ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আইসিডিডিআরবির গবেষণায় তথ্য

দেশের ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর ২৫ শতাংশই কলেরা জীবাণুবাহী!

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১ জুন ২০১৫

দেশের ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর ২৫ শতাংশই কলেরা জীবাণুবাহী!

নিখিল মানখিন ॥ দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে কলেরা রোগীর জন্য পৃথক চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডায়রিয়া ও কলেরার পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের প্রায় ২৫ শতাংশই কলেরার জীবাণুবাহী বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কলেরা রোগীকে ডায়রিয়ার চিকিৎসা দিলে তার কার্যকর হয় না। দেশের অনেক এলাকায় এখনও কলেরার জীবাণুর সংক্রমণ বেশ গতিশীল। শুধুমাত্র ডায়রিয়ার চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেক কলেরা রোগীর মৃত্যু হয়ে থাকে। আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় ইতোমধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের অনেকেই কলেরার জীবাণুবাহী বলে শনাক্ত করেছে। দেশকে কলেরা রোগীমুক্ত ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সরকার। বর্তমানে ডায়রিয়ার মৌসুম চলছে। তাই কলেরার বিষয়ও আলোচনায় চলে এসেছে। আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা জানান, কলেরা সাধারণত মলের দূষিত পানি অথবা খাবারের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। কলেরার জন্য দায়ী জীবাণুর নাম ‘ভিব্রিও কলেরি’ এবং এই জীবাণুতে সারাবিশ্বে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ কলেরাজনিত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এক লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায় প্রতিবছর। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের দেশসমূহে, যেখানে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অস্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ খাবার পানির সরবরাহ অপ্রতুল। বাংলাদেশে কলেরা একটি বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। কলেরা যদিও টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য, তবুও এ রোগের প্রকোপ নির্ধারণ ছাড়া সাশ্রয়ী টিকাদান কর্মসূচীর মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। আইসিডিডিআরবির ঢাকা হাসপাতাল এবং মিরপুর চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রতিবছর দেড় লাখেরও বেশি ডায়রিয়া রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়। হাসপাতালভিত্তিক ডায়রিয়া রোগের সার্ভিলেন্স কর্মসূচীর অংশ হিসেবে এই হাসপাতাল দু’টিতে ভর্তি রোগীদের একটি নির্দিষ্ট অংশকে ‘ভিব্রিও কলেরি’ এবং অন্যান্য আন্ত্রিক রোগ পরীক্ষার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ঢাকার অন্যান্য হাসপাতালে ভর্তি ডায়রিয়া রোগীদের উপাত্ত এবং জনসংখ্যাভিত্তিক কলেরা রোগের তথ্য অপ্রতুল। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, আইসিডিডিআরবি এর ঢাকা হাসপাতাল এবং মিরপুর চিকিৎসা কেন্দ্রের আওতাভুক্ত এলাকা হতে যথাক্রমে ১ হাজার ৯০৩ এবং ১ হাজার ১৯৪ রোগী ডায়রিয়া সার্ভিলেন্সের আওতায় ভর্তি করা হয়। তাদের ‘ভিব্রিও কলেরি’র পরীক্ষা করা হয়। এদের মধ্যে ঢাকা হাসপাতালে ৩৩৯ এবং মিরপুর চিকিৎসা কেন্দ্রে ১৬৪ জনকে ভিব্রিও কলেরিতে আক্রান্ত দেখা গেছে। যেহেতু সার্ভিলেন্স হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মাত্র একটি ছোট্ট অংশকে ভিব্রিও কলেরি পরীক্ষা করা হয়, সেহেতু সার্ভিলেন্স হাসপাতালের আওতাভুক্ত এলাকা হতে ভর্তি সকল রোগীর মধ্যে ঢাকা হাসপাতালে ১৬ হাজার ৯৫০ এবং মিরপুর চিকিৎসা কেন্দ্রে ১ হাজার ৬৪০ রোগী ভিব্রি ও কলেরিতে আক্রান্ত ছিল বলে মনে করেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা। এভাবে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, আইসিডিডিআরবির ঢাকা হাসপাতালের আওতাভুক্ত এলাকার প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় ২৮০ এবং মিরপুর চিকিৎসা কেন্দ্রের আওতাভুক্ত এলাকায় প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় ৪৭৪ জন ভিব্রিও কলেরিতে আক্রান্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ঢাকা হাসপাতালের আওতাভুক্ত এলাকার কলেরার আনুমানিক হার ঢাকা শহরের কলেরার হার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই গবেষণায় সেসব ডায়রিয়া রোগীকে হিসাব করা হয়েছে, যারা কোন চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছিল অথবা নিজ নিজ বাড়িতে শিরায় শরীরের পানিশূন্যতা পূরণকারী স্যালাইন নিয়েছিল। তবে এর বাইরে কলেরায় আক্রান্ত কিছু রোগী হয়তো ছিল, যারা মারাত্মক ডায়রিয়ায় ভুগেছে এবং বাড়িতে বসে শুধুমাত্র খাওয়ার স্যালাইন অথবা অন্য কোন চিকিৎসা নিয়েছে। এই গবেষণায় তাদের গণনা করা হয়নি এবং সেজন্য এটি হাসপাতালের আওতাভুক্ত এলাকায় কলেরায় আক্রান্তের একটি রক্ষণশীল হার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। গবেষণা এলাকায় কলেরার আধিক্য বেশি। মানুষের আচরণ পরিবর্তন সংক্রান্ত ইন্টারভেনশন, হাত-ধোয়ার ব্যাপ্তি বাড়ানো এবং পানি ব্যবহারের স্থানে তা পরিশোধন করাসহ অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কলেরা আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনা যেতে পারে। তাছাড়া কম মূল্যে এখন কলেরার যে টিকা পাওয়া যায় তা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহে ব্যবহার হতে পারে। আইসিডিডিআরবি বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে মোট ডায়রিয়ায় আক্রান্তের মধ্যে ২৫ শতাংশই কলেরার জীবাণুবাহী বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিশেষ করে চার ক্যাটাগরিতে কলেরা জীবাণুবাহীদের ভাগ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে একজন মানুষ কলেরায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আক্রান্ত হলে তার মাধ্যমে আরও তিনজন সংক্রমিত হতে পারে। এমন হিসাব ভিত্তি করেই বাংলাদেশে বছরে কলেরার জীবাণুবাহী মানুষের সংখ্যা আনুমানিক প্রায় ১২ লাখ ধরা হয়েছে। তবে এদের সবাইকে কলেরা রোগী বলা যাবে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, প্রধানত দূষিত পানির কারণেই ডায়রিয়া ও কলেরার আধিক্য দেখা দেয়। তবে ডায়রিয়া-কলেরা ছাড়াও টাইফয়েড, জন্ডিস, চর্ম রোগসহ আরও বেশ কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে পানি দূষণের কারণেই। তাই মানুষের জন্য যত বেশি নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা যাবে ততই ডায়রিয়া বা পানিবাহিত অন্য রোগের প্রকোপ কমবে।
×