ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তিন বছরের আগে প্রকল্প পরিচালক বদলি নয় ;###;প্রকল্প পরিচালক পুল হবে

বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে ॥ উন্নয়নে পিডি ফ্যাক্টর

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ১৪ জুন ২০১৫

বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে ॥ উন্নয়নে পিডি ফ্যাক্টর

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ দিন দিন বাড়ছে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম, বাড়ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আকারও। জুলাই মাস থেকে শুরু হতে যাওয়া আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) ১ লাখ কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করেছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তি প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) বিষয়টি চলে এসেছে আলোচনার সামনে। বলা হচ্ছে, একজন পিডির দক্ষতা ও অদক্ষতার ওপরই নির্ভর করে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের সফলতা ও ব্যর্থতা। তাই এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। এতদিন নানাভাবে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও এখন সেসব বাস্তবায়ন পর্যায়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই তিন বছরের আগে বড় কোন অভিযোগ প্রমাণিত না হলে পিডিদের বদলি নয়, পারফর্মেন্স বিবেচনা করে পুরস্কার দেয়া, একাধিক প্রকল্পে একজন পিডির দায়িত্বে না দেয়া, শিক্ষক নিয়োগের আদলে পিডিদের জন্য পুল গঠনসহ নানা উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। প্রকল্প পরিচালক বিষয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, এখন থেকে বৈদেশিক সহায়তার ব্যবহার বাড়ানোর জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে একজন প্রকল্প পরিচালকই রাখা হবে। আগে একজন প্রকল্প পরিচালক ৪ থেকে ৫টি প্রকল্পের দায়িত্ব নেয়ায় অনেক প্রকল্পই বাস্তবায়িত হতো না। সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে এ কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। মন্ত্রী বলেন, বৈদেশিক সহায়তার যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে বাজেটের আকার বাড়ত। বর্তমানে বৈদেশিক সহায়তা হিসেবে পাইপলাইনে রয়েছে ২৪ বিলিয়ন ডলার। এর ২০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারলেও বাজেটের আকার বড় করা যেত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উজানচর-বাজিতপুর-অষ্টগ্রাম সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়। চলতি বছরের এ মাসের মধ্যেই শেষ হওয়ার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু যথাসময়ে শেষ হওয়া নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ হিসেবে আইএমইডি বলেছে, প্রকল্পটির চার বছর বাস্তবায়নকালীন সময়ে ৫ বার প্রকল্প পরিচালক বদলি করা হয়েছে। বারবার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন ও পূর্ণকালীন দায়িত্বে না থাকায় সুষ্ঠভাবে প্রকল্প পরিচালনায় বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও বার বার বদলি করা হয়েছে। যেমন মাঠপর্যায়ে নির্বাহী প্রকৌশলী ৩ বার পরিবর্তন হয়েছে এবং উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পরিবর্তন হয়েছে ২ বার। বার বার মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা পরিবর্তন ও পূর্ণকালীন না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজের তদারকি ও অগ্রগতির সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালকের বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্প পরিচালক বা প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বদলি এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব বড় বড় সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম। প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পিডি চলে গেলে মানুষ হয়ত বদল করা যায়, কিন্তু যে দক্ষতা ও জ্ঞান চলে যা তা বদল করা যায় না। কেননা একজন নতুন মানুষকে নিয়োগ দেয়া হলে তার শিখতে শিখতেই অনেকটা সময় চলে যায়। সূত্র জানায়, এখন থেকে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বদলিতে এ সংক্রান্ত গঠিত কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। তাছাড়া তিন বছরের আগে বড় কোন অভিযোগ প্রমাণিত না হলে পিডিদের বদলি করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে জন্যই গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে গঠন করা হয়েছে একটি কমিটিও। বছর বছর এডিপির আকার বাড়লেও স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত শতভাগ বাস্তবায়নের রেকর্ড মাত্র চার বার। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রকল্প পরিচালকদের বিশেষ সতর্কতা দিচ্ছে সরকার। প্রকল্প পরিচালক বদলিসংক্রান্ত বিষয়ে গঠিত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামালকে। এছাড়া সদস্য হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিববৃন্দ। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ঘন ঘন পিডি বদল সত্যিই আরেকটি বড় সমস্যা। সেক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার এ সিদ্ধান্ত খুবই বাস্তবসঙ্গত। তবে অনেক সময় বাস্তবতার প্রেক্ষিতে দেখা যায় পিডিরাও প্রকল্পের বাস্তবায়নে বাধা হয়ে যায়। যেমন অদক্ষতাসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সেক্ষেত্রে যেহেতু সেই ধরনের পিডিদের বদলির সুযোগ রয়েছে তাই সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়বে। প্রকল্প পরিচালক বিষয়ে গঠিত কমিটির কার্য পরিধির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। প্রথমত, পদোন্নতি বা উচ্চতর পদায়ন এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয় ছাড়া তিন বছর মেয়াদ সমাপ্তির পূর্বে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে নিয়োজিত প্রকল্প পরিচালক এবং প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বদলিসংক্রান্ত প্রস্তাব বিবেচনা করে সুপারিশ প্রদান করবে। দ্বিতীয়ত, প্রকল্প সমাপ্তির কারণে বদলির ক্ষেত্রে কমিটির নিকট প্রস্তাব উপস্থাপনের প্রয়োজন হবে না। তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে জারিকৃত নিয়োগ বা বদলি আদেশসমূহ কমিটির সুপারিশের আওতাবহির্ভূত থাকবে এবং তা সরাসরি কার্যকর হবে। চতুর্থত, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবে। প্রকল্প পরিচালকদের বিষয়ে অন্যান্য সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। তিনি জানান, এখন থেকে প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) ব্যক্তিগত পারফর্মেন্স মূল্যায়ন করে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অথবা তাকে সেই প্রকল্পের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বা বড় প্রকল্পে দায়িত্ব দেয়া হবে। এর আগে ৭০০ প্রকল্প পরিচালকদের সঙ্গে দুটি আলাদা আলাদা বৈঠকে পরিকল্পনামন্ত্রী এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন। পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, প্রকল্প অর্থব্যয়ে আমরা একটা ধারা দেখছি তা হলোÑ আমাদের প্রকল্প পরিচালকগণ সরকারী অর্থব্যয়ে যতটা স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন ঠিক ততটাই অস্বস্তিবোধ করেন বরাদ্দকৃত বৈদেশিক অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে। এটা কখনই কাম্য হতে পারে না। আমরা খুব শীঘ্রই এ সম্পর্কে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) সঙ্গে নিয়ে একটি কার্যকর পন্থা হাতে নেব। সম্প্রতি নতুন অর্থবছরের এডিপি অনুমোদনের পর সংবাদ ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, অনেকে প্রকল্পের গাড়ি ও সুযোগ সুবিধা নিতে দফায় দফায় সংশোধন করে। নতুন অঙ্গ যুক্ত করে প্রকল্পের অর্থ ও মেয়াদ বাড়ায়। এগুলো সবই ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে করা হয়। জুন মাসের পর সরকার অদক্ষ প্রকল্প পরিচালকদের সরিয়ে দেবে। এ জন্য আলাদা প্রকল্প পরিচালকদের পুল করা হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্র জানায়, দাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৯৪৬ কোটি মার্কিন ডলার অর্থ পাইপলাইনে আছে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম বৈদেশিক সহায়তার এত অর্থ জমা হওয়ার প্রেক্ষিতে অর্থ ব্যয় দ্রুত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পাইপলাইন বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য ইআরডিকে নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছে সংস্থাটি। গত ৪ জুন জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময়ও অর্থমন্ত্রী পাইপলাইনের অর্থ ব্যয়ে বিশেষ গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। ইআরডি সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্প দলিল প্রণয়ন, অনুমোদন, প্রকল্প পরিচালকের অপর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষমতা ও ঘন ঘন বদলি এবং প্রকল্পের ত্রুটিপূর্ণ ব্যয় প্রাক্কলজমি অধিগ্রহণ, পরিবেশসংক্রান্ত অনুমোদন ও কারিগরি জটিলতায় বাস্তবায়ন দেরি হয়। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব, ত্রুটিপূর্ণ ক্রয় পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া, কার্যাদেশে বিলম্ব বৈদেশিক অর্থছাড় না হওয়া অন্যতম কারণ। এ ছাড়া ভূমিগ্রহণে জটিলতাসহ কয়েকটি কারণে থমকে গেছে অনেক প্রকল্পের বাস্তবায়ন। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের অন্যতম একটি প্রকল্পের পিডি বলেন, সরকার যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে এগুলো বাস্তবায়িত হলে সবার জন্যই মঙ্গলজনক হবে। কেননা অনেক সময় প্রকল্প পরিচালকরা ভাল কাজ করতে চাইলেও পারেন না। কেননা নানা ধরনের সমস্যা থাকে। যেমন পিডি যদি জানেন কোন দুর্নীতি না করলে তাকে তিন বছরের আগে বদলি করা হবে না, তাহলে তিনি মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারবেন। তাছাড়া প্রকল্প পরিচালকের পুল গঠনের বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক ও বাস্তবসম্মত। দক্ষ লোকজনকে মূল্যায়ন করলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন অবশ্যই ভাল হবে।
×