ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মেহেরপুরে মানব পাচারকারীরা বহাল তবিয়তে

নিখোঁজদের পরিবারে কান্না থামছে না

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ২ জুন ২০১৫

নিখোঁজদের পরিবারে কান্না থামছে না

নিজস্ব সংবাদদাতা, মেহেরপুর, ১ জুন ॥ পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় যেতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন মেহেরপুর জেলার অসংখ্য মানুষ। মানব পাচারকারীদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকেই দেশে ফিরে আসলেও এখনও নিঁেখাজ রয়েছেন ভাগ্য বিড়ম্বিত বেশ কিছু মানুষ। নিখোঁজ পরিবারগুলোতে এখন শুধুই কান্নার রোল। এত কিছুর পরও পাচারকারীদের দাপট কমেনি। মেহেরপুর সদর উপজেলার সিংহাটি গ্রামের ইসলাম হোসেন ও মাসুদ রানা পানিপথে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে আদম পাচারকারীদের চরম নির্যাতনের শিকার হন। পাচারকারীদের নির্মম নির্যাতনের দাগ তাদের শরীর থেকে এখনও মোছেনি। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তারা দু’জন জানান, সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে গত বছরের শুরুর দিকে একই গ্রামের ইমারুল ও ইমাদুলের মাধ্যমে তারা ঢাকায় রওনা দেন। দুই দালালের হাতে তারা দু’জন তুলে দিয়েছিলেন ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর পরে ঢাকা থেকে টেকনাফ হয়ে তাদের সাগরপথে জাহাজে তুলে দেয়া হয়। ছয়দিন জাহাজে চড়ে অবশেষে তাদের ঠাঁই হয় থাইল্যান্ডের এক গহীন জঙ্গলে। তাদের সঙ্গে ছিল কয়েক শ’ মানুষ। জঙ্গলের ভেতরে তাদের ওপর শুরু হয় দালালদের নির্যাতন। বিদেশী কয়েক দালাল মারপিট করে পরিবারের সদস্যদের কাছে ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা দাবি করে। নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে সহায়সম্বল বিক্রি করে টাকা দিতে রাজি হয় তাদের পরিবার। এর আগের টাকা নিয়ে আত্মগোপন করে ইমারুল। তখন পরিবারের লোকজনের সঙ্গে পুনরায় ইমাদুল যোগাযোগ করে টাকা দাবি করে। ইমাদুলের কথামতো তার শ্যালক একই গ্রামের রিপনের মাধ্যমে দু’জনের কাছ থেকে পুনরায় ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। ইমাদুলের নির্দেশমতো টাকাগুলো টেকনাফের ইসলামী ব্যংকের একটি শাখায় লায়লা ও এমআর ট্রেডার্সের হিসাব নম্বরে দেয় রিপন। টাকা পেয়ে ইসলাম ও মাসুদকে দালালরা আলেস্তা সীমান্ত দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করে দেয়। এর পরপরই মালয়েশিয়ার পুলিশ তাদের আটক করে। দীর্ঘ চার মাস হাজতবাসের পর তারা মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরে আসে। দালালদের কাছে টাকা ফেরত চাওয়ায় এখন তারা নতুন করে বিপাকে রয়েছেন। দালাল চক্রের হাত এতটাই লম্বা যে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। নির্যাতিতদের বিভিন্নভাবে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে দালাল চক্র। তবে ১৯ মে দৈনিক জনকণ্ঠের শেষের পাতায় এ সংক্রন্ত একটি তথ্যসমৃদ্ধ খবর প্রকাশের পর প্রশাসনের বিভিন্ন দফতর থেকে দালালদের খোঁজখবর নেয়া শুরু হয়েছে। প্রশাসনের একটি সূত্রের তথ্যনুযায়ী জেলার বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত ২০টি দালালচক্র রয়েছে। এর মধ্যে খড়মপুরের আহম্মদ আলী, তেরাইলের জাহাঙ্গীর ওরফে পোড়া জাহাঙ্গীর, হেমায়েতপুরের আবুল কাশেম, সিংহাটির ইমাদুল, ইমারুল, কুড়ন ও সাজিবুল, ঝোড়পাড়ার বজলু মিয়াসহ দালাল চক্রের সদস্যরা বহাল তবিয়তেই আছে। এদের মধ্যে আহম্মদ আলী ও জাহাঙ্গীর থাকে রাজধানীতে এবং ইমাদুল মালয়েশিয়ায়। বাকিরা গা-ঢাকা দিয়ে এলাকায় অবস্থান করছে। ভাগ্য বিড়ম্বিত মাসুদ রানা ও ইসলাম হোসেনই নয় জেলায় এমন নির্যাতিত মানুষের সংখ্যা অনেক। শুধু নির্যাতন করে অর্থ আদায় নয়, মানব পাচারের শিকার অসংখ্য মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। গত দু’বছর আগে থেকে মালয়েশিয়ায় পানি পথে পাচারের শিকার পরিবারগুলোতে এখন শুধুই কান্নার রোল। সদর উপজেলার সিংহাটি, রঘুনাথপুর, পাটকেলপোতা, আমদহ, আশরাফপুর, ঝাঁঝা, গাংনী উপজেলার হেমায়েতপুর, গজারিয়া, বানিয়াপুকুর, চাঁদপুর, ধানখোলা, কষবা, আড়পাড়া, খড়মপুর, রুয়েরকান্দি ও শালদহসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে শতাধিক মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। এদের মধ্যে পাটকেলপোতার আলামিন, সিংহাটির আতাহার, ঝাঁঝার আনারুল, গজারিয়া হেমায়েতপুরের কালু মিয়া, বানিয়াপুকুরের জিন্নাত, আসাদুল, জাহিদুল, মিনা ও আরিফ, চাঁদপুরের মনিরুল, আমজাদ, বিকাশ দাস, সবুজ, মিরাজ, আড়পাড়ার মিনারুল ও তৈয়ব, রুয়েরকান্দির আহাজ উদ্দীন, গাঞ্জের বাবলু, নুরু মিয়া, কড়ুইগাছির আমজাদ, হাবিবুর, আনারুদ্দীন ও মাহবুলের নাম পাওয়া গেছে।
×