ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

জল, বায়ু আর পাখির কোন পাসপোর্ট ভিসা লাগে না

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১৩ জুন ২০১৫

জল, বায়ু আর পাখির কোন পাসপোর্ট ভিসা লাগে না

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি গত সপ্তাহে বাংলাদেশে দু’দিনের সফর করে গেলেন। কোন বিদেশী সরকারপ্রধানের বাংলাদেশ সফর বিষয়টি পর্যালোচনা করলে নিঃসন্দেহে বলতে হবে মোদি সাহেব ভারতের জন্য যা নিয়ে গেছেন তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি দিয়ে গেছেন বাংলাদেশকে। এসবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী কূটনৈতিক সাফল্যে। মোদি দুই দেশের সীমান্ত রেখা সঙ্কট এত সুন্দরভাবে গোটা ভারতের ১২৫ কোটি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সমাধান করে দিলেন এমন উদাহরণ আর আছে কিনা আমার জানা নেই। তিনি এ সঙ্কট সমাধান করে দিলেন এ জন্য যে, এটি মূলত ভারতের জন্যই এতদিন আটকে ছিল। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্থলসীমান্ত রেখা বিরোধ মেটাতে ১৯৭৪ সালে যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, যা ঐতিহাসিকভাবে ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’ নামে খ্যাত তা বাংলাদেশের পার্লামেন্টে সঙ্গে সঙ্গে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারত তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মতদ্বৈধতার জন্য অনুমোদন করাতে পারেনি। এরই মধ্যে ৪১ বছর পার হয়ে গেছে। শ্রী মোদি প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ছোট দেশ হলেও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ইস্যুতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এটা বুঝতে তার সময় লাগেনি। তাছাড়া মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই স্বাদেশিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে তবেই প্রতিবেশী দেশগুলো সফর করা শুরু করলেন। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশে আসার আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা ছিল স্ফটিকের মতো পরিষ্কার। তিনি খালেদা জিয়াকে চিনতেও ভুল করেননি। তাকে সাক্ষাত দিয়েছেন সত্য, তবে ‘আমরা কোনদিন ভারতবিরোধী ছিলাম না, এখনও নই, ভবিষ্যতেও ভারতবিরোধী হব না’ এ কথাগুলো যে একটু কাছে যাওয়ার জন্য তা মোদির কাছেও স্পষ্ট হয়েছে। মোদি সাহেবও রসিক বটে, বলেছেন ভারত বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ। সেই সুবাদে ভারত চায় প্রতিবেশী দেশগুলোতেও গণতন্ত্র কাজ করুক, তবে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতাবাদ কোনভাবেই ভারত টলারেট (সহ্য) করবে না। মেসেজটি অত্যন্ত পরিষ্কার- ‘ভাল হয়ে যাও।’ অবশ্যই এটা কেবল মোদি বাবুর কথা নয়। এমন কথা বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং স্থায়ী কমিটির মিলিটারি সদস্য লে. জে. মাহবুবুর রহমান। তারা দু’জনই বলেছেন, খালেদাকে দিয়ে আর হবে না। আমার প্রশ্ন, কবেইবা হয়েছিল? বরং বলেছিলাম এই ভদ্র মহিলা যত দ্রুত বিদেয় হবেন ততই বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য মঙ্গল। বাংলাদেশের শিল্প, সংস্কৃতি, অর্থনীতির জন্য মঙ্গল। কারণ এই মহিলা কোনভাবেই একটি দেশের কর্ণধার হতে পারেন না। তাকে অনুসরণ করার মতো কিছু নেই। ভাষাগত দৈন্যের কারণে তিনি কোন বিদেশীর সঙ্গে দেশের স্বার্থে কথা বলার যোগ্য নন। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানেন না। নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ শিশু-কিশোররা তার কাছ থেকে কি শিখবে? আর সে জন্য বেশ আগে থেকেই বলেছি তার রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া উচিত। তাছাড়া তার নিজের যখন রাষ্ট্র পরিচালনা বা সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে অন্যের সাহায্যই নিতে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, তাও আবার দেশদ্রোহী-জাতিদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীদের কাছ থেকে কিংবা মনোজগতে এখনও পাকিস্তান এবং মিলিটারি, তাকে তো নেতা বানানো বা নেতা মানাও দেশদ্রোহিতা বলে আমি মনে করি। এতক্ষণ আমি যে কথাগুলো বললাম তার সবই শ্রী মোদি ভাল করেই জানেন। শিক্ষিত মানুষ তিনি। তাই তো খালেদা জিয়া দেখা করে যখন বাজারের গুজব থেকে বলছি, তার ছেলে তারেকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার নথিপত্র দেখালেন, তখন মোদি সাহেব হেসেছিলেন নিশ্চয়ই। এই তারেক, মিলিটারি পুত্রের ব্যাপারেও মোদি কম জানেন না। যখন খালেদা তা তুলে ধরলেন তখন মোদি খালেদাকে তার নেতৃত্বের সাইজকে চূড়ান্তভাবে মেপে নিলেন। বললেন, আপনার সময়ই তো নাকি ১০ ট্রাক অস্ত্র চট্টগ্রাম হয়ে আপনার দেশের ভেতর দিয়ে সন্ত্রাসীদের জন্য ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পাঠানো হচ্ছিল। আপনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সে দায় কি এড়াতে পারেন? আপনার দুই মন্ত্রী যখন ফেঁসে গেছেন তখন আপনি কিভাবে দাবি করলেন কিছু জানেন না। এসব জানলাম ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক মানস ঘোষের রিপোর্ট থেকে। দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক ও কলামিস্ট স্বদেশ রায় শ্রী মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতে কি কি কথা হয়েছে তারই সব বলে দিয়েছেন। মোদি সাহেব বেগম খালেদা জিয়াকে প্রশ্ন করেছেন, ১০ ট্রাক অস্ত্র চালানের সঙ্গে আপনার দুই মন্ত্রী যেহেতু জড়িয়েছে, সেহেতু আপনার কাছেও তথ্য আছে বা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। আপনি কি সে সব তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন? প্রিয় পাঠক, বোঝেন ঠেলাটা। আরেকটি প্রশ্ন ছিলÑ পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে যে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হলো তাতেও তো খালেদার দল ও জোটের এক কথায় জামায়াত ও তাদের সন্ত্রাসী গ্রুপ জড়িত। খালেদা কি তাদের আইনের আওতায় আনতে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে অথবা যেভাবেই হোক সহযোগিতা দেবেন? জানি না, এসব প্রশ্নের পর আমাদের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চেহারা-সুরতের অবস্থা কি হয়েছিল, তা কোন অঙ্কন শিল্পীর পেন্সিলে আনা গেলেই কেবল বোঝা যেত। সে সুযোগ তো নেই। তবে এটুকু বলতে পারি ভাল ছিল না। তবে এক শ্রেণীর মিডিয়া কিন্তু ভীষণ উৎফুল্ল ছিল। তারা মূর্খতার কারণেই হোক আর মতলববাজির কারণেই হোক বারবার বলেছিলেন ‘আজ খালেদা জিয়ার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাত’ বা ‘আর কিছুক্ষণ পরই নরেন্দ্র মোদি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করবেন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আমাদের মিডিয়ার শিষ্টাচারের স্ট্যান্ডার্ড। বস্তুত, এটাই বিএনপি আর তার নেতানেত্রীদের স্ট্যান্ডার্ড এবং মনোজগত। আমাদের মনে আছে ১৯৭৭ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও তার দল ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে যান। প্রধানমন্ত্রী হন শ্রী মুরারজী দেশাই। ঐ বছরেরই শেষের দিকে তিনি বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং বাংলাদেশে পা রাখার আগেই ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় পবিত্র কোরানের আয়াত ও হাদিসে রসূল (স.) সংবলিত যত বিলবোর্ড ছিল সব সরিয়ে ফেলা হয়। এতে কি মেসেজটি দেয়া হয়েছিল? মেসেজটি দেয়া হয়েছিল, আসলে আওয়ামী লীগাররা আমাদের যত ধর্মান্ধ-মৌলবাদীই বলুক আমরা তা নই, আমরা তোমাদের (ভারতীয়দের) মতোই সেক্যুলার। এমন বালখিল্য কাজ করেছিল বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং জিয়াউর রহমানই। একবারও তার মাথায় ঢোকেনি যতই বিলবোর্ডগুলো সরানো হোক ঢাকায় অবস্থানরত ভারতীয় হাইকমিশন বা মিলিটারি উইং কি তা দেখেনি? বলে রাখা ভালÑ দু’বছর পরই মধ্যবর্তী নির্বাচনে শ্রীমতী গান্ধী পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন। শুনেছি মিলিটারি জিয়াকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং গায়ের চামড়ার রংয়ের সঙ্গে ম্যাচ করা স্যুট পরে জিয়া ভারত সফরে যান, দিল্লীতে তাকে নাকি লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। কি নিয়ে ফিরে এসেছিলেন জানি না। খালেদাকেও নাকি লালগালিচা অভ্যর্থনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি জিয়ার সময়ও আলোচনায় আসেনি, খালেদা দেশে ফিরলে সাংবাদিকগণ গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির ব্যাপারে প্রশ্ন করলে বলেছিলেন- ‘ওহ হু, সে তো আমি ভুলেই গেছিলাম।’ জানিয়ে রাখি ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই শুষ্ক মৌসুমে ৩৩ হাজার কিউসেক পানি হিস্যা আদায় করে ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তি করেন, ৩০ বছর পরও নতুন চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত অটোমেটিক চলতে থাকবে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হতেও বেশি দেরি হবে না বলে মনে হয়। মনে হয় কি? আমরা ধরেই নিতে পারি। মোদি নিজেই বলছেন, ‘তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিও হবে, তবে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।’ সবচেয়ে বড় কথা যেটি শ্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন ‘জল, বায়ু, পাখির কোন পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে যেতে।’ এই মেসেজটি যারা বোঝে না তাদেরই বলা হয় কান থাকতেও বধির। নরেন্দ্র মোদির এই সফরে আমরা যে স্বস্তিটুকু পেয়েছি তা হলো, তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি শতকরা ১০০ ভাগ আস্থাশীল। তিনি মনে করেন, বিশ্বাস করেন, আমাদের এ অঞ্চলসহ সারাবিশ্বে আজ ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে দেশে দেশে যে জঙ্গীবাদ আতঙ্কবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তা দমনে শেখ হাসিনার ভূমিকাকে তিনি সমর্থন দিয়েছেন। তিনি জঙ্গী দমনে শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্সকে সমর্থন জানিয়েছেন ও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। একই সঙ্গে জঙ্গী দমনের পাশাপাশি এ অঞ্চলের এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থলপথে যাওয়া-আসা, আমদানি-রফতানিতে ভারসাম্য রক্ষা, তথা উভয় দেশের বিদ্যুত, অবকাঠামো উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে পাশাপাশি হাঁটার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, যে মানুষ সাগরে ভাসছে তার বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। বস্তুত, নরেন্দ্র মোদির সফর বাংলাদেশকে যেমন স্বস্তির পরিবেশ উপহার দিয়েছে, তেমনি বিএনপি ও তার জোটকে ‘ভাল হয়ে যাবার’ পরামর্শ দিয়েছে। এটা সতর্কও বলা যেতে পারে। ঢাকা ॥ ১২ জুন ২০১৫ লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব
×