ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ওমরাহ হজে গিয়ে সাড়ে ৮ হাজার হাজী দেশে ফেরেননি

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১০ জুন ২০১৫

ওমরাহ হজে গিয়ে সাড়ে ৮ হাজার হাজী দেশে ফেরেননি

আজাদ সুলায়মান ॥ ওমরাহ হজের নামে মানব পাচারকারী হজ এজেন্সির বিরুদ্বে মানবপাচার আইনে মামলা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ধরনের মানবপাচারে কত হজ এজেন্সি জড়িত তা খতিয়ে দেখার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে হজ এজেন্সির সংগঠন হাব নেতাদের মধ্যে মামলা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জনকণ্ঠকে জানান, মানবপাচার মামলা করার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ আইনে মামলা করার প্রতিক্রিয়া কি হবে সেটাও বিবেচনা করা হচ্ছে। ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। জানা যায়, গত বছর ওমরাহ মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে ৫১ হাজার ৩২১ জন ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরব যান। এদের বেশিরভাগকেই ত্রিশ দিনের ভিসা দেয়া হয়। বিধি মোতাবেক ওমরাহ শেষে তারা ফিরে আসবে এমন অঙ্গীকার দিয়েই সৌদি যায়। পরে দেখা গেছে নির্দিষ্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হবার আগেই দেশে ফিরেছেন ৪২ হাজার ৭৬৮ জন। বাকি ৮ হাজার ৫৫৩ দেশে ফিরেননি। এতসংখ্যক হাজি দেশে ফিরেননি এটা গোপনই থাকে। সংশ্লিষ্ট হজ এজেন্সি এদের ফেরত আনার বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়নি। উপরন্তু বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার কৌশল অবলম্বন করে অভিযুক্ত হজ এজেন্সিগুলো। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক উপসচিব মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে জানান, এই বিপুলসংখ্যক হাজি দেশে ফিরেনি এটা ততক্ষণ পর্যন্ত ফাঁস হয়নি যতক্ষণ পর্যন্ত না সৌদি আরবের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগসহকারে ঢাকায় চিঠি পাঠানো হয়। তখন সবাই হতবাক। বাংলাদেশ ধর্ম মন্ত্রণালয়কে চিঠির মাধ্যমে কালো তালিকাভুক্ত এসব হজ এজেন্সির নাম পাঠানো হয়। জানা যায়, এজেন্সিগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ৩০ থেকে ৭০ জন পর্যন্ত হাজি ফিরে আসেনি। এ হিসেবে প্রায় ৭ হাজারের মতো ফেরত আসেনি। তবে এ বিষয়ে হাব সভাপতি ইব্রাহিম বাহার জনকণ্ঠকে বলেন-আমরাও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চেয়েছি প্রকৃত সংখ্যাটি কত। এখনও মন্ত্রণালয় সেটা জানাতে পারেনি । শোনা যাচ্ছে সৌদি আরব সরকারের পাঠানো হিসেবে এটা কিছুুতেই চার হাজারের বেশি হবে না। সূত্র জানায়, গত ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে তারা সৌদি আরব যান। আর সেটা সৌদি আরব সরকার অবগত হয় এ বছরের এপ্রিল মাসে। তখনই বাংলাদেশকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশী হজযাত্রীদের ব্যাপারে কঠোর সতর্ক অবস্থান নেয় সৌদি সরকার। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এ বছর সৌদি সরকার হঠাৎ ওমরাহ বন্ধ করে দেয়ায় সরকারও কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। এ নিয়ে গণমাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা দেখা দেয়। এতে সরকার কয়েক দফা সৌদি আরবে একাধিক টিম পাঠিয়ে ওমরাহ জটিলতা নিরসনের জন্য চেষ্টা চালায়। কিন্তু সৌদি সরকার সুস্পষ্ট জানিয়ে দেয়, সৌদিতে পালিয়ে থাকা হাজিদের ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত ওমরাহ চালু করা হবে না। তারপরই টনক নড়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের। এ জটিলতা নিরসনে হাব নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও একাধিক বৈঠক ডাকা হয়। কিন্তু হাব তার দায়ভার স্বীকারই করেনি। এ অবস্থায় গত সোমবার মন্ত্রণালয়ের এক সাংবাদিক সম্মেলনে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানান, দায়ী ব্যক্তি যেই হোক, ছাড় দেয়া হবে না। কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ সময় তিনি দায়ী হজ এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে মানবপাচারের আইনে মামলা করার নির্দেশ দেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমন বেশ সুস্পষ্ট করেই বলেন-অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনেই মামলা করতে হবে। হজে পাঠানোর পর ফেরত আনতে না পারাটা তো মানবপাচারেরই সমান। এ জন্য মামলাও হবে মানবপাচার আইনেই। এজন্য দায়ীদের কিছুতেই ছাড় দেয়া হবে না। এদিকে ধর্মমন্ত্রীর এ কঠোর মনোভাব অনুযায়ী হজ এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা করার যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। প্রভাবশালী কর্মকর্তারা সংশয় প্রকাশ করেছেন, মানবপাচার আইন এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় কিনা, সেটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ সম্পর্কে ২০১২ সালের মানবপাচার আইনের সংজ্ঞায় দেখা যায়, প্রথম অধ্যায়ে ৩ (১) ধারায় বলা হয়, ‘মানবপাচার’র অর্থ কোন ব্যক্তিকে-(ক) ভয়ভীতি প্রর্দশন বা বলপ্রয়োগ করিয়া; বা (খ) প্রতারণা করিয়া বা উক্ত ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক বা পরিবেশগত বা অন্য কোন অসহায়ত্বকে (াঁষহবৎধনরষরঃু) কাজে লাগাইয়া; বা (গ) আর্থ বা অন্য কোন সুবিধা (শরহফ) লেনদেনপূর্বক উক্ত ব্যক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ রহিয়াছে এমন ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ করিয়া; বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে যৌন শোষণ বা নিপীড়ন বা শ্রম শোষণ বা অন্য কোন শোষণ বা নিপীড়নের উদ্দেশে বিক্রয় বা ক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকাইয়া রাখা বা আশ্রয় দেওয়া। এই ধারায় ব্যাখায় বলা হয়- ব্যাখ্যা। এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, যদি কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে প্রতারণার মাধ্যমে, অসৎ উদ্দেশে এবং বাধ্যতামূলক শ্রম, ধারা-২ এর উপধারা (১৫) এ বর্ণিত কোন শোষণ বা নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির শিকার হইতে পারে মর্মে জানা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোন ব্যক্তিকে কাজ বা চাকরির উদ্দেশ্যে গমন, অভিবাসন বা বহির্গমন করিতে প্রলুব্ধ বা সহায়তা করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির উক্ত কর্ম উপধারা (১) এ সংজ্ঞায়িত ‘মানবপাচার’ এর অন্তর্ভুক্ত হইবে। আইনের এহেন ধারায় হজ এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই। হাজিদের সৌদিতে পাঠানোর পর তারা ফিরে আসায় যদি এজেন্সিগুলো ধর্ম মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা চাইত তাহলে মনোভাব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যেত। তাদেরকে নির্দোষ দাবি করা যেত। কিন্তু তারা সেটা তো করেননি বরং সেটা গোপনে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এখন চেষ্টা চালাচ্ছেন। এতেই বোঝা যায়, তারা মানবপাচারে জড়িত ও দায়ী। এ বিষয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ১৪০০ হজ এজেন্সি আছে। এর মধ্যে শুধু ওমরাহ হজ এজেন্সি রয়েছে সাড়ে ৩ শতাধিক। সৌদি ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের মতো এত বেশি সংখ্যক হজ এজেন্সি পৃথিবীর আর কোন দেশের নেই। সারা পৃথিবীতে মোট হজ এজেন্সির সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার ১৩৪ টি। এর মধ্যে বাংলাদেশের একাই প্রায় অর্ধেক। এত সংখ্যক এজেন্সির প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সৌদি হজ মন্ত্রণালয়। এক সঙ্গে এত এজেন্সিকে নিয়ন্ত্রণ, তদারকি ও সার্ভিস দেয়া তাদের জন্যও বেশ কঠিন । এ কারণেই এসব এজেন্সির কার্যকলাপ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে সৌদি হজ মন্ত্রণালয়। জানা যায়, গত বছর যে পরিমাণ হাজি ওমরাহ করার জন্য পাঠানো হয় তার মধ্যে ১ শতাংশ নিখোঁজ হতো তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। সৌদি সরকার সব দেশের জন্য প্রতি হজে ১ শতাংশ হারে ছাড় দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের পাঠানো ৫১ হাজারের মধ্যে এক ষষ্ঠাংশই ফিরেননি। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, কারা এসব মানবপাচারে জড়িত। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায় সৌদি সরকারেরর কালো তালিকার বাইরেও আরও কয়েকটি এজেন্সির বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগ রয়েছে। তারা খুবই প্রভাবশালী। এ অভিযোগ সম্পর্কে হাব সভাপতি বলেন-আমার প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র ১৫ হাজি ফিরে না আসার অভিযোগ উঠেছে। তবে আমার জানা মতে, আমার প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র ৪ জন ফিরেনি। তাহলে হাব-এর দায়দায়িত্ব কি জানতে চাইলে ইব্রাহিম বাহার বলেন-আমরাও চাই এদের বিচার হোক। আমরা ধর্ম মন্ত্রণালয়কে বলেছি সঠিক তালিকা দিতে। তাদেরকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে হাব। উল্লেখ্য, সৌদি আরবের মিনিস্ট্রি অব ফরেন এ্যাফেয়ার্সের বেঁধে দেয়া নতুন নিয়মে বাংলাদেশ থেকে ওমরাহ হজযাত্রীদের পাঠানো হয়। এ নিয়মে যারা ওমরাহ ভিসায় সৌদি যাবেন তাদের নির্ধারিত এজেন্ট বা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। প্রতিমাসে এর সঠিক হিসাব সৌদি সরকারের কাছে প্রদান করতে হবে। কিন্তু গত ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ১৪ থেকে ২৮ দিন মেয়াদের ভিসায় বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার মানুষ ওমরাহ পালন করতে সৌদি গেলেও তাদের মধ্যে ৭ থেকে ৮ হাজার হাজি দেশে ফিরে আসেননি। তারা অবৈধভাবে সৌদিতে থেকে গেছেন। তারা সেখানে আত্মগোপনে চলে যান। এটা সৌদি সরকার অবগত হওয়ার পর গত ২২ মার্চ থেকে সম্পূর্ণভাবে ওমরাহ ভিসা প্রদান বন্ধ করে দেয়।
×