ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভরা সংসদে বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৫ জুন ২০১৫

ভরা সংসদে বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী

সংসদ রিপোর্টার ॥ ফুরফুরে মেজাজে এবারও সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সরকার ও বিরোধী দলের পূর্ণ উপস্থিতিতে রীতিমত উৎসবমুখর পরিবেশে জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়। বাজেট উপস্থাপনকালে সরকার ও বিরোধী দলের আসন ছাড়াও ভিভিআইপি, ভিআইপি গ্যালারিতেও ছিল উপচেপড়া ভিড়। এর আগে সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের বিশেষ বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করা হয়। আলোচনা শেষে আগামী ৩০ জুন বাজেট পাস হবে। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বেলা সাড়ে তিনটায় অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনে সরকারী ও বিরোধী দলের সদস্যের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ দেশী-বিদেশী কূটনীতিক, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। বাজেট উত্থাপন শেষে অর্থবিল-২০১৫ সংসদে উত্থাপন করা হয়। বাজেট উত্থাপনকে কেন্দ্র করে সংসদ ভবনজুড়ে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। সংসদের ভেতরে-বাইরে ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিকেল ৩টা ৩৩ মিনিট থেকে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন। বাজেট উপস্থাপনের জন্য অধিবেশন কক্ষে ৪টা বড় ডিজিটাল স্ক্রিন স্থাপন করা হয়; যার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বাজেট বক্তৃতার পুরো অংশ ধারাবাহিকভাবে দেখানো হয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পীকার ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের বসার আসনের সামনে ৪টি এলসিডি মনিটর বসানো হয়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে কখনও দাঁড়িয়ে আবার কখনও নিজ আসনে বসে বাজেট বক্তৃতা করেন অর্থমন্ত্রী। বাকিগুলো পঠিত বলে গণ্য করেন স্পীকার। বয়সে প্রবীণ হলেও সংসদে বাজেট পেশকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে কর্মে নবীন ও তেজোদীপ্ত মনে হয়েছে। দীর্ঘ সময়ে বাজেট বক্তৃতাকালে উৎফুল্ল ও হাস্যোজ্জ্বল অর্থমন্ত্রী মাঝেমাঝেই হাস্যরসের মাধ্যমে অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। সংসদ সদস্যরাও বার বার টেবিল চাপড়ে তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে অধিবেশন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী ॥ পূর্বনির্ধারিত সময়ের আগে নকশা করা অফ হোয়াইট সিল্কের শাড়ি পরিহিত সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কালো ব্রিফকেস নিয়ে সংসদের অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির মুজিবকোট পরিহিত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময় সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানান। একই সময় অধিবেশন কক্ষে আসেন স্পীকার। অধিবেশনের শুরুতে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্পীকার বলেন, আপনি বাজেট উত্থাপনের অনুমতি চাইতে পারেন। পরে অর্থমন্ত্রী অনুমতি প্রার্থনা করেন। পরে স্পীকারের অনুমতি নিয়ে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন অর্থমন্ত্রী। অবশ্য এ সময় তিনি প্রয়োজনে নিজ আসনে বসে বক্তৃতা উত্থাপনের অনুমতি চান। জবাবে স্পীকার বলেন, আপনি চাইলে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে সুবিধামতো বাজেট বক্তৃতা করতে পারেন। অর্থবিল উত্থাপন ॥ বাজেট বক্তৃতা শেষে অর্থমন্ত্রী অর্থবিল ২০১৫ সংসদে উত্থাপন করেন। সরকারের আর্থিক প্রস্তাবাবলী কার্যকরণ এবং কতিপয় আইন সংশোধনের লক্ষ্যে বিলটি উত্থাপন করা হয়। বিলটি আগামী ৩০ জুন পাস হবে। প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন ॥ বাজেট বক্তৃতার আগে দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে মন্ত্রিপরিষদের বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেয়া হয়। বাজেট উত্থাপনের আগে রেওয়াজ অনুযায়ী প্রতিবছর মন্ত্রিপরিষদের বিশেষ বৈঠক সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদনের পর জাতীয় সংসদে উত্থাপনের আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তা সংসদ ভবনের সাততলায় অবস্থিত রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে নিয়ে যান। সংসদে উত্থাপনের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। সাংবাদিক লাউঞ্জে রাষ্ট্রপতি ॥ সাংবাদিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভালবাসা ও সখ্য বেশ পুরনো। শত নিরাপত্তা ঘেরাটোপও রাষ্ট্রপতিকে কখনও সাংবাদিকদের কাছ থেকে আলাদা করতে পারেনি। স্পীকার যখন ছিলেন তখনও নিয়মিত আসতেন সাংবাদিক লাউঞ্জে। আর রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি সংসদে আসবেন, কিন্তু সাংবাদিক লাউঞ্জে আসবেন না, এটা অতীতে কখনও হয়নি। বৃহস্পতিবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। সংসদের সার্জেন্ট এ্যাট আর্মস লাউঞ্জে এসে যখন জানালেন রাষ্ট্রপতি আসছেন তখন কর্মরত সাংবাদিকরা অবাক না হলেও সতর্ক হলেন সবাই। আগে থেকে না জানলেও রাষ্ট্রপতি আসতে পারেন এ যেন সবার প্রত্যাশিতই ছিল। কারণ সাংবাদিকরা তাকে নিজেদের অতি আপন মানুষ বলেই মনে করেন। তাই যথারীতি বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের ষষ্ঠ তলায় সাংবাদিক লাউঞ্জে এসে সদাহাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণখোলা রাষ্ট্রপতি কিছু সময় কাটিয়ে যান। নিরাপত্তার ঘেরাটোপ পেরিয়ে সাংবাদিক লাউঞ্জে এসে কিছু সময় অবস্থানকালে সবার খোঁজখবর নেন রাষ্ট্রপতি। পার্লামেন্ট জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট উত্তম চক্রবর্তী রাষ্ট্রপতিকে অভ্যর্থনা জানান এবং তার শারীরিক কুশলাদি জানতে চান। এ সময় সাংবাদিকরা রাষ্ট্রপতিকে তার কিছুটা মুটিয়ে যাওয়ার কথা জানালে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে রাষ্ট্রপতি তার দেহে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট থাকার কারণে একটু মোটা দেখাচ্ছে বলেও অকপটে স্বীকার করেন। রাষ্ট্রপতি একে একে সবার কুশলাদি জানতে চান, বিশেষ করে জনকণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার দুর্ঘটনায় আহত নাজনীন আখতারের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চান। এ সময় দিল্লীতে তার সর্বশেষ অস্ত্রোপচারের কথা রাষ্ট্রপতিকে জানানো হয়। রাষ্ট্রপতি যাওয়ার সময় শীঘ্রই বঙ্গভবনে পার্লামেন্ট জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের চা চক্রে আমন্ত্রিত করা হবে বলে জানান। এ সময় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ছিলেন তার প্রেস সচিব ইহসানুল করিম হেলাল, সংসদের সার্জেন্ট এ্যাট আর্মস আশরাফুল হক প্রমুখ। মুহিতের ৯ম বাজেট ॥ এবারের বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ৯ম বারের মতো বাজেট প্রস্তাব পেশ করলেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রী এর আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অপর চারটি (২০০৯-২০১০, ২০১০-২০১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-২০১৪, ২০১৪-২০১৫) এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সরকারের আমলে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দুটি বাজেট পেশ করেছিলেন। বৃহস্পতিবার তিনি ৯ম বারের মতো সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন। তবে একটানা সাতবার বাজেট উপস্থাপন করে দেশের ইতিহাসে রেকর্ডও তৈরি করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। অতীতে কোন অর্থমন্ত্রী একটানা সাতবার বাজেট পেশ করতে পারেননি। সংসদে এরশাদ-মঞ্জুর খোশগল্প ॥ এক সময় দু’জনই ছিলেন জাতীয় পার্টির কা-ারী। তবে রাজনৈতিক মতবিরোধী দেখা দেয়ায় অনেক আগেই এরশাদের ঘর ছেড়েছেন জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব বর্তমানে জাতীয় পার্টি (জেপি) চেয়ারম্যান ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। সেই ঘরছাড়া মঞ্জুর সঙ্গেই বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের লবিতে এক টেবিলে খোশগল্পে মেতে ওঠেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বাজেট অধিবেশনে আছরের নামাজের বিরতিতে এক নম্বর লবিতে তাদের দু’জনের খোশগল্পে সাক্ষী হয়েছেন জাতীয় পার্টির বর্তমান মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার, পানি সম্পদমন্ত্রী ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মশিউর রহমান রাঙ্গা, বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ তাজুল ইসলামসহ জাতীয় পার্টির কয়েক সংসদ সদস্য। খোশগল্পের ফাঁকে ফাঁকে কেক আর সিঙ্গারা দিয়ে নাস্তাও সেরে নেন তারা। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদসহ ভিআইপিদের আগমন উপলক্ষে সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকায় সকাল থেকেই নিñিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়। একমাত্র বৈধ পাস ছাড়া আর কাউকে সংসদ ভবন এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এমনকি দর্শক গ্যালারিতে পাস ইস্যুতেও ছিল কড়াকড়ি। তাই দর্শক গ্যালারিতে অনেক আসনই ছিল ফাঁকা। বাজেট বক্তৃতা শুনতে সংসদ সচিবালয়ে আসেন রাষ্ট্রপতি। তার অফিস কক্ষের সামনেও বাড়তি নিরাপত্তা হিসাবে শক্তিশালী আর্চওয়ে স্থাপন করা হয়। র‌্যাব-পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থার বিপুলসংখ্যক সদস্য পুরো ভবনে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলেন। এমপি হিসেবে শপথ নিলেন আবদুল ওয়াহহাব ॥ এমপি হিসেবে শপথ নিয়েছেন মাগুরা-১ আসনের উপনির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব) এ টি এম আবদুল ওয়াহহাব। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংসদ ভবনে তার কার্যালয়ে নবনির্বাচিত এই সংসদ সদস্যকে শপথবাক্য পাঠ করান। শপথ নিয়েই বাজেট অধিবেশনে যোগ দেন অবদুল ওয়াহহাব। জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া, চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, হুইপ মাহবুব আরা গিনি, ইকবালুর রহিম, শাহাব উদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-২ এ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় সংসদের সিনিয়র সচিব মোঃ আশরাফুল মকবুল শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সংসদ সচিবালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, গত ৩০ মে অনুষ্ঠিত ওই উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এ টি এম আবদুল ওয়াহহাব ৯৩ হাজার ১৮১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তপন কুমার রায় পেয়েছিলেন ১২ হাজার ৭৯০ ভোট।
×