ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গুণগত বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ৪ জুন ২০১৫

গুণগত বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

হামিদ উজ-জামান মামুন ॥ আজ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হচ্ছে আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। এ বাজেটের অন্যতম প্রধান অংশ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) অনুমোদন দেয়া হয়েছে আগেই। আগামী অর্থবছরে রেকর্ড আকারের এডিপি হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেরসহ এর আকার দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল এডিপি হচ্ছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি বছরের সংশোধিত এডিপির চেয়ে ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি। এর বাইরে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা অথবা কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের অনুকূলে ৩ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এডিপির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে গুণগত বাস্তবায়ন। বছর বছর আকার বাড়ে, টাকার অঙ্গে বাস্তবায়নের চেষ্টাও করা হয় সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। কিন্তু যে প্রশ্নটি সবসময় আড়ালেই থেকে যায়, সেটিই হচ্ছে মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন। এ বিষয়টি নিয়ে এবার খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মোস্তফা কামালই সরব হয়েছেন। পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেছেন, অপচয় কমাতে হবে। এক লাখ কোটি টাকার এডিপি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে দেশের চেহারা বদলে যাবে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। তিনি বলেন, কংক্রিটের রাস্তা হওয়া জরুরী। এটিই হবে একমাত্র সমাধান। তা না হলে রাস্তা সামান্য বৃষ্টিতে ভেঙে যাবে। মন্ত্রী বলেন, সচিবরা এডিপির বাস্তবায়ন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে না এলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখা হবে। প্রয়োজনে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়া হবে। গুণগত বাস্তবায়ন বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেছেন, এডিপি বাস্তবায়নে আমরা একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়েছি। কোন বছর একটু বেশি বাস্তবায়ন হয়। কোন বছর একটু কম। বারবার উন্নয়ন প্রকল্প সংশোধনের নামে ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব প্রকল্প থেকে যে সুফল পাওয়ার কথা তা পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে এডিপি বাস্তবায়নে পুরো কালচারকে পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রকল্প প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও মূল্যায়নের গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তন আনেতে হবে। তাহলে দাতা সংস্থাগুলোর অর্থ যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে উন্নয়নে দুর্নীতি কমে আসবে। এডিপিতে ৪১ নতুন প্রকল্প ॥ আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দসহ মোট প্রকল্প থাকছে ৯৯৮টি। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প থাকছে ৮৫৪টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১৩২টি এবং জেডিসিএফ অর্থায়িত প্রকল্প থাকছে ১২টি। এডিপিতে বরাদ্দসহ একেবারেই নতুন প্রকল্প থাকছে ৪১টি। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ৩৬টি এবং কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ৫টি। এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অর্থায়নের ১২৫টি প্রকল্পসহ এডিপিতে মোট ১ হাজার ১২৩টি প্রকল্প থাকছে। ২০৯ মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্পের বোঝা ॥ নতুন এডিপির ঘাড়ে চেপেছে ২০৯ মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্পের বোঝা। আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসব প্রকল্পের ঘানি টানতে হবে । বলা হয়েছে অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) এবং কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাব (টিপিপি) অনুযায়ী এসব প্রকল্প ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে তা হচ্ছে না। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ এ প্রকল্পগুলোকে তারকা চিহ্ন দিয়ে নতুন এডিপিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছিল পরিকল্পনা কমিশন। এ প্রকল্পগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধি ছাড়া অর্থছাড় কিংবা ব্যয় করা যাবে না বলে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছিল। এনইসি বৈঠকে এসব সুপারিশ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সমাপ্তির লক্ষ্য ৩২৪ প্রকল্প ॥ আগামী ২০১৫-১৬ নতুন অর্থবছর। এ অর্থবছরে ৩২৪টি প্রকল্প সমাপ্ত করতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প রয়েছে ২৮১টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ৪১টি এবং জাপানী ঋণ মওকুফ সহায়তা তহবিলের (জেডিসিএফ) ২টি প্রকল্প রয়েছে। এজন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) বিশেষ বরাদ্দও দেয়া হয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে। এর আগে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের এডিপিতে ৩২৪টি প্রকল্প সমাপ্তির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। মাঝ পথে সংশোধন ॥ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে তা ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ক্ষমতায় এসে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সাড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার এডিপি নেয়া হয়। পরে তা কমিয়ে ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সংশোধিত এডিপি ঘোষণা করা হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। মাঝ পথে বরাদ্দ কমিয়ে ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। পরের বছরের চিত্র একই। ৪৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি ঘোষণা করে ৪১ হাজার ৮০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৫ হাজার কোটি টাকার এডিপিতে বরাদ্দ কমানো হয় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এডিপিতে ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা হাতে নিয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের শুরুতে মূল এডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৬ হাজার কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসের মূল এডিপির আকার কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকায়। বাস্তবায়নের বাধা ॥ এডিপির গুণগত বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে, দুর্নীতি, উন্নয়ন কর্মসূচী ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, ভূমি সঙ্কট, অযোগ্য প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ও ঘন ঘন বদলী, উন্নয়নসহযোগীদের আমলাতান্ত্রিকতা, সঠিক সময়ে অর্থ ছাড় না হওয়া, বরাদ্দের অতিরিক্ত খরচ হওয়া, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হওয়া, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) দুর্বলতা, কারিগরি দক্ষতার অভাব, আইএমইডি ক্ষমতা না থাকা, রাজনৈতিক কারণে প্রকল্প হাতে নেয়ার কারণে দেশে সরকারী বিনিয়োগের সুফল আসছে না বলে মনে করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, অর্থনৈতিক খাতভিত্তিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহ অর্জনের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি)। এডিপির গুণগত বাস্তবায়নের বিষয়টি এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। কাজেই পরবর্তী লক্ষ্য হতে হবে এডিপির শুধু বাস্তবায়ন বাড়ানোই নয়, গুণগত বাস্তবায়ন। বাড়ির মালিকদের ব্যাংক হিসাব বাধ্যতামূলক হচ্ছে অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাড়ি থাকলেই ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে। শুধুই তাই নয়, সেখানে বাড়ি ভাড়ার টাকা জমা রাখতে হবে। গত বছরের জুলাই থেকে এমন নির্দেশনা কার্যকর থাকলেও খুব কম সংখ্যক মালিকই তা মেনেছেন। তাই এবার আইন লঙ্ঘনকারী বাড়ির মালিকদের বাসা ভাড়া বাবদ অর্জিত আয়ের ওপর প্রদেয় আয়করের ৫০ শতাংশ অথবা ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা (যেটি বেশি) হারে বাধ্যতামূলকভাবে জরিমানা দিতে হবে। যেসব বাড়ির মালিক ২৫ হাজার টাকার বেশি ভাড়া পেয়েও ব্যাংকে জমা দিচ্ছেন না তাদের তালিকা করতে কাজ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আসছে অর্থবছরের মধ্যেই এ বিষয়টি কার্যকর করতে এনবিআর এরই মধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো শুরু করবে বলে জানা গেছে। সূত্রে আরও জানা যায়, রাজস্ব বাড়াতে গত বছরের জুলাই এই বিধান চালু করে সরকার। গত বছর এনবিআরের একটি জরিপে দেখা যায়, করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও এক লাখ ৬৬ হাজারের বেশি বাড়ির মালিক কর দেন না। এখন ভাড়াটিয়ারা ক্রস চেকের মাধ্যমে অথবা বাড়ির মালিকের ব্যাংক হিসাবেও নগদ জমা দিতে পারেন।
×