ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চলে গেলেন সাবেক স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৮ জুন ২০১৫

চলে গেলেন সাবেক স্পীকার শেখ  রাজ্জাক আলী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতীয় সংসদের সাবেক স্পীকার, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানুরাগী এ্যাডভোকেট শেখ রাজ্জাক আলী আর নেই। রবিবার বিকেল পৌনে তিনটায় খুলনা মহানগরীর ফারাজীপাড়ার নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তিনি দীর্ঘদিন যাবত ক্যান্সার রোগে ভুগছিলেন। আজ সোমবার বেলা ১১টায় খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে মরহুমের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। পরে পাইকগাছায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাঁর লাশ গ্রামের বাড়িতে পাবিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। শেখ রাজ্জাক আলী স্ত্রী ও ৫ কন্যাসহ বহু আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও শুভাকাক্সক্ষীরা তাঁকে এক নজর দেখতে ফারাজীপাড়ার বাসভবনে যান। এর মধ্যে ছিলেন খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সিটি মেয়র মনিরুজ্জামান মনি, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এম নুরুল ইসলাম প্রমুখ। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী শেখ রাজ্জাক আলী ১৯২৮ সালের ২৮ আগস্ট খুলনার পাইকগাছা উপজেলার হিতামপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন আইনজীবী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে অর্থনীতিতে ও ১৯৫৪ সালে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করার পর এলএলবি সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি সক্রিয়ভাবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে তিনি খুলনা জেলা জজকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বার-এর সদস্য হন ও ১৯৬৪ সালে খুলনা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি খুলনা ল’ কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন। এরপর দীর্ঘ ২৫ বছর ওই কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। শেখ রাজ্জাক আলী সিটি ল’ কলেজ খুলনা, সুন্দরবন আদর্শ মহাবিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এছাড়া তিনি সবুরন্নেসা মহিলা কলেজ-খুলনা, কয়রা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, টুটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাইকগাছা ডিগ্রী কলেজ, জিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় পাইকগাছা, বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল, শিরোমণি খুলনা, সিটি ল’ কলেজ মসজিদ, হিতামপুর জামে মসজিদ এবং কপিলমুনি শাহ্ জাফর আউলিয়া মাজার সংলগ্ন মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ খুলনা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ, খুলনা মহিলা আলিয়া মাদরাসা ও হাজী ফয়েজউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিস ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি। শেখ রাজ্জাক আলী এক সময় মওলানা ভাসানীর অনুসারী ছিলেন। ন্যাপে যুক্ত হয়ে তিনি রাজনীতি শুরু করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যোগ দেন জাসদে। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে খুলনা-৬ আসনে জাসদের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে জাগদল গঠিত হলে তিনি এই দলে যোগ দেন। পরে এ দলের নাম পরিবতন করে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি করা হয় এবং তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে খুলনা-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে সংসদ সদস্য নির্বচিত হওয়ার পর তিনি প্রথমে আইন প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পরে তিনি ওই বছরই ৫ এপ্রিল ডেপুটি স্পীকার ও ১২ অক্টোবর স্পীকার পদে আসীন হন। সাবেক স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী ১৯৫৩ সালে সমাজসেবী, ভাষাসৈনিক ও লেখিকা অধ্যাপক বেগম মাজেদা আলীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের পাঁচ কন্যা সন্তানের সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত এবং নিজ নামে খ্যাতিমান। বড় মেয়ে ড. রানা রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। দ্বিতীয় কন্যা ডা. সাহানা রাজ্জাক স্ত্রীরোগ (গাইনি) বিশেষজ্ঞ হিসেবে খুলনায় কর্মরত। তৃতীয় কন্যা ডা. এ্যানা রাজ্জাক মেডিসিন ও আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ হিসেবে জার্মানিতে কর্মরত। চতুর্থ কন্যা লীনা রাজ্জাক চার্টার্ড এ্যাকাউনটেন্ট এবং কনিষ্ঠ কন্যা ব্যারিস্টার ড. জনা রাজ্জাক ইউনিভার্সিটি অব দ্য ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ড-এর আইন বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সশস্ত্র অংশগ্রহণ করতে না পারলেও তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে চলে যান এবং রেডক্রসে যোগ দিয়ে অনেক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা প্রদান করেন বলে জানা যায়। রাষ্ট্রপতির শোক ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ জাতীয় সংসদের সাবেক স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদে প্রয়াত স্পীকারের ভূমিকার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘রাজ্জাক আলী জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি যথাযথভাবে মেনে চলেই সংসদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।’ রাষ্ট্রপতি প্রয়াত রাজ্জাক আলীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতিও তাঁর সহানুভূতি জানান। শেখ রাজ্জাক আলীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন স্বাক্ষরিত শোকবার্র্তায় খালেদা জিয়া রাজ্জাক আলীর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। একইসঙ্গে শোকাহত পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
×