ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্লান্ট ক্লিনিক হওয়ায় টাঙ্গাইলের কৃষক খুশি

উদ্ভিদের রোগব্যাধি নিরাময়ে ব্যতিক্রমী হাসপাতাল

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২ জুন ২০১৫

উদ্ভিদের রোগব্যাধি নিরাময়ে ব্যতিক্রমী হাসপাতাল

ইফতেখারুল অনুপম ॥ ‘ভাইরে মানুষের অসুখ অইলে ডাক্তার পাওয়া যায়, পশুর জন্যও ডাক্তার আছে। কিন্তু যে উদ্ভিদ না থাকলি দুনিয়া থাকবো না, হের জন্নি কোনো ডাক্তার নাইকা। এইবার তা চালু অইলো। এহন থিকা ক্ষেতে পোঁকা নাগলে, কোনো ব্যারাম অইলে উদ্ভিদের হাসপাতালে আসমু আর সঠিক চিকিৎসা নিমু।’ কথাগুলো মধুপুরের কলাচাষী নুরুল ইসলামের। বিন্যাফৈর গ্রামের কৃষক জলিল মিয়া বলেন, ‘আগেও মানুষ কৃষিকাজ করত, এখনও করে। কিন্তু পার্থক্য অনেক। বর্তমান সরকার আমাগো অনেক সুযোগ-সুবিধা কইরা দিছে। কৃষকদের ব্যাংক চালুর পর এখন গাছগাছালির জন্য ক্লিনিক খুলছে। আগে আমরা না বুইঝাই ওষুধ ব্যবহার করতাম। এখন ডাক্তার দেখাইয়া ওষুধ কিনমু।’ মানুষ, পশু-পাখির পর এবার বিভিন্ন উদ্ভিদের চিকিৎসা সেবা দেয়া শুরু হয়েছে। সাত রংয়ে মিশেল ঢাউস ছাতার নিচে আড়াআড়ি বসানো টেবিল। মুখোমুখি ক’টি প্লাস্টিক চেয়ার। দুটিতে বসা চৌকষ দু’কর্মী। টেবিলে রাখা হরেক প্রজাতির ফল-ফসলের লতাগুল্ম, কা-, ফল নেড়ে দেখছেন। রোগের বর্ণনা শুনে ব্যবস্থাপত্র লিখে লাইনে দাঁড়ানো কৃষকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এখানে রোগী হলোÑ গাছ, লতাপাতা, ফল, শাকসবজি, বেগুন, ডাব। আর চিকিৎসক হলোÑ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষিবিদরা। উদ্ভিদ চিকিৎসায় অভূতপূর্ব এ কেন্দ্রের নাম ‘প্ল্যান্ট ডক্টর ক্লিনিক’। গত ১৯ এপ্রিল থেকে তিন বছর মেয়াদী এ পাইলট প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এই উদ্ভিদ ক্লিনিক। দেশে প্রথমবারের মতো চালু হলো গাছের জন্যে হাসপাতাল। গাছ ও ফসলের বিভিন্ন রোগব্যাধি ও কীটনাশকের পরিমিত ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা এবং ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে কৃষককে জানাতেই এমন হাসপাতাল চালু হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে টাঙ্গাইলের দু’টি উপজেলায় চালু হয় এ হাসপাতাল। এ উদ্যোগ বেশ সাড়া ফেললেও রোগ নির্ণয়ের আধুনিক যন্ত্র না থাকায় কাক্সিক্ষত সেবা পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না। আপাতত প্রতি মাসে দু’বার চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে এসব হাসপাতালে। তবে এটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে জানান চিকিৎসকরা। টাঙ্গাইল সদরের দাইন্যা ইউনিয়ন এবং মধুপুরের ভবানিটিকি বাজারে এ ‘প্ল্যান্ট ডক্টর ক্লিনিক’ উদ্বোধন করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এটির উদ্যোক্তা। আন্তর্জাতিক সংস্থা কমনওয়েলথের সহযোগিতায় দেশের পাঁচ জেলার ১০ উপজেলায় পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে ‘প্ল্যান্ট ডক্টর ক্লিনিক’ চালু করা হয়েছে। টাঙ্গাইল সদর ও মধুপুর উপজেলা, শেরপুরের নকলা ও নালিতাবাড়ি, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা ও ফুলপুর, গাজীপুরের কাপাসিয়া ও কালিয়াকৈর এবং ঢাকার কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ রয়েছে। কীটনাশক ছাড়াই সেক্স ফেরোমেন পদ্ধতি গ্রহণ করে পোকা দমন, জমিতে অধিক ও সাথী ফসল উৎপাদনের নানা পরামর্শও দিচ্ছেন তারা। গাছের চিকিৎসার একই দৃশ্য চোখে পড়ে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নেও। পাকা সড়কের পাশে চেয়ারটেবিল সাজিয়ে বসা ক্লিনিকে কাজ করছেন মধুপুর উপজেলার উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা ও প্ল্যান্ট ডাক্তার শাহাদৎ হোসেন এবং উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা তাপস কুমার সরকার। তাদের সহযোগিতা করছেন সহকর্মী আলমগীর হোসেন। আর সদরের বিন্যাফৈর বাজারে ক্লিনিকের কাজ করছেন কৃষি কর্মকর্তা ওসমান গনি, আব্দুল জলিল মোল্লা। মধুপুরের কুড়াগাছা গ্রামের সবজি চাষী আলমগীর ক্লিনিকে এসেছেন একগাদা ফল ও সবজি নিয়ে। এক বিঘায় করল্লা, দেড় বিঘায় শসা এবং দুই বিঘায় ঝিঙে, ধুন্দল ও মিষ্টি কুমড়ার আবাদ করেছেন। এছাড়াও রয়েছে কাঁঠাল ও কলার আবাদ। জমির শসা গাছের পাতা কুঁকড়ে যাচ্ছে। গোড়া ফেঁটে কষ বেরিয়ে গাছ মারা যাচ্ছে। ঝিঙে ও কুমড়ায় ফল ছিদ্রকারী পোকার ব্যাপক উপদ্রব। রোগাক্রান্ত শসা ও কুমড়াও আনা হয়েছে। প্ল্যান্ট ডাক্তার শাহাদৎ হোসেন ব্যবস্থাপত্র দিলেন। ওষুধের পাশাপাশি মাছি পোকা দমনে সেক্স ফেরোমেন পদ্ধতি গ্রহণেরও পরামর্শ দেয়া হলো। এ সময় হাজির ভবানিটিকি গ্রামের আরেক সবজি চাষী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি জানান, ছত্রাকজনিত কারণে তার বেগুন গাছ মারা যাচ্ছে। কুমড়া, করল্লা, ঢেঁড়স ও শসার ফলনে ব্যাপক মন্দা। কর্তব্যরত প্লান্ট চিকিৎসক বর্ণনা শুনে এবং আলামত নিরীক্ষা করে পরাগায়নের অসুবিধায় ফলন বিপযর্য়ের কথা জানালেন। সে মতে ব্যবস্থাপত্রও দেয়া হলো। একইভাবে পিরোজপুর গ্রামের হাসেন আলী, কুড়াগাছার মোতালেব হোসেন, আঙ্গারিয়ার কদ্দুস ম-ল, মমিনপুরের আব্দুল হাইসহ শতাধিক কৃষক হাজির ফল-ফসলে পোঁকা ও রোগাক্রান্ত হওয়ার নানা সমস্যা নিয়ে। মধুপুরে বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী রয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার। আনারসের জন্য বিখ্যাত মধুপুরে ব্যাপকভাবে কলার আবাদের পাশাপাশি হলুদ ও আদাসহ সবজি চাষও হচ্ছে। গাছের এই হাসপাতালের মাধ্যমে এখানকার কৃষক ব্যাপকভাবে লাভবান হবে বলে মনে করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এ বিষয়ে মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. হযরত আলী জানান, জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুটে বিশ্বখ্যাত উদ্ভিদ হাসপাতাল রয়েছে। উন্নত দেশে এ নিয়ে উন্নতমানের চিকিৎসা ও গবেষণা হয়। আমাদের দেশে এটি নতুন ভাবনা। এ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা মাঠ পর্যায়ে ইতিবাচক সুযোগ পাচ্ছেন। কৃষকরা ক্লিনিকে নমুনা নিয়ে আসবেন। পরিবীক্ষণ করে ব্যবস্থাপত্র দেয়া হবে। এতে ক্ষতিকারক, চোরাই বা ভেজাল বিষ ব্যবহারের সুযোগ কমবে। বড় কথা, তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকের সঙ্গে কৃষিবিদদের সেতুবন্ধন তৈরি হবে। টাঙ্গাইল সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন খান বলেন, উদ্ভিদের এ ক্লিনিককে আরও জনপ্রিয় করার জন্য আমরা আশপাশের গ্রামের মানুষ, মসজিদ, মন্দির, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে লিফলেট বিতরণ এবং মাইকিং করে জানিয়ে দিচ্ছি। এছাড়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষিবিদ ও কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত কৃষকদের নজরদারি করছেন।
×