ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডোবার ওপর ভবন নির্মাণেই ধসের ঘটনা ঘটছে ;###;বুয়েট বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় ক্ষেত্রেই নক্সাকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় থাকে না, ভবন নক্সা অনুযায়ী অনেক সময় নির্মিত হয় না ;###;রাজউকে জনবল সঙ্কটের কথা স্বীকার করলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান

ঢাকায় ভবন ধস ॥ দুর্বল শোর পাইলিং!

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৬ জুন ২০১৫

ঢাকায় ভবন ধস ॥ দুর্বল শোর পাইলিং!

গাফফার খান চৌধুরী ॥ হালনাগাদ নির্মাণাধীন ভবন, ভবনের পাইলিং ও নির্মিত ভবন ধসের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে দুর্বল পাইলিংয়ের কারণে। ডোবা, পুকুর, খাল বা ঝিল ভরাট করে তার ওপর ভবন নির্মাণ করায় দুর্বল পাইলিংয়ের কারণে ভবন ধসের ঘটনা ঘটেছে। ধসে পড়া ভবন বা নির্মাণাধীন ভবনগুলোর নিচের মাটি নরম ছিল। রাজউকের অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী সঠিকভাবে পাইলিং না করে নির্মাণ কাজ শুরু করায় ধসের ঘটনাগুলো ঘটেছে। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত। মূলত নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ও ভবনের ডিজাইনকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতাও ধসের অন্যতম কারণ। আলোচিত কয়েকটি ধসের ঘটনা পর্যালোচনা করে এমন তথ্যই পেয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞরা। ২০১০ সালের ১ জুন রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন মধ্যবেগুনবাড়ির ১৮/বি নম্বর পাঁচতলা বাড়ি ধসে পাশের কয়েকটি আধাপাকা বাড়ির ওপর হেলে পড়ে। সেনাবাহিনীর স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং কোর উদ্ধার অভিযানে নামে। উদ্ধার তৎপরতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। বাড়িটি বেগুনবাড়ি ঝিলের নরম মাটির ওপর কোন প্রকার পাইলিং ছাড়াই তৈরি করা হয়েছিল। আর বাড়িটিতে যাওয়ার রাস্তাগুলো ছিল একেবারেই সরু। ভারি যন্ত্রপাতি নিয়ে ভবনের কাছাকাছি যাওয়ার মতো কোন প্রশস্ত রাস্তা ছিল না। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে রাস্তা তৈরি করে উদ্ধার অভিযান চালাতে হয়েছিল। ধসেপড়া ভবন থেকে শিশুসহ ২৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। পরবর্তীতে ভবন ধসের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি অপরিকল্পিতভাবে ডোবা ভরাট করে নরম মাটির ওপর প্রয়োজনীয় পাইলিং না করেই ভবন নির্মাণ করায় ধসের ঘটনাটি ঘটে বলে মতামত দেন ইমারত নির্মাণ বিশেষজ্ঞরা। এমন ঘটনায় সারাদেশে বহুতল ভবন নিয়ে রাজউকসহ সংশ্লিষ্টদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। ওই সময় ঢাকার ৬ হাজারের বেশি অবৈধ বহুতল ভবন মালিককে শনাক্ত করে তাদের নোটিস দেয়া হয়েছিল রাজউকের তরফ থেকে। এ ঘটনার পর পরই ২০১১ সালের ২০ মে তেজগাঁও নাখালপাড়ায় ইমপালস মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নির্মাণাধীন ভবনের পাইলিং ধসের ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচ শ্রমিক আহত হন। পুরো এলাকায় ফাটল দেখা দেয়ায় আশপাশের ২৫ বাড়ির বাসিন্দাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় সাতটি পৃথক মামলা হয়। মামলার আসামি হিসেবে গ্রেফতার হন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাব (ডক্টরস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) মহাসচিব ডাঃ এজেডএম জাহিদ হোসেন। এছাড়া সাভারের বাইপাইল এলাকায় সাততলা স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধসে শতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। গার্মেন্টস কারাখানাটি ডোবা ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছিল। সঠিকভাবে পাইলিং না করায় দুর্ঘটনাটি ঘটে বলে ওই সময় ইমারত বিশেষজ্ঞরা জানান। এছাড়া চলতি বছরের ১৫ মে রাজধানীর রামপুরায় হাজীপাড়ার আদর্শ গলিতে ঝিলের ভেতরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা একটি দোতলা বাড়ি ধসে পড়লে ১২ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ধসেপড়া দোতলা বাড়িটি গড়ে তোলা হয়েছিল ঝিলের ওপর; যেখানে অন্তত ১৫ ফুট পানি ছিল। পানির ভেতরে প্রথমে বাঁশ পুঁতে একটি কাঠামো দাঁড় করানো হয়। সেই কাঠামোর ওপর বসানো হয়েছিল স্টীলের চেপ্টা পাত। আর সেই পাতের সঙ্গে ঝালাই দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছিল লোহার রড, এঙ্গেলবার। সেসব ইস্পাতবারের ওপর দশ ইঞ্চি চওড়া আর পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার দেয়াল তোলা হয়েছিল। দেয়ালের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে তোলা হয়েছিল দোতলা বাড়িটি। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ জানিয়েছেন, পানির ভেতরে কোন প্রকার পাইলিং না করেই বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল। বাঁশের খুঁটি পচে যাওয়ায় এবং নরম কাদামাটি থাকায় বাড়িটি সরাসরি নিচের দিকে ধসে পড়ে ডুবে যায়। আর তাতেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সিটি কর্পোরেশন ও রাজউকের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব থাকলেও তা সুচারুভাবে পালিত হয়নি বলেও সংশ্লিষ্টরা মতামত দেন। পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত দায়েরকৃত মামলায় র‌্যাবের হাতে বাড়ির মালিক স্থানীয় যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান মনি গ্রেফতার হয়। এছাড়া ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে স্মরণকালের ভয়াবহ ভবন ধসের ঘটনা। এদিন সাভারে নয়তলা রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ধসেপড়া ভবন থেকে ১ হাজার ১১৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। আহতদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ১৯ জনের মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে মৃত্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৬ জনে। আহত ১ হাজার ১৭০ জনের মধ্যে ৭৮ জনকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। উদ্ধারকৃত মৃতদেহের মধ্যে ৮৪৪ জনের লাশ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা রেখে শনাক্ত ছাড়াই জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় হতভাগ্য ২৯১ জনের লাশ। ঘটনাটি সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এমনকি বাংলাদেশের রফতানির অন্যতম আয় তৈরি পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশ্বের নামকরা অনেক বিদেশী ক্রেতাই মুখ ফিরিয়ে নেয় বাংলাদেশের পোশাক থেকে। ঘটনার দিনই ভবনধসে প্রাণহানির ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশ ও রাজউকের তরফ থেকে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়। গত ১ জুন মামলাটি তদন্ত সংস্থা ভবন মালিক রানা, তার বাবা-মা, সাভার পৌর মেয়র রেফাত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খান, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, উপসহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সাবেক উপ-প্রধান পরিদর্শক মোঃ আব্দুস সামাদ, উপপ্রধান পরিদর্শক মোঃ জামশেদুর রহমান, উপপ্রধান পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন, পরিদর্শক (প্রকৌশল) মোঃ ইউসুফ আলী, পরিদর্শক (প্রকৌশল) মোঃ মহিদুল ইসলাম ও ইমারত পরিদর্শক মোঃ আওলাদ হোসেনসহ ৪২ জনকে অভিযুক্ত করে ঢাকার সিএমএম আদালতে চার্জশীট দেয়। মামলার চার্জশীটে বলা হয়, যে কোন মুহূর্তে ভবন ধসের ঘটনা ঘটতে পারে জেনেও নিরাপত্তার কথা না ভেবে ওইদিন শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এছাড়া চার তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে ভবনটি নয় তলা করা হয়েছিল। স্থানীয়রা জানান, প্রায় পঞ্চাশ ফুট গভীর ডোবার ওপর কোন প্রকার পাইলিং ছাড়াই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। যে কারণে ভবনটি ধসে সরাসরি নিচে চলে যায়। সর্বশেষ গত ২৭ মে পান্থপথ মোড়ে সি আর দত্ত সড়কের ১/সি/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের পাইলিংয়ের প্রায় দু’শ’ ফুট গভীর খাদে ধসে পড়ে সুন্দরবন হোটেলের সীমানা প্রাচীর, রাস্তা, ফুটপাথ, বৈদ্যুতিক তারের খুঁটি, কয়েকটি গাছ, টংঘর, ফুচকা দোকান ও কয়েকটি ভ্যানগাড়ি, চারটি ক্রেন, বিলবোর্ডসহ আশপাশের প্রায় সব কিছুই। যদিও কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। স্থানীয়রা জানান, নির্মাণাধীন ভবনের জায়গাটিতে এক সময় গভীর ডোবা ছিল। সেই ডোবা ভরাট করে ঠিকমতো শোর পাইলিং না করেই সেখানে বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছিল। বুয়েটের এক বিশেষজ্ঞ শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকার প্রায় সব ভবনই অনুমোদিত। যদিও অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যাও নিহায়ত কম নয়। তবে ভবনে বসবাসের জন্য চূড়ান্তভাবে রাজউকের অনুমোদন লাগে। চূড়ান্তভাবে বসবাসের অনুমোদন পেতে যেসব কাগজপত্র বা ভবনগুলো নির্মিত হওয়ার কথা, প্রায় শতভাগ ভবনেরই তা নেই। অধিকাংশ ভবনের কাগজপত্রই ভুয়া। নকল কাগজপত্র বানিয়ে এসব ভবনে ভবন মালিকরা মানুষজনকে দেখিয়ে বসবাস করতে আগ্রহী করেছেন। মূলত রাজউক থেকে বসবাসের কোন অনুমতি পায়নি। আবার অনেক ভবনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকার পরেও রাজউকের সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তারাও তাদের চাহিদা না মেটানোর ফলে বসবাসের চূড়ান্ত সনদ দিচ্ছেন না। রাজধানী ঢাকায় মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি ভবন রয়েছে, যেসব ভবনে বসবাসের জন্য রাজউকের তরফ থেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসবই সরকারী ভবন। বাকি ভবনগুলোতে বসবাসের কোন অনুমোদন রাজউকের তরফ থেকে দেয়া হয়নি। কৌশলগত কারণে রাজউক অনুমতি দেয়নি। আবার রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চাহিদা মেটাতে না পেরে ভবন মালিকরা সব কাগজপত্র থাকার পরও বসবাসের চূড়ান্ত অনুমোদনের সনদ পাচ্ছেন না। এছাড়া অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- ও আর্থিক দ-ের বিধান থাকলেও এমন আইন আজ পর্যন্ত কারও ক্ষেত্রে কার্যকর হওয়ার কোন উদাহরণ নেই। এ ব্যাপারে রাজউকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নির্মাণাধীন ভবন রাজউকের নকশা অনুযায়ী হচ্ছে কিনা সেটি দেখার দায়িত্ব রাজউকের। কিন্ত দেখভালের জন্য যত সংখ্যক দক্ষ প্রকৌশলী প্রয়োজন তা রাজউকের নেই। তারপরও ধসের বিষয়ে রাজউকের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
×