ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোদির সফর নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন

দুই দেশের সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থা বাড়বে

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১০ জুন ২০১৫

দুই দেশের সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থা বাড়বে

তৌহিদুর রহমান ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থা বাড়বে। এই সফরের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ও ভারতের বিজেপি সরকারের মধ্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এছাড়া দুই দেশই নতুন করে সন্ত্রাস, জঙ্গী ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করায় আরও গভীর সুসম্পর্ক তৈরি হবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্যদিয়ে দুই দেশের সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থা আরও বাড়বে। নিঃসন্দেহে এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছে। এই সফরের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ও ভারতের বিজেপি সরকারের মধ্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এছাড়া অতীতে বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল, মোদির এই সফরের মধ্যেদিয়ে তার অবসান হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন আরও বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত একে অপরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। দুই দেশের ভূ-রাজনীতিও এই অঞ্চলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরের মধ্য দিয়ে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। কারণ এবার দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীই অঙ্গীকার করেছেন, তারা সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদকে কখনই প্রশ্রয় দেবেন না। মোদির সফরের সময় সম্পাদিত চুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, এই সফরে যেসব চুক্তি হয়েছে, তাতে দুই দেশ লাভবান হয়েছে। এখন এসব চুক্তির খুব দ্রুত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, কোন দুই দেশের শীর্ষ নেতার সফরের মধ্য দিয়ে যেসব চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক সই হয়, সেটা দৃশ্যমান। তবে চুক্তি ও প্রটোকলের বাইরেও এসব সফরের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের মধ্যে আরও আস্থা তৈরি হয়। বিশেষ একটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়। এসব সহজেই দৃশ্যমান হয় না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। মোদির ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে আস্থা তৈরি হলো তা থেকে দু’দেশই লাভবান হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরকালে শেখ হাসিনার সরকারের সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনের সফলতাকে প্রশংসা করেছেন। এছাড়া মোদি আরও বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেক চিন্তা ভাবনার সঙ্গে তার নিজস্ব চিন্তা ভাবনার মিল রয়েছে’। এসব বক্তব্যের মধ্যদিয়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্পষ্ট করেছেন তিনি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। ভারতের বিজেপি সরকার গত বছর মে মাসে ক্ষমতায় আসে। বিজেপি সরকারের এক বছর ইতিমধ্যেই পার হয়েছে। আর ঠিক এক বছরের মাথায় ঢাকা সফরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি শপথ নেয়ার পরেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তিনি গভীর সম্পর্ক গড়তে ইচ্ছুক। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সফরে আসতে তিনি আগ্রহী। তবে ভারত সরকারের নীতি নির্ধারকরা মোদিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিস্তা বা সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন না করে ঢাকা সফর ঠিক হবে না। সে কারণে মোদির ঢাকা সফর বার বার পিছিয়ে যায়। অবশেষে গত ৭ মে ভারতের লোকসভায় সীমান্ত চুক্তি বিল পাসের এক মাস পরে ৬ জুন ঢাকা সফরে আসেন মোদি। সূত্র জানায়, ভারতে গত বছর বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ঢাকা-দিল্লীর কূটনীতিকদের মধ্যে কেউ কেউ আশঙ্কা করেছিলেন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কেননা অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের যে সুসম্পর্ক ছিল, বিজেপি সরকারের সঙ্গে সে ধরনের সুসম্পর্ক নাও তৈরি হতে পারে। তবে সেই ধারণা পাল্টে দিয়ে গত এক বছরের মধ্যে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আর ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে সেই গভীর সম্পর্কেরই প্রতিফলন ঘটেছে। মোদির ঢাকা সফরের সময় সেদেশের পররাষ্ট্র সচিব ড. এস জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই গণতন্ত্রের পক্ষে। তবে একই সঙ্গে জঙ্গীবাদ এবং ধর্মীয় মৌলবাদের বিরোধিতা করি’। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দেশটির সরকারের মনোভাব খুবই স্পষ্ট হয়েছে। কেননা বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে ভারতের অনেক সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে সেদেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়েছে। সে কারণে দিল্লী কখনই চায় না যে, এখানে আবারও এমন কোন সরকার ক্ষমতায় আসুক, যারা সেই ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় না দেয়ার কারণেই ঢাকা ও দিল্লীর মধ্যে একটি গভীর সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবার সফরে বলেছেন, ‘ভারত সব সময় বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। ভারত সব সময় বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়েই আগামীর পথে এগিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশ ও ভারতের লক্ষ্য এক’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এছাড়া তিস্তা চুক্তি এবার না হলেও তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ধৈর্য্য ধরতে বলেছেন মোদি। তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনে আশ্বাস দিয়েছেন মোদি। এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজ উদ্যোগেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তিস্তা চুক্তি নিয়ে মোদি ও মমতা একান্ত বৈঠক করেন। তিস্তা চুক্তি নিয়ে মোদির এই আগ্রহ দুই দেশের মধ্যে নতুন আস্থা এনে দিয়েছে। খুব শিঘ্রই ঢাকা-দিল্লী তিস্তা চুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করবে বলে জানা গেছে। এসব বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে খুব স্পষ্ট হয়েছে, আগামীতে দুই দেশের মধ্যে আস্থা বাড়বে। এদিকে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর সামনে রেখে বিএনপির পক্ষ থেকে অনেক আগে থেকেই লবিং চালানো হচ্ছিল যে, যেভাবেই হোক ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠক করতে হবে। এটা বিএনপির আগামী দিনের রাজনীতির জন্য বাঁচা-মরার লড়াই হিসেবে দেখা হচ্ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে মোদির বৈঠক হয়েছে। বৈঠককালে বেগম খালেদা জিয়া ‘বাংলাদেশে কোন গণতন্ত্র নেই’ বলে মোদিকে নালিশ করেন। এর মধ্য দিয়ে এবার খুবই স্পষ্ট হয়েছে যে, বিএনপি তার ভারত বিরোধী রাজনীতি থেকে সরে এসেছে। কেননা দুই বছর আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী ঢাকায় এলে তখন দেখা করেননি বেগম খালেদা জিয়া। এ নিয়ে বিএনপির তীব্র সমালোচনা রয়েছে। অবশ্য এবার বিএনপি আগেভাগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানায়। উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ৬-৭ জুন ঢাকা সফর করেন। মোদির আমন্ত্রণে ঢাকায় আসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাও। ঢাকা সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারকে সই হয়। সফর শেষে দুই দেশের মধ্যে ৬৫ দফা যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়।
×