শর্মী চক্রবর্তী ॥ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাদের নয়নের মণি সাবিকুন নাহার (২৫)। ছোটবেলা থেকেই খুব কষ্ট করে বাবা-মা তাকে বড় করেছেন। মেয়েকে কখনও একটুও আঘাত পেতে দেননি। সবসময় বুকের মধ্যে আগলে রাখতেন। সেই মেয়ের ৮ বছর আগে ডিভোর্স হয়ে যাওয়া সাবেক স্বামীর হাতে এ্যাসিডদগ্ধ হয়ে এখন ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের বেডে কাতরাচ্ছেন। সঙ্গে দগ্ধ হয়েছেন মাও। তার মুখ ও শরীরের কিছু অংশ এ্যাসিডে ঝলসে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাবিকুন নাহারের বাঁ চোখ। ওই চোখ মেলে কিছু দেখতে পারছেন না তিনি। একই বেডে কাতরাচ্ছেন মা রোকেয়া বেগমও (৫০)। তিনিও এ্যাসিডদগ্ধ হয়েছেন। মা-মেয়ে দু’জনেই আর্তনাদ করছেন আর একটি কথাই বারবার বলছেন ‘আমরা তাদের শাস্তি চাই’। মেয়ের আর্তনাদে নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না মা। মাঝে মাঝেই নিজের শরীরের যন্ত্রণা ভুলে মেয়েকে একটু শান্তি দেয়ার চেষ্টা করছেন।
নরসিংদীর মনোহরদীতে ২৯ মে রাতে সাবেক স্বামীর ছোড়া এ্যাসিডে দগ্ধ সাবিকুন ও মা রোকেয়া। সাবিকুন নাহারের শরীরের ১৭ শতাংশ ও রোকেয়া বেগমের ৭ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের বাড়ি মনোহরদী উপজেলার চর মান্দালিয়া গ্রামে।
রোকেয়া বেগম জানান, ১২ বছর আগে স্কুলে পড়ার সময় একই গ্রামের দৌলতের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে হয়েছিল সাবিকুন নাহারের। দু’জনেই তখন অল্প বয়সের ছিল। পালিয়ে বিয়ে করায় কিছুদিন আমরা কেউ মেনে নেইনি। পরে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। বিয়ের কয়েক বছর পরই তাদের একটা ছেলে হয়। নাম জয় (৭)। ভালই চলছিল। কিন্তু তার স্বামী তখন কোন কাজ করত না। সারাদিন ঘুরে বেড়াত। আর সাবিকুন নাহারকে বলত বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে দেয়ার জন্য। এতে রাজি না হওয়ায় প্রায়ই সাবিকুনের ওপর নির্যাতন চালাত দৌলত। সে নিজে কিছু করত না। বাবার রোজগারে চলত সংসার। কোন কাজ না করায় টাকার জন্য সাবিকুনের ওপর নির্যাতন করত। প্রথম দিকে কাউকে কিছু না বলে নীরবে সহ্য করেন তিনি। কিন্তু তারপরও নির্যাতন কমেনি। দিনদিন এর মাত্রা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে সাবিকুন আর সহ্য করতে না পেরে বাবা-মাকে জানান। সবাই মিলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করে। এতেও কিছু হয়নি। একপর্যায়ে বাবার বাড়িতে চলে আসেন সাবিকুন। তখন তার ছেলেকে রেখে দেয় শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। আবার ফিরে গিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তখনও স্বামীর পরিবর্তন হয়নি, আবার নির্যাতন শুরু করে। এক পর্যায়ে কোনকিছু ঠিক না হওয়ায় ৮ বছর আগে স্বামী দৌলতকে ডিভোর্স দেন সাবিকুন নাহার।
রোকেয়া বেগম বলেন, তখন থেকেই সাবিকুন আমাদের সঙ্গে থাকে। আমাদের একটাই মেয়ে তার যেন কষ্ট না হয় সেই দিকে সবসময় নজর রাখতাম। কিন্তু আমাদের কাছে থাকার পরও ছেলের জন্য মন কাঁদত তার। নীরবে চোখের পানি ফেলত। আমাদের কিছু বলত না। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় ছেলে লুকিয়ে মায়ের কাছে আসত। দৌলতও বাড়ির আশপাশে ঘুরে বেড়াত। কিছু দিন ধরে সাবিকুন নাহারকে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল দৌলত। কিন্তু কয়েকবার ও বাড়িতে গিয়ে কিছু ঠিক না হওয়ায় এবার যেতে রাজি হয়নি আর। তার বাড়িতে যেতে না চাওয়ায় সাবিকুন নাহারের ওপর এ্যাসিড ছুড়েছে স্বামী দৌলত।
এ্যাসিডে দগ্ধ সাবিকুন নাহার বলেন, ২৯ মে শুক্রবার রাত দশটার দিকে তিনি ও তার মা ঘরে বসেছিলেন। ঘুমাতে যাওয়ার সময় তার সাবেক স্বামী দৌলত মিয়া জানালা দিয়ে তাদের লক্ষ্য করে এ্যাসিড ছুড়ে মারে। এতে মা-মেয়ে দু’জনে দগ্ধ হন।
তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন ধরেই আমাকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা করছিল দৌলত। আমি তাকে বলে দিয়েছিলাম, আমি তোমার বাড়িতে যাব না। তোমার সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তারপরও বারবার বিরক্ত করছিল। তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আমাদের ওপরে এ্যাসিড ছুড়েছে। এ্যাসিডে দগ্ধ হওয়ার পর প্রথমে তাদের মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে শনিবার ভোরে ঢাকা মেডিক্যালে আনা হয়। বর্তমানে তারা সেখানেই চিকিৎসাধীন।
এ বিষয়ে বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল বলেন, সাবিকুন নাহারের শরীরের যতটুকু পুড়েছে, তা আশঙ্কাজনক বলা যায়। তার বাঁ চোখ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মা রোকেয়া বেগম অবশ্য আশঙ্কামুক্ত। তাদের চিকিৎসা চলছে। আশা করছি দু’জনেই সুস্থ হয়ে উঠবেন।
সাবিকুন নাহারের পরিবার এ বিষয়ে মনোহরদী থানার ছয় জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন। এই মামলার প্রধান আসামি দৌলত।
এ বিষয়ে মনোহরদী থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানান, খবর পেয়ে তিনি নিজেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে সাবিকুন নাহার ও তার মা রোকেয়া বেগমকে দেখে এসেছেন। সাবিকুন নাহারের বাঁ চোখে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে সে সুস্থ হয়ে যাবে। তার মা রোকেয়া বেগমের হাত ঝলসে গেছে। দৌলতের মাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
পুলিশ খুঁজছে সাবেক স্বামীকে
আবার এ্যাসিড সন্ত্রাস! মেডিক্যাল বেডে যন্ত্রণাকাতর মা-মেয়ে
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: