ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাহারি ডিগ্রী ॥ তিন ভুয়া দন্ত চিকিৎসকের জেল জরিমানা

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৪ জুন ২০১৫

বাহারি ডিগ্রী ॥ তিন ভুয়া দন্ত চিকিৎসকের জেল জরিমানা

আজাদ সুলায়মান ॥ ডি.ডি.টি.ডি.বি, কে,পি। এটা কি ডিগ্রী তা কেউ জানে না। এ নামে দুনিয়ার কোন মেডিক্যাল কলেজে কোন কোর্সও নেই। অথচ এমন বিশেষায়িত ডিগ্রী ব্যবহার করে দিনের পর দিন দাঁতের সব জটিল রোগের চিকিৎসা করছেন এমন একজন চিকিৎসক যিনি কোন মেডিক্যালে পড়াশোনা করেননি। পড়াশোনা না থাকলেও তিনিই হয়ে গেলেন রাজধানীর খ্যাতিমান দন্তবিশেষজ্ঞ। তার নাম আক্তার হোসেন। শুধু তিনি একা নন। তার মতো আরও দুই দন্তবিশেষজ্ঞের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। তাদের তিনজনকেই জেল জরিমানা দেয়া হয়। তারা এখন কারগারে। তবে বছরের পর বছর ধরে কিভাবে তারা মানুষকে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করেছেন সে অবিশ্বাস্য কাহিনী ওঠে আসছে র‌্যাবের তদন্তে। রাজধানীর কাওরানবাজার ও পূর্ব তেজতুরী বাজার এলাকায় ছিল তাদের চেম্বার। এসব চেম্বারে প্রতিদিন রোগী আসে শত শত। ইচ্ছে করলেই এসব বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নাগাল মেলে না। আগে থেকেই বুকিং দিতে হয়। নাম ঠিকানা লেখাতে হয়। ফিও বেশ চড়া। পাঁচশত টাকা। এসব বিশেষজ্ঞের চেম্বারে গিয়ে কোন রোগী যখন অপেক্ষায় থাকেন তখন শোনানো হয় অনেক চটকদার কথা। যেমন ডাক্তার আক্তার হোসেনের নাগাল পাওয়া বেশ কঠিন। উনি খুব একটা রোগী দেখেন না। যারা সাত দিন আগে থেকে বুকিং দেন কেবল তাদেরই বিশেষ বিবেচনায় আর মানবিক কারণে দেখেন। এই বিখ্যাত চিকিসৎক বসেন কাওরান বাজার সুপার মার্কেটে আল মদিনা ডেন্টাল কেয়ারে (দোকান নং ২৫৪)। এ চেম্বারের সাজ সজ্জা দেখে যে কারোরই মনে ভাল ধারণা জন্মাবে। সামনে একটি নেমপ্লেট। যাতে লেখা ডি.ডি.টি.ডি.বি,কে,পি। আবার ভেতরেও ডাক্তারের সামনে একটি নেমপ্লেট। তাতেও তাই লেখা। ভিজিটিং কার্ডে তো আরও বিশেষণের ছড়াছড়ি। যেমন বিশ বছরের অভিজ্ঞতা। দেশী আরও অনেক ডিগ্রীর সাঙ্কেতিক নাম। আর চিকিৎসা সরঞ্জামাদি বলতে একটি মিনি এক্সরে ইউনিট, কৃত্রিম দাঁত তৈরির ফর্মা, চেতনানাশক ইঞ্জেকশন সেট, হাতুড়ি, বাটাল, একটি ইজি চেয়ার। যেখানে রোগীকে অর্ধশোয়া করে দাঁত ওঠানো হয়। কিভাবে দাঁত ওঠানো হয় জানতে চাইলে একজন রোগী মারুফ বলেন, দাঁতের ব্যথা নিয়ে গত রবিবার এখানে আসি। ডাক্তার আক্তার হোসেন দাঁত দেখে বলেন এক্সরে করতে হবে। এক্সরে করার পর বলেন, দাঁত পোকায় খেয়েছে। এটা ফেলে দিতে হবে। না ফেলে উপায় নেই। থাকলে বাকিগুলোতে পোকা ধরবে। ডাক্তার যদি এই বলেন, তাহলে আর না ফেলে উপায় কি। বাধ্য হয়েই শুয়ে গেলাম। তিনি বললেন, আপনাকে কিছু করতে হবে না। শুধু মুখটা হা করে চুপচাপ শুয়ে থাকুন। তারপর তিনি দাঁতের গোড়ায় একটা ইঞ্জেকশন পুশ করেন। হাতে থাকা একটা রেঞ্চ দিয়ে এক টানেই দাঁত ওঠিয়ে ফেললেন। রক্ত যাতে বের না হয় সে জন্য দাঁতের গর্তে গজ তোলা ঢুকিয়ে বললেন, ওঠে পড়ুন। এটা পাঁচ ঘণ্টা রাখবেন। এর মধ্যে কিছু খাবেন না। তিন দিন পর মারুফ ফের এলেন ওই চেম্বারে। এখন অবস্থা আরও জটিল। এক দাঁত ফেলার পর পাশের আরও দুই দাতে ব্যথা শুরু। বলার পর ডাক্তারের জবাব, ওই দুটোও ফেলতে হবে। তার এ কথায় ভরসা রাখতে পারলেন না মারুফ। তিনি চলে গেলেন ঢাকা মেডিক্যালে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন আগের দাঁত ফেলানোর সময় ভুল চিকিৎসা করা হয়েছে। এর জন্য খেসারত দিতে হচ্ছে। মারুফের মতো এমন শত শত রোগী এ ধরনের চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন। তার মতো প্রতারিতরাই শেষ পর্যন্ত খবর দেন র‌্যাব অফিসে। বৃহস্পতিবার রাতে যখন সেখানে অভিযান চালানো হয় তখন র‌্যাব ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুর রহমানও অবাক হন। এ ধরনের দোষ স্বীকার করায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আনিসুর রহমান বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অপরাধ আইন ২০১০-এর ২৮(১) ধারা মোতাবেক আওয়ালকে এক বছর কারাদ- ও এক লাখ টাকা জরিমানা, জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদ- প্রদান করেন। একই সময় ঢাকা ডেন্টাল কেয়ারে মাওলানা জিএম ওয়াহিদকেও একই অভিযোগে জরিমানা করা হয়। কাওরান বাজার সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় ঢাকা ডেন্টাল কেয়ার চেম্বারের মাওঃ জিএম ওয়াহিদ ভিজিটিং কার্ডে নিজেকে দন্ত চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন যাবত সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে আসছেন এবং আগত রোগীদের তিনি ব্যবস্থাপত্র দিয়ে আসছেন। ডাক্তারী সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখতে চাইলে তিনি কোন কাগজপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি। স্বেচ্ছায় তিনিও নিজের দোষ স্বীকার করেন। এজন্য তাকে এক লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে তিন মাসের কারাদ- প্রদান করেন।
×