ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অন্যের বাড়ি থেকে কেরোসিন এনে পড়াশোনা করে স্মৃতি পেয়েছে জিপিএ-৫

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২ জুন ২০১৫

অন্যের বাড়ি থেকে কেরোসিন এনে পড়াশোনা করে স্মৃতি পেয়েছে জিপিএ-৫

শর্মী চক্রবর্তী ॥ ঘরে আলো নেই। ঘোর অন্ধকার। সেই অন্ধকারে কুপির একটু আলোতে পড়ালেখা করে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে এক মেধাবী শিক্ষার্থী। অন্যের বাড়ি থেকে কেরোসিন ধার করে এনে পড়ালেখা করেছে ওই শিক্ষার্থী। জীবনের এই পর্যায়ে আলোর মুখ দেখলেও বাকিটা জীবন তার কাছে অন্ধকার মনে হচ্ছে। ছোটবেলা থেকে খুব কষ্ট করে পড়ালেখা করেছে সে। বই নেই খাতা নেই। বাবা মায়ের সামর্থ্য নেই মেয়েকে বই কিনে পড়ানোর। স্কুলের সহপাঠীদের কাছ থেকে বই এনে পড়ালেখা করত সে। দিনমজুর বাবা চাইলেও মেয়েকে বই কিনে দিতে পারত না। তিনি যে কাজ করেন তাতে পরিবারের সবার খাবারই হয় না; বই কিনবেন কিভাবে। পরিবারের এ অবস্থা বুঝতে পারে ওই শিক্ষার্থী। তারপরও নিজের ইচ্ছাটাকে ঝেরে ফেলেতে পারেনি। তাই যাতে নিজের পড়ালেখা বন্ধ না হয়ে যায় তাই অন্যদের কাছ থেকে বই এনে পড়ত। স্যারদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে নিজে নিজে পড়ালেখা করত। সে চাইত তার পড়ালেখা যেন বন্ধ না হয়ে যায়। এই কষ্টগুলো সার্থকরূপ দিয়েছে। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে; কিন্তু সার্থকরূপ পেলেও তার এই সফলতা যতটা আনন্দের ততটাই ভয়ের। সে জানে না সামনে আর এগোতে পারবে কিনা। ভবিষ্যত নিয়ে সে ও তার পরিবার সন্দিহান। পড়ালেখার খরচ কোথা থেকে পাবে। বই কিনবে কোথা থেকে। কলেজে ভর্তি করানোর মতো সামর্থ্যও নেই তার বাবার। তার স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু এর বড় বাধা দারিদ্র্য। এমনই এক দরিদ্র শিক্ষার্থী কুড়িগ্রামের স্মৃতি আক্তার। অর্থাভাবে স্মৃতির ভবিষ্যত এখন ঘোর অন্ধকারে। এই প্রতিবেদনটি লিখতে সহযোগিতা করেছেন কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি রাজু মোস্তাফিজ। পদার্থবিদ্যা পরীক্ষার আগের রাতে ঘরে কেরোসিন তেল ছিল না। প্রতিবেশী মকবুলের বাড়ি থেকে ধার করা এক কুপি কেরোসিন তেল দিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়েছে স্মৃতির। এমনকি পরীক্ষার আগে দুইটা বইও ছিল না। পরীক্ষার মাত্র এক মাস আগে মিলেছে গ্রামারসহ সহায়ক দুটি বই। বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে বই ধার করে পড়তে হতো। অনাহার-অর্ধাহার-অপুষ্টি ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। এমন শতেক বাধায় স্মৃতি আক্তার থেমে থাকেনি। পড়াশোনার প্রবল ইচ্ছে তার। এই ইচ্ছেশক্তির কারণে এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। স্কুলের সেরাছাত্রী হিসেবে গ্রামবাসীর কাছে মর্যাদা পাচ্ছে। স্মৃতির স্বপ্ন চিকিৎসক হবে। তবে হতদরিদ্র ঘরের এই মেধাবী ছাত্রীর স্বপ্নপূরণে পাহাড় সমান বাধা এখন অর্থ সঙ্কট। অর্থাভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ভর করেছে তার মনে। স্মৃতি আক্তার এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সন্ন্যাসী গ্রামে ধরলা নদীর তীরে অবস্থিত স্মৃতির বাড়ি। গ্রামবাসীর অনেকেই এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না এই ফল। স্মৃতির মা বিজলী বেগমের চোখে আনন্দাশ্রু। মেয়ে সেরা ফল করলেও বাবা-মায়ের মুখে নেই হাসি। ক্লাসে সব সময় প্রথম হওয়া মেয়েটির লেখাপড়ার খরচ কী করে যোগাবেন ভূমিহীন এই দিনমজুর পরিবার, তা নিয়েই যত উৎকণ্ঠা। স্মৃতির বাবা নুর ইসলাম জানান, ১৯৮৮ সালের বন্যায় তার বাড়িভিটা ও সামান্য জমি নদীগর্ভে চলে যায়। এরপর নদীর কিনারে খাসজমিতে ছাপড়া তুলে আছেন। কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলে স্বল্প বেতনের একটি চাকরি ছিল তার; সরকারের ছাঁটাইনীতির কবলে পড়ে সেটাও হারান ২০০২ সালে। এরপর দিনমজুরি করে কোনমতে দিন চালান। পেটপুরে দু’বেলা খাবারই জোটে না। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া খরচ যোগাবেন কী করে? তাই একমাত্র ছেলে বিপ্লব এসএসসি পাসের পর চলে গেছেন গার্মেন্টসে। আর বড় মেয়ে ইতিকে বিয়ে দিয়েছেন নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়। স্মৃতির মা বিজলী বেগম বলেন, ‘মেয়েকে তো লেখাপড়া শিখাতে চাই। কিন্তু ঠিকমতো খাবার দিতে পারি না। অত খরচ দিব কিভাবে। পরীক্ষার সময় পুষ্টিকর কোন খাবার দিতে পারেননি মেয়েকে। এমননি ভাল ফলাফল করেও একটা মিষ্টি তুলে দিতে পারেননি তার মুখে। এই আক্ষেপ করে কেঁদে ফেলেন বিজলী বেগম। স্মৃতি জানায়, প্রথম শ্রেণী থেকে ক্লাসে তার অবস্থান ছিল প্রথম। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তিও পায়। তবে প্রয়োজনীয় বই, খাতা ও কলম কখনই পায়নি। অর্থাভাবে প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিংও করতে পারেনি ঠিকমতো। তবে তার অদম্য ইচ্ছা দেখে স্কুলের শিক্ষকরা তাকে সহায়তা করেছেন। পুরনো পোশাকে স্কুলে যেতে হতো। কেরোসিনের অভাবে স্কুলের পড়া প্রস্তুত করতে পারেননি অনেক দিন। তারপরও ক্লাসে সেরা ছিল সে। ‘আমার স্বপ্ন ডাক্তার হবো। কিন্তু বাবা আর লেখাপড়ার খরচ দিতে পারছেন না। কলেজে ভর্তির জন্য টাকা, বই ও পোশাক লাগবে- এগুলো কিভাবে যোগাড় হবে জানি না। আসলে কারও সহায়তা না পেলে হয়ত আমার লেখাপড়াই হবে না। আমার বোনের মতো আমাকেও বাল্যবিয়ের শিকার হতে হবে’- দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটানা কথাগুলো বলে স্মৃতি। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, ‘স্মৃতির মেধা আর সাধনা দেখে আমরা স্কুল থেকে যথাসম্ভব তাকে সহায়তা দিয়েছি। এখন তার সামনে সত্যিই অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে।’
×