ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফজলুল বারী

সাগরে কেন যায়, সাগর দিয়ে কী করে যায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১২ জুন ২০১৫

সাগরে কেন যায়, সাগর দিয়ে কী করে যায়

সিডনির লাকেম্বাকে বলা হয় অস্ট্রেলিয়ায় এক খ- ছোট্ট বাংলাদেশ। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বসতভিটা, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান এ এলাকায় বেশি। এই লাকেম্বার একটি এলাকার নাম এখন হয়ে গেছে রোহিঙ্গা কর্নার। মসজিদের পাশের ওই এলাকাটিতে গেলে দেখা যায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনেক সদস্য এক সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। এদের নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা আছে এদেশে, এই সমাজে। প্রচলিত একটা ধারণা, সাগরভাসা এই মানুষেরা বাংলাদেশী পরিচয়ে এদেশে এসেছিল। কিন্তু সবকিছুর উর্ধে যে সত্য তা হলো এরা সবাই অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিল সাগর দিয়ে অবৈধভাবে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এসেই এরা লাকেম্বায় পৌঁছে যায়নি। মাঝখানে আছে অনেক অনেক ঝুঁকি আর কষ্টের গল্প। এদের দীর্ঘদিন জেলে কাটাতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। অবৈধভাবে যে কেউ যে কোন দেশে গেলে তার যে প্রথম গন্তব্য জেল তা সাগর দিয়ে বাংলাদেশের যারা অবৈধ পথে বিদেশ রওয়ানা হচ্ছে তাদের সিংহভাগ জানেও না। তারা যে জানে না এই ব্যর্থতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এবং মিডিয়ার। কারণ এরা তো কোন চোর-ডাকাত না। কাজের মানুষ। কাজ করে উপার্জন করে নিজেরা ভাল থাকার, পরিজনদের ভাল রাখার স্বপ্ন তারা দেখেছিল। বিদেশ গেলে ভাল থাকা যায় এটা তাদের কমন স্বপ্ন। কিন্তু কিভাবে গেলে ভালো থাকা যায়, অবৈধভাবে গেলে যে ভালো থাকা যায় না, এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য রাষ্ট্র এবং মিডিয়া তাদের কাছে যথাযথ পৌঁছে দেয়নি বা পৌঁছে দিতে পারেনি। সোনার হরিণ বিদেশের স্বপ্ন তাদের কাছে যারা নিয়ে গেছে তারা হয় দালাল, না হয় দালালদের বেতনভুক কর্মচারী। তারা যে সত্য বলে না তা জানার বা তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ অথবা মেধা এদের থাকে না বা ছিল না। লোভও তাদের পেয়ে বসেছিল। দালাল বলে দিয়েছিল এসব যাতে তারা কাউকে না বলে। তাই এভাবে তারা যে গোপনে দেশ ছেড়েছে তা তাদের অনেক প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবও জানত না। বাংলাদেশের মানব পাচার ট্র্যাজেডি নিয়ে এখন যত গল্প বেরুচ্ছে, এর সঙ্গে যে কথা বলা হচ্ছে না তা হলো এর সঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে একটা দেশের দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দালালরা সারাদেশ থেকে এভাবে মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে হাজার হাজার লোক জোগাড় করে ফেলল, দেশজুড়ে এত হাজার হাজার পুলিশ-গোয়েন্দা এসবের কিছুই আগাম জানেনি তা কী হয়? এলাকায় এলাকায় এত গ্রাম পুলিশ, ইউপি-পৌরসভার মেম্বার-কাউন্সিলর, রাজনৈতিক কর্মী, থানার দালাল, তাদের কেউ কিছু জানেনি, তা কী করে সত্যি হয়? হাজার হাজার লোক সাগর দিয়ে বেরিয়ে গেছে, কক্সবাজার-টেকনাফ বেল্টের পুলিশ-প্রশাসন-গোয়েন্দা, র‌্যাব-বিজিবি-কোস্টগার্ড তারা নিশ্চয় সবাই অন্ধ-বধির নয় যে, তা কেঊ টের পায়নি! এর দায়-দায়িত্ব কী আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এড়াতে পারে? কারণ এরা সবাই মিলে আজ বাংলাদেশের বৈধ জনশক্তি রফতানিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিদেশে আমাদের জনশক্তির বিপুল চাহিদা আছে। কিন্তু যারা তার দেশে অবৈধভাবে যেতে চায়, কে আর তাদের বৈধভাবে নিতে চাইবে? পাচারের সঙ্গে জড়িত ১২ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে মালয়েশিয়ায়। থাইল্যান্ড গ্রেফতার করেছে এক পদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে। কিন্তু বাংলাদেশে গ্রেফতার হচ্ছে শুধু কিছু পাচারকারী। তাদের কয়েকজনকে আবার ক্রসফায়ারে দেয়া হয়ে॥ে এরা জীবিত থাকলে কী বলে দিত কোন্্ কর্মকর্তাকে কত টাকা দিয়েছিল? এভাবে সর্ষের ভেতর ভূত রেখে কিন্তু বাংলাদেশের এই অপরাধ নির্মূল হবে না। কাজের খোঁজে বিদেশ যাওয়া বাংলাদেশ অঞ্চল বা দুনিয়ার যে কোন দেশে নতুন না। কাজের খোঁজে রেঙ্গুন যাত্রার তথ্য আছে শরৎচন্দ্রের গল্পে-সাহিত্যে। ১৯৯৭ সালে মিসরে গিয়ে দেখি অফিসে-আদালতে পুরুষের চেয়ে মহিলা বেশি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি দেশটির কর্মক্ষম পুরুষ জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ বেশি বেতনের লোভে বিভিন্ন আরব দেশে চলে গেছে। লেবাননে গিয়ে বৈরুতে কয়েক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশীকে দেখে চমকে উঠি! এদের অনেকে আসলে তুরস্ক-গ্রীস হয়ে ইউরোপে যাবার উদ্দেশে লেবানন গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ায় সেখানেই থিতু হয়ে যায়। এভাবে নানা দেশের প্রবাসীদের নানা কাহিনী আছে। আমাদের অঞ্চলের লোকজন প্রথম বিলাতে পাড়ি জমান ব্রিটিশ যুগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের অনেকে ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণও হারিয়েছেন। তাদের নিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ আছে বিলাতে। এদের বেশিরভাগ ছিলেন কলকাতা বন্দরের খালাসি। পাকিস্তান আমলে মূলত এই নিহত যোদ্ধাদের স্বজনদের খোঁজে ব্রিটিশ সরকার টিম পাঠিয়েছিল। মূলত তখন তাদের উদ্যোগেই তাদের স্বজনদের বিলাতে নিয়ে যাওয়া হয়। আজকের বিলাতের বাংলাদেশী কমিউনিটির বড় অংশ তাদের উত্তরসূরি। কিন্তু স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে বিদেশযাত্রার একটি চরিত্রের নাম হয় দুবাইওয়ালা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সঙ্গীতের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষের গানেও এই দুবাইওয়ালা চরিত্রটি আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর অঞ্চলে খুলেছিল আমাদের জনশক্তি রফতানির বাজার। সিঙ্গাপুরে এক সময় বাংলাদেশের যে কেউ ট্রানজিট ভিসায় চলে যেত। কিন্তু সে বিশ্বাসটি আমরা অটুট রাখতে পারিনি। শুধু সৌদি আরবেই বৈধ-অবৈধভাবে বাংলাদেশের ২০ লক্ষাধিক মানুষ আছে। কিন্তু বিস্তর লোকজন উমরা ভিসায় সৌদি আরব গিয়ে ফিরে না আসায় বাংলাদেশের সে দেশের শ্রমবাজারও প্রায় বন্ধ। এখন প্রায় বন্ধ মালয়েশিয়ার বাজারও। কারণ সাগর দিয়ে এবং নানা অবৈধভাবে আমাদের বিস্তর লোক দেশটিতে ঢুকে পড়েছে। আরেক কারণে বাংলাদেশের অনেক বৈধ মানুষ বিদেশে গিয়ে অবৈধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে আদম বেপারিরা এক সময় ফ্রি ভিসা নামের অবৈধ এক ব্যবসার পসার খুলেছিল। বিদেশে যে কোন বৈধ জনশক্তি রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজের একটি ওয়ার্ক পারমিট জড়িত। ফ্রি ভিসা নামের কোন ভিসা কোথাও নেই। মূলত টুরিস্ট ভিসাকে আদম বেপারিরা ফ্রি ভিসা নাম দিয়ে লোকজন বিদেশ পাঠিয়েছে। টুরিস্ট ভিসা যে কোন দেশে বেড়াতে যাবার ভিসা। এর সঙ্গে ওয়ার্ক পারমিট বা কাজের অনুমতি সংশ্লিষ্ট নয়। না বুঝে না জেনে এই ফ্রি ভিসায় গিয়েও অনেকে বিদেশে অবৈধ হয়ে গেছে। বিদেশে যে কোন কাজের সুযোগ বা সংশ্লিষ্ট দেশের আইন-কানুন অনলাইনে জানা যায়। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষিত শ্রমগোষ্ঠীর সিংহভাগ যেখানে অনলাইনে সার্চ-রিসার্চে অভ্যস্ত না, সেখানে গ্রামের আমজনতার কাছে তা আশা করাটা বাতুলতা মাত্র। এই কাজটি করতে তথা দেশের বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমশক্তিকে সে সাপোর্ট দিতে পারত রাষ্ট্র এবং মিডিয়া, তা তারা করতে পারেনি। যে কথা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বলা হয়নি মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডও এমন কোন উন্নত দেশ না। তাদের দেশ থেকেও লোকজন কিন্তু নৌকায় করে অস্ট্রেলিয়া যাবার চেষ্টা করে। এতদিন ধরে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড হয়ে ইন্দোনেশিয়াকে ট্রানজিট করে পাচারকারীদের মূল গন্তব্য ছিল কিন্তু অস্ট্রেলিয়া কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান সরকার সে পথ কড়াকড়ি করে বন্ধ করে দেয়ায় সে গন্তব্যটি এখন বন্ধ। মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডের জেলখানাগুলো এমন লোকজনে ভর্তি হওয়ায় তারাও আর এসব ঝামেলা নিতে চাইছে না। থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া যখন এসব নৌকা ভিড়তে দিচ্ছিল না তখন অনেকে হৈ হৈ করছিল। কিন্তু এদের অনেকে হয়ত যে তথ্যটি জানেন না তা হলো, এসব দেশ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ে স্বাক্ষর করেনি। কাজেই এসব লোককে আশ্রয় দিতে এরা বাধ্য না। বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষর করেছে বলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এখন আর কাউকে আশ্রয় দিতে চাইছে না। এই লোকগুলোকে সাময়িক আশ্রয় দেয়ার সঙ্গে বিস্তর অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত বলে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়াও প্রথমে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। জাতিসংঘ বলার পর আশ্রয় দিচ্ছে। কারণ এখন এদের খরচ জাতিসংঘ দেবে। (চলবে)
×