি হলো ২২টি যা সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে তা হলো গোপন চুক্তি! শুধু তাই নয়, বণিক মহল ভারতে বিনিয়োগের জন্য জমি চেয়েছিল ৫০ একর। চুক্তির কালি শুকোতে না শুকোতে মোদি ঘোষণা করেছেন, গুজরাটে ৫০ একর জমি দেয়া হবে। বাংলাদেশকে ঋণ দেয়া হয়েছে ২০০ কোটি ডলার শর্তহীনভাবে। পাকিস্তানী বাঙালীরা অবশ্যই প্রশ্ন তুলতে পারেন, কেন শর্তহীন ঋণ দেয়া হলো? মতলবটা কী? তাদের কষ্টটা বুঝি। কেন পাকিস্তান ঋণ দিতে পারল না? কেন মাদার কান্ট্রির প্রধানমন্ত্রী এলে উষ্ণ অভ্যর্থনা পায় না। মাদার কান্ট্রি ও তার চিলড্রেনরা ৭০ বছরে যেসব প্রব্লেম সলভ করতে পারেনি ভারতের দালাল হাসিনা সেগুলো করে ফেললেন! শেখ হাসিনা না হয় পুরনো দালাল, কিন্তু নতুন দালালির জন্য খালেদা যা করেছেন তা দালালভুক্ত হওয়ার জন্য যারা আগ্রহী তাদেরও লজ্জা দেবে। পাকিস্তানী জেনারেলরা কপাল নিয়ে জন্মেছিলেন। সুভাষ বোসের নাতনি শর্মিলা বোস বা বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রীর প্রীতি তারা পেয়েছেন। পাকিস্তানী জানজুয়া মারা গেলে খালেদা সমবেদনা জানান আর শর্মিলা লেখেন পাকিস্তানী জেনারেলরা ১৯৭১ সালে কিছুই করেনি। কী করা, বাঙালীরা তাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তিস্তা চুক্তি হবে না, সেটি নিয়ে বিস্মিত হওয়ার কী আছে? ৫৪টি নদী নিয়ে চুক্তি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে। ক’টির সমস্যা জিয়া ও তার পতœী এবং তাদের সঙ্গীরা সমাধান করতে পেরেছেন। হাসিনা তো গঙ্গা চুক্তি করতে পেরেছেন। মমতা ব্যানার্জির রাজনীতি আমরা বুঝতে অক্ষম, সেটি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা বুঝবেন যাদের সবার দিদি তিনি। তার মৌলবাদীদের সঙ্গে দহরম মহরমের রাজনীতিতে আমাদের আগ্রহ নেই। খালেদা জিয়া যেমন এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছেন মৌলবাদ তোষণের কারণে, মমতাও হবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর ভারত সরকার যদি তাদের একটি রাজ্যের নির্দেশে চলে তাতে ভিনদেশের কিছু বলার নেই। আমরা প্রতিশোধপরায়ণ নই যে, প্রতিবেশী রাজ্যকে বিপাকে ফেলব। বাংলাদেশ ইচ্ছা করলেই তা পারে। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে একটি বড় অংশ এখন বাংলাদেশের বাঙালীদের। কিন্তু, আমাদের বিবেচনাটি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী। মমতা ব্যানার্জি নয়। ১৯৭১ এখনও আমরা ভুলিনি। তিস্তা চুক্তিও করতে হবে। কী পেলাম না পেলাম ছাড়িয়ে যে বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে তা হলো কী বললেন নরেন্দ্র মোদি একান্তে খালেদাকে? এই বিতর্কটি উস্কে দিয়েছেন কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যানের সম্পাদক মানস ঘোষ। তিনি লিখেছেন, মোদি খালেদাকে তিনটি প্রশ্ন করেছেনÑ এক. প্রণব মুখার্জির সঙ্গে তিনি দেখা করেননি কেন? দুই. দশ ট্রাক অস্ত্র চালান সম্পর্কে তার কাছে অনেক তথ্য আছে তা তিনি সরকারকে জানাননি কেন? এবং তিন. বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের কী জানেন তিনি? টেলিভিশনেও মানস ঘোষের এই রিপোর্ট নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। বাঙালী-পাকিস্তানীদের মত, তাদের নিভৃত আলাপ কারও জানার কথা নয়। অর্থমন্ত্রী মুহিতের ভাষায় বলতে হয়, এসব পাকিস্তানী-বাঙালী স্টুপিডও বটে। এ ধরনের আলোচনায় প্রতিটি লাইন ব্রিফ করা থাকে। যারা ব্রিফ করেন তারা তো জানেনই মোদি কী বলবেন? তাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের যোগাযোগ নেই? আর সাংবাদিকদের কাজই তো হচ্ছে নিভৃত আলাপ-আলোচনা প্রকাশ্য করা। মোদির আগমনে, বক্তৃতায়, চুক্তি স্বাক্ষরে ভারত-বাংলাদেশ দু’পক্ষই লাভবান হয়েছে। এই সফর ও চুক্তি বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। শেখ হাসিনা ও ভারতে মমতা ব্যানার্জি ছাড়া আর যে কেউ প্রধানমন্ত্রী হন না কেনÑএ সম্পর্ক আর প্রাক ২০০৮ সময়ে ফিরে যাবে না। হয়ত স্থবির থাকবে। শেখ হাসিনা অনেক আগেই আর ভারতীয় নেতৃত্ব মনমোহনের সময় থেকে বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন। মোদির আগমন সবচেয়ে বড় অভিঘাত হেনেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। আওয়ামীবিরোধী রাজনীতির মূল বিষয়টি ছিল অন্ধ ভারত বিরোধিতা। এই বিজেপি সরকারই এক সময় এই বার্তা দিয়েছিল যে, তাতে ডিভিডেন্ড পাওয়া যাবে। এখন বিষয়টি উল্টো হয়ে গেছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, ভারতকে উপেক্ষা করে রাজনীতি করা যাবে না। এর অর্থ মাদার কান্ট্রি পাকিস্তান থাকবে, তবে ছেলে প্রবাসী অর্থাৎ খানিকটা দূরত্ব রাখতে হবে। খালেদার মরিয়া হয়ে দেখা ভিক্ষা ভারত বিরোধিতার রাজনীতিতে পানি ঢেলে দিয়েছে। ভারত-বিরোধিতার আগুন পুরোপুরি নেভেনি এখনও, ধিকিধিকি জ্বলছে। ভারত বিরোধিতার রাজনীতি পুরনো ধারায় আর ফিরে যাবে না। আমার ব্যক্তিগত মত, মোদির ‘সাথ সাথ’ বৈদেশিক নীতির প্রভাব সার্ক দেশগুলোতে অনুভূত হবে এবং নির্দ্বিধায় ভারতের নেতৃত্ব সবাই মেনে নেবে। মোদি যে আস্থা সৃষ্টি করেছেন তার ফলে চারদেশীয় গাড়ি চলাচল চুক্তি হয়ে গেছে। এই চুক্তি এবং চতুর্দেশীয় ট্রানজিট চুক্তি কানেকটিভিটির নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। কানেকটিভিটি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করবে, তা নয়, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসও হ্রাস পাবে। সব ধরনের কানেকটিভিটিই উন্নয়ন। আমরা হয়ত থাকব না; কিন্তু কুড়ি বছর পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে যে সার্ক ইউনিয়ন হবে না এবং তা একটি অর্থনৈতিক শক্তি হবে না তা কে বলবে! এবং আমরা তো তা-ই চাই। সবশেষে বলব, শেখ হাসিনা সেই প্রবাদটিই সত্য প্রমাণ করেছেন যে, সবুরে মেওয়া ফলে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কোন্নয়ন তিনি ভেবেছিলেন এ অঞ্চলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং পাকিস্তানের আইএসআইয়ের নাশকতামূলক প্রভাব হ্রাস করবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কোন্নয়নের কারণ শুধু আবেগ নয়, তার নিরাপত্তার প্রশ্নও। মিয়ানমার ও বাংলাদেশ এক সময় ভারতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি ছিল। কারণ, ১৯৭১ সালের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আইএসআই ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করেছিল; যাদের মূল আশ্রয় ছিল মিয়ানমার ও বাংলাদেশ। খালেদা যাদের বলতেন, ভারতের স্বাধীনতাকামী যারা ভারতীয় দাসত্ব থেকে মুক্তি চায়। শেখ হাসিনা সেই নিরাপত্তা প্রদান করেছেন, যে কারণে ভারত আর্থিক দিক থেকে প্রচুর লাভবান হয়েছে। মিয়ানমারকে ভারত ইঙ্গিত দিয়েছে সাম্প্রতিক সীমান্ত অতিক্রম করে যে, যত বন্ধুত্বই থাকুক এ প্রশ্নে আপোস হবে না। পাকিস্তানও এ কারণে চিন্তিত। কারণ, কাশ্মীর সীমান্তে মুজাহিদদের হটপারসুট করে ভারত ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। শেখ হাসিনা শুধু ভারত নয়, একই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ভুটান ও নেপালের সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়ন করেছেন। নেপাল-ভুটান ভারত থেকে বাংলাদেশকে এখন বেশি না হলেও কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না; বরং অধিক বন্ধুভাবাপন্ন মনে করে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কারণে, শেখ হাসিনাকে পাকিস্তানী বাঙালীদের অনেক গালমন্দ সইতে হয়েছে। ভারতীয় রাজনীতিবিদরাও অনেক ক্ষেত্রে মমতার মতো রাজনীতি করেছেন। কিন্তু, শেখ হাসিনা ধৈর্য ধরেছেন। কূটনীতিতে ধৈর্য যে কতটা জরুরী তাও তিনি প্রমাণ করেছেন এবং তার ফল শুধু বাংলাদেশ নয়, সার্কের অন্যান্য দেশও ভোগ করবে। পাকিস্তান এখন ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। ফলে পাকিস্তানের প্রক্সি রাজনীতিবিদরাও যেমন অসুবিধায় আছেন এবং তেমনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন। তাদের চিৎকার এখন সেই প্রবাদের মতো, রাতের পথে কাঁরাভা এগিয়ে যায়, সারমেয় শুধু আর্তচিৎকার করে। অন্য দেশের ক্ষেত্রে না হোক, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বা দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, রাষ্ট্র রাষ্ট্র সম্পর্ক শুধু নয়, রাষ্ট্রে কে শাসন করছে তাও বিবেচ্য। মোদি-হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গি সার্ক ও নিজ নিজ দেশকে শক্তিশালী করবে। এটিই বর্তমানের রাজনীতি। মমতা-খালেদার রাজনীতি দেশকে দুর্বল করবে এবং তা ফেলে আসা দিনের রাজনীতি।
×