ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোদি আসায় তিস্তাপারের মানুষ খুশি, তারা চায় দ্রুত পানি চুক্তি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৬ জুন ২০১৫

মোদি আসায় তিস্তাপারের মানুষ খুশি, তারা চায় দ্রুত পানি চুক্তি

রাজু মোস্তাফিজ, তিস্তাপারের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে এসে ॥ তিস্তাপারের ইদ্রিস আলী নদীতে মাছ ধরতেন। বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। মাছ ধরেই সংসার চালাতেন। নদীতে পানি না থাকায় এখন দিনমজুরি করেন। টানা বৃষ্টি আর নদীতে সামান্য পানি বাড়ায় মাছ ধরার নেশায় আবার নদীতে নেমেছেন। কিন্তু মাছ নেই। সারাদিনেও দুই কেজি মাছ ওঠে না। ইদ্রিস আলী জানান, তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে তিন একর আবাদী জমিসহ বসত ভিটা ভেঙে আজ নিঃস্ব। ভাঙ্গা-গড়ার মাঝে শুধু ইদ্রিস আলী নন তিস্তাপারের হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি কৃষি জমি ছিল। ছিল সুখের সংসার। তিস্তার ভয়াল ভাঙ্গনের কারণে আজ তারা নিঃস্ব। একদিনের গৃহস্থ এখন দিনমজুর। তাদের ভিটা মাটি সব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ওইসব মানুষ এক সময় তিস্তায় মাছ ধরার পেশা নিলেও পানির অভাবে মাছও হারিয়ে গেছে। সেই তিস্তা নদী এখন প্রায় মরা গাঙ্গ। শুষ্ক মৌসুমে প্রায় শুকিয়ে যায়। প্রায় দুশ’ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রশস্ত নদীর বুকে এখন ধু-ধু বালু চর। বিশাল নদীর বুক চিরে সরু ফিতার মতো বয়ে চলেছে ক্ষীণস্রোতা তিস্তা। এ অবস্থায় বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে ছোট বড় ৭৫টি খেয়াঘাট। অধিকাংশ এলাকায় চলাচলকারী ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিশূন্য হওয়ায় এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নদীর আশপাশে বড় বড় গাছপালা অকালে মরে যাচ্ছে। তিস্তা পারের মানুষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের খবর শুনে ভীষণ খুশি। তারা চায় সীমান্ত চুক্তির মতো তিস্তা পানি চুক্তি দ্রত করুক ভারত সরকার। তাহলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন বেঁচে যাবে। আর বেঁচে যায় জীববৈচিত্র্য। আশির দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন আবাদী জমিতে পানি ব্যবহারের জন্য নীলফামারী জেলার ডালিয়াতে তিস্তা নদীর উপর ব্যারাজ নির্মাণ করে। এখান থেকে তিস্তার মূল স্রোতের পানি ক্যানেল দিয়ে বিভিন্ন আবাদী জমিতে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড যখন ব্যারাজ নির্মাণ শুরু করে তখন ভারত তড়িঘড়ি করে জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবা নামক স্থানে উজানে তিস্তা নদীর উপর ব্যারাজ নির্মাণ করে। ফলে তিস্তার গতিকে থামিয়ে দেয়। এ নদীর মূল স্রোতধারাকে ব্যারাজের বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে ঘুরিয়ে তারা তাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় বিভিন্ন সেচ প্রকল্পে নিয়ে যায়। গজলডোবা ব্যারাজ থেকে শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি ভাটিতে বাংলাদেশকে দেয়া হয়, তা প্রায় ৭০ কিলোমিটার অতিক্রম করে তিস্তা ব্যারাজে এসে যখন পৌঁছে তখন নদীর স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে সরু নালার আকার ধারণ করে। ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার শুরু করার কারণে বাংলাদেশে এই ব্যারাজটির উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ড শত শত কোটি টাকায় নির্মিত তিস্তা ব্যারাজটি এক প্রকার অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এতে কুড়িগ্রামের বিদ্যানন্দ, বুড়িরহাট, দলদলিয়া, ঠুটাপাইকর, চর বজরা ও গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জের বেলকা এলাকার প্রায় ২শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদী শুকিয়ে মরা নদীতে উপক্রম হয়েছে। আর এতে করে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী জেলার কয়েক লক্ষাধিক কৃষকের হাজার-হাজার হেক্টর জমি পতিত ছাড়াও জেলে পরিবারগুলো হয়ে পড়েছে বেকার। তিস্তা পারের পশ্চিম মিছপাড়া গ্রামের ইদ্রিস আলী, শহিদুল ইসলাম জানান, তিস্তা নদী এখন মরা গাঙ্গ। শুষ্ক মৌসুমে ধু-ধু বালুচর। অথচ দুই দশক আগে এই নদীতে রুই, কাতল, আইর, পাবদা, বোয়াল, বেরালীসহ প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। অথচ এখন মাছশূন্য রয়েছে নদী। জেলেরা এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে। তাদের অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। খুব কষ্টে দিন কাটছে তাদের। একই গ্রামের রমজান আলী জানান, এক সময় তিস্তা নদীতে বড় বড় পাট, ধান, তামাক বোঝাই নৌকা চলাচল করত। অথচ এখন নদীর গভীরতা কমে গেছে। পানির অভাবে প্রায় ৭৫টি ঘাট বন্ধ হয়েছে। মোঃ ইয়াসিন জানান, তিস্তার পানি প্রবাহ না থাকায় নদীতে কোন পলি মাটি পড়ে না। তাই আবাদও ভাল হয় না। তিস্তা পারের মানুষরা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসছেন। এতে আমরা ভীষণ খুশি। সীমানা চুক্তির মতো এবার আমাদের আশা তিস্তা নদীর চুক্তি হবে। আমরা ন্যায্য পানি পাব। জেলা প্রশাসক এবিএম আজাদ জানান তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন হলে একদিকে যেন নৌ চলাচলের নতুন পথ তৈরি হবে তেমনি হাজার হাজার কৃষক ও জেলে পরিবারের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড, নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান জানান, তিস্তার পানির অভাবে মানুষ চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। দ্রুত এই চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন না হলে আগামীতে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর চাষাবাদকৃত জমিতে এর প্রভাবে মরুভূমিতে পরিণত আশঙ্কা রয়েছে।
×