ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পারিবারিক বলয়ের দাপট বাড়ছে মন্ত্রী এমপিদের

ফাঁকা মাঠেও আওয়ামী লীগ শ্রীহীন, নেতাকর্মীরা ব্যবসায়

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৪ জুন ২০১৫

ফাঁকা মাঠেও আওয়ামী লীগ শ্রীহীন, নেতাকর্মীরা ব্যবসায়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সর্বত্রই ফাঁকা মাঠ! রাজপথে নেই রাজনৈতিক শক্ত প্রতিপক্ষ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষহীন রাজনীতির ফাঁকা মাঠেও যেন শ্রীহীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ! প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াত জোটকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করার পর যখন কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক কর্মসূচী নিয়ে সারাদেশে শাসক দলটির দাপিয়ে বেড়ানোর কথা, বাস্তব চিত্র ঠিক যেন তার উল্টো। সাংগঠনিক কাজে কোন মন নেই দলটির অধিকাংশ নেতার। ফাঁকা মাঠে সবাই ব্যস্ত এখন নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। সর্বত্রই দলের চেয়ে ব্যবসাই এখন যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের। এতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেদিকে যেন দেখার কেউ-ই নেই। সন্ত্রাস-নাশকতানির্ভর রাজনীতির পথে গিয়ে বিএনপি এখন খাদের কিনারায়। বিএনপির সন্ত্রাস-জঙ্গীনির্ভর প্রধান রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত এখন রয়েছে অস্তিত্বের সঙ্কটে। রাজপথে রাজনৈতিক কৌশলে বিএনপি-জামায়াতকে পরাজিত করে এখন অনেকটাই ফুরফুরে মেজাজে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আর এই ফুরফুরে মেজাজই সময়ের ব্যবধানে এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে দলটিতে। হঠাৎ করেই যেন নিষ্ক্রিয়, নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত সর্বত্রই দলটির নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক কাজে কোন মন নেই। দলটির বেশিরভাগ নেতারাই এখন ব্যস্ত নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যে, অর্থ-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির দিকে। এ সুযোগে দলটিতে থাকা চিহ্নিত ও সুযোগসন্ধানীরাও যেন অনেকটাই বাধাহীনভাবে তদ্বির, টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি এমনকি খুনোখুনীতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপি-জামায়াতের ভয়াল সন্ত্রাস-নাশকতা ঠেকাতে সারাদেশেই শাসক দলটিতে যে ‘চেন অব কমান্ড’ গড়ে উঠেছিল, রাজনৈতিক সুসময়ে তা যেন অতীতের চেয়েও বেশি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। কেন্দ্র থেকে মাঠের নেতাদের দলের চেয়ে ব্যবসাই এখন যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। এতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমের খোঁজ নিতে গিয়ে এমনই দৈন্যদশা পাওয়া গেছে। বছরের শুরুতে অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি থেকে একটানা ৯২ দিন অবরোধ-হরতালের নামে সারাদেশে ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞ, নাশকতা চালায় বিএনপি-জামায়াত জোট। জোটটির অগ্নিসন্ত্রাসে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় প্রায় আড়াই শতাধিক মানুষ। এই টানা তিন মাস উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত দেশের মানুষ দেশের পরবর্তী ভবিষ্যত নিয়েই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিএনপি-জামায়াত জোটের সেই দেশবিধ্বংসী অপতৎপরতা ও ষড়যন্ত্র অত্যন্ত সফলতার সঙ্গেই নস্যাত করে দিতে সক্ষম হন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দক্ষতার সঙ্গেই সবকিছু সামাল দিয়ে দেশকে আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনায় দেশ-বিদেশে প্রশংসিতও হন তিনি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাছে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়েই গত ৭ এপ্রিল শূন্যহাতে গুলশানের দলীয় কার্যালয় থেকে ঘরে ফিরে যান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এরপর আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি তার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট। গত সোয়া দু’মাসে রাজনৈতিক কর্মসূচী তো দূরের কথা, সামান্য কর্মসূচী নিয়েও মাঠে দেখা যায়নি বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতাকর্মীদের। রাজধানী থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কিছু মাঠকর্মী কিংবা সমর্থক ছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোটের বড় বড় নেতাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। খোদ আওয়ামী লীগের সকল পর্যায়ের নেতারাই অকপটে স্বীকার করছেন, এমন অনুকূল ও ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবেশ অতীতে কখনও পায়নি আওয়ামী লীগ। মাঠে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই, রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করারও কোন বিষয় নেই। রাজনৈতিকভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট এমনভাবেই পরাজিত হয়েছে যে, আগামী দু’চার বছরের মধ্যে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনই সম্ভাবনা নেই। এমন অনুকূল পরিবেশকেও দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সাংগঠনিকভাবে কাজে লাগাতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করছেন দলটির মাঠের ত্যাগী ও আদর্শিক নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, বিএনপি-জামায়াত জোট রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হলেও তাদের কর্মী-সমর্থক রয়েছে। যে কোন সময় তারা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ৭ এপ্রিলের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের উচিত ছিল সারাদেশে একের পর এক কর্মসূচী দিয়ে নেতাকর্মীদের সংঘটিত, উজ্জীবিত ও শক্তিশালী করা। পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোটের ৯২ দিনের ধ্বংসাত্মক কর্মকা- দেশের সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরে দলীয় সমর্থন বৃদ্ধি করা। কিন্তু তার কিছুই করা হয়নি। বরং সাংগঠনিক কোন কর্মসূচী না থাকার কারণেই আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী এখন সংগঠনের চেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকেই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছেন। এখনই শক্ত হাতে দলের এই নাজুক অবস্থার লাগাম টেনে ধরতে না পারলে, আবারও আওয়ামী লীগকে বড় ধরনের মাসুুল গুনতে হতে পারে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এখন সাংগঠনিক কাজে মন নেই। অধিকাংশ নেতারাই ব্যস্ত নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানা অনৈতিক কর্মকা-ে। কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা সর্বত্রই একই চিত্র। বেশিরভাগ স্থানেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকায় দলের নেতাকর্মীদের পরিবর্তে এলাকায় মন্ত্রী-এমপিদের পারিবারিক বলয়ের দাপটই যেন হঠাৎ করে বেড়ে উঠেছে। এমনকি গত ছয় বছরে ব্যবসা ও অর্থসংক্রান্ত কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের মধ্যে মারামারি, হানাহানি, সংঘর্ষ এমনকি খুনোখুনীর বিষয় ছিল নিয়মিত বিষয়। দেখা গেছে, কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলায় মন্ত্রী-এমপির ভাই-সন্ত্রাস কিংবা আত্মীয়স্বজন পরিচয়ে হেন কোন অনৈতিক কর্মকা- নেই, যাতে তারা জড়িয়ে পড়েননি। আর এ প্রতিযোগিতায় বরাবরের মতোই পিছিয়ে দলটির ত্যাগী ও আদর্শিক নেতাকর্মীরা, যারা প্রাণবাজি রেখে বিএনপি-জামায়াতের ভয়াল সন্ত্রাস মাটি কামড়ে থেকে মোকাবেলা করেছে, মাঠে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকায় আবারও তারা সর্বত্রই অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছে। মাঠে রাজনীতি না থাকায় তাদের যেন কোনই মূল্যে নেই। দলের এই সুসময়ে মন্ত্রী-এমপিদের আশীর্বাদপুষ্ট আওয়ামী লীগের পরিচয়দানকারী আদর্শহীন ও সুযোগসন্ধানীদের দাপটে দলের ত্যাগী ও আদর্শিক নেতারা কার্যত অসহায় অবস্থাতেই তাদের সবকিছু মেনে নিতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগের ভুক্তভোগী ও আদর্শিক কয়েকজন তৃণমূল নেতা মাত্র দুটি উদাহরণ তুলে ধরেই সারাদেশে দলের শ্রীহীন অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। তাদের মতে, দলের কোন সাংগঠনিক শৃঙ্খলা না থাকার কারণেই সম্প্রতি ফেনীতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর সমর্থক যুবলীগ-ছাত্রলীগের প্রায় ১৭ নেতাকর্মীর বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। এমপি তার নিজস্ব ক্ষমতা ও দাপট টিকিয়ে রাখতেই সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত করছেন। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা পিনু খান এমপির ছেলে বখতিয়ার আলম রনির গভীর রাতে মদ্যপ অবস্থায় শুধু যানজট থাকার অপরাধে নির্বিচারে গুলি করে এক রিক্সা চালক ও আরেক বেবিট্যাক্সি চালককে হত্যা করেছে। এ দুটি ঘটনায় আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ করলেও কেন্দ্র থেকে কোনই সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। শুধু ঢাকা কিংবা ফেনীতেই নয়, দেশের অধিকাংশ জেলাতেই মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভাব-প্রতিপত্তি অক্ষুণœ রাখার প্রতিযোগিতায় দলের সাংগঠনিক বিপর্যয় ও সুনাম ক্ষুণœ হলেও দেখার যেন কেউ-ই নেই। জানা গেছে, দলের এমন শ্রুীহীন অবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর দারুণ ক্ষোভ মাঠের তৃণমূল নেতাদের। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দলে কখনও সক্রিয়, কখনও নিষ্ক্রিয়। গত ছয় বছরেও তৃণমূল নেতারা তার দেখা পান না। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে অনেক নেতাই রয়েছেন যারা নিষ্ক্রিয়, গণবিচ্ছিন্ন ও কর্মীবিমুখ। এমনকি নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকাতেও তাদের কদর নেই। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ছাড়া অনেকের দেখা মেলে না সাংগঠনিক কাজে। দলের সুসময়ে এখনই দলের সুনাম ধ্বংসকারী এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অনৈতিক কর্মকা-ে লিপ্ত মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের চিহ্নিত করে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তৃণমূলে এখন থেকেই নানা কর্মসূচী নিয়ে না নামলে আগামীতে বড় ধরনের কোন ধাক্কা সামালানো আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে বলেই মনে করেন দলটির তৃণমূল ত্যাগী নেতারা।
×