ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

অন্ধকারের এই অপশক্তিকে রুখতে হবে

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১ জুন ২০১৫

অন্ধকারের এই অপশক্তিকে রুখতে হবে

আজকের মধ্যপ্রাচ্যের নিষ্ঠুর, গণহত্যাকারী ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে উত্থিত জঙ্গী আইসিস গোষ্ঠীর দৈনন্দিন গণহত্যার চিত্র দেখলে শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রবর্তক প্রচারক রাসুলে করিম হযরত মুহাম্মদ (দ.) কি প্রতিক্রিয়া দেখাতেন? কতটা ক্রুদ্ধ হতেন, কতটা কঠোর ঘোষণা দিয়ে ঐ আইসিস, তালেবান-আল কায়েদাকে ‘বিধর্মী, ‘অ-ইসলামী’, ‘কাফের’ ঘোষণা দিয়ে ধর্মচ্যুত করতেন, তা অনুমান করা অসম্ভব কিছু নয়। মহানবী তাঁর সময়ে সার্বক্ষণিক মারামারি, কাটাকাটিতে নিয়োজিত আরবদেশীয় উপজাতিগুলোকে কিছুটা শান্তি, শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপনের সংস্কৃতি ও সামাজিক এবং মানবিক নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অভ্যস্ত করে তুলতে তাঁর প্রবর্তিত ধর্মের বাণীতে বার বার যে ক’টি মূল্যবান নির্দেশ দিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ ১. কে মুসলমান, কে মুসলমান নয়, সে বিচার করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর, কোন মানুষের নয়। ২. আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে ভালবাসেন না। তিনি বার বার অনুসারীদের ভিন্নমতের মানুষের প্রতি সহনশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কাউকে ধর্মীয় মতভিন্নতার কারণে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নিতে নিষেধ করেছেন। কেননা তিনি ভালভাবেই তাঁর আরব সমাজকে জানতেন, যারা লড়াইবাজ, অসহিষ্ণু, নারীবিরোধী, তারা তাঁর অবর্তমানে তাঁর শিক্ষা থেকে কতদূরে সরে যেতে পারে এবং তাঁর শিক্ষাকে বিকৃত ও ভুলভাবে ব্যবহার করতে পারে। বর্তমানে, যখন পুরো বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান-তথ্যপ্রযুক্তির চরম উন্নতির কালে পদার্পণ করেছে, আবিষ্কার করছে নতুন নতুন তত্ত্ব, তখন ইসলামী জগত আবার স্বজাতিসহ ভিন্নধর্মী মানুষ হত্যার এক নতুন কালের অধ্যায় শুরু করেছে। তারা ফিরে গেছে চৌদ্দ শ’ বছর আগের সেই আইয়ামে জাহিলিয়ার অন্ধকার যুগে। ইসলামের জন্মকালের উপজাতি দ্বন্দ্ব পড়ে আরও বিস্তৃত হয়ে সুন্নি-শিয়া-কুর্দি, ইয়াজিদীসহ নানা শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়েছে যা হযরত মুহাম্মদের (দ.) আশা, স্বপ্ন ও শিক্ষার বিপরীত। এরকম দ্বন্দ্বে জড়িতরা আর যাই হোক ঐক্যবদ্ধ ইসলামী খেলাফত কখনই সৃষ্টি করতে পারবে না। কারণ, এদের প্রধান দল আইসিস-এর লক্ষ্য পশ্চিমাদের মতোই ধনসম্পদ, অর্থ, অর্থের উৎস তেলখনির ওপর আধিপত্য, লুটপাট দ্বারা সম্পদ আহরণ। ঐ একই তেলের লক্ষ্যে পশ্চিমা শক্তি, বুশ-চেনী-র‌্যামস্ফিল্ড যখন সাদ্দামকে সামান্য ছুতোয় ফাঁসি দেয়, গাদ্দাফীকে ক্ষেপিয়ে তোলা সম্পদলোভী উপজাতির দ্বারা নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, তখন কিন্তু সাদ্দাম, গাদ্দাফীর অনুসারীরা পশ্চিমা শক্তিদের সম্ভবত একটি শিক্ষা দেয়ার নামে ইসলামী খেলাফত বা আইসিস-এর অধীনে খুব সুসংগঠিত না হলেও কিছুটা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পশ্চিমা নাগরিক শুধু নয়, তাদের পুরাতন চিরশত্রু শিয়া, কুর্দি, ইয়াজিদী, আধুনিক শিক্ষিত সাংবাদিক, বিচারকদের ওপর হত্যার জন্য হামলা, আক্রমণ শুরু করেছে! ওদের বর্বরতা, সারি বেঁধে নিরীহ সেনা সদস্য, বেসামরিক যুবকদের হত্যার জন্য নিয়ে যাওয়ার যে ভিডিও ফুটেজ, শিরñেদের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা বাঙালীর মনে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শত্রু সেই আলবদর খুনী নেতা-কর্মীদের হাতে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী শিক্ষক, চিকিৎসক, পেশাজীবী, আইনজীবী, ভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী শুধু মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে বধ্যভূমিতে লাশ হওয়ার ঘটনার স্মৃতিকে স্মরণে আনে। তাহলে আইসিস, তালেবান-আল কায়েদা জঙ্গী দলগুলোর বর্বর কর্মকাণ্ড থেকে কি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সঠিক যেÑ ১. মুসলমানরা কি সংস্কৃতিবিরোধী? আইসিস কেন অত্যাশ্চর্য প্রাচীন গ্রেকো-রোমান, সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, আককাদীয় সভ্যতার স্থাপত্য ধ্বংস করে ধুলায় মিশিয়ে দিল? কেন তালেবান-আল কায়দা নেতারা আফগানিস্তানের বৌদ্ধ যুগের বিখ্যাত স্থাপত্য বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করে দিল? তাহলে ওরা কি সুযোগ পেলে অজন্তা, ইলোরা, তাজমহল, মোগল দরবার, সমাধি, সৌধ, লালকেল্লা, ফতেপুর সিক্রিÑ এসব ধ্বংস করে দেবে? ২. তারা কি নানা দেশে ‘ইসলাম ধর্ম’ রক্ষার নাম করে বার বার, যুগে যুগে, দেশে দেশে সব ধর্মের মিলনে তৈরি জাতিসত্তাকে, জাতীয়তাকে ধ্বংস করে দেবে? ৩. তারা কি বিজ্ঞানের চর্চাকারী, ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিপূর্ণ জ্ঞানালোচনাকে বর্জন করবে? এমনকি তারা হযরত মুহাম্মদের (স.) চৌদ্দশ’ বছর আগের নির্দেশ, বচন অমান্য করে নতুন এক মানুষ হত্যা, সভ্যতার ধ্বংসযজ্ঞের পরিচালক হবে। ‘ভিন্নমত’ ভিন্ন ধর্মানুসারীকে ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করে নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ হত্যায় উস্কানি দেবে? হত্যা করবে? ৪. ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, যার অর্থ ধর্ম ব্যক্তি নিজ জীবনে পালন করবে, কিন্তু রাষ্ট্র চলবে আইন-আদালত দ্বারা। আদালত হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, আদিবাসী ধর্ম পালনকারী সবাইকে তাদের বাস্তব জীবনের ক্ষতি, অধিকার খর্ব হওয়া, জীবন, সম্পদ, মান, জীবিকার ওপর সব রকম আঘাত-ক্ষতির শিকার হওয়ার কারণে উপযুক্ত আইন দ্বারা আঘাতকারী ও ক্ষতিকারীর বিচার করে দণ্ড প্রদান করে। এর অর্থÑদণ্ডিতের অপরাধের বিচার হয়, সে কোন্ ধর্মের অনুসারী তা বিচারক ও আদালতের কাছে গণ্য হবে না। মুসলমানরা কি এই অসাম্প্রদায়িক চিন্তাকে বর্জন করবে? ৫. এই বাঁশের কেল্লা বা উগ্র জিহাদীরা কি জানে যে, তারা মুসলিম বাবা-মার ঘরে জন্ম নিয়েছে বলেই মুসলিম হয়েছে। এতে তাদের গর্বের কিছু নেই। এটি আকস্মিক ঘটনা, যাতে তার নিজের কোন হাত নেই? সে তো হিন্দুর ঘরে, বৌদ্ধের ঘরেও জন্ম নিতে পারত। সুতরাং জন্মের ফলে পাওয়া ধর্ম নিয়ে এই ধর্মান্ধতা যে একেবারেই ভিত্তিহীন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ৬. আমার বিশ্বাস হয় না, মুসলমানরা এই যুক্তিপূর্ণ নীতিটি এই আধুনিক যুগে গ্রহণ করবে না। হযরত মুহাম্মদ (স.) সেই যুগে প্রচার করেছিলেনÑ ‘যার যার ধর্ম তার তার’। বর্তমানে এ কথার সঙ্গে শুধু যুক্ত হয়েছেÑ রাষ্ট্র সবার, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সব ধর্মের নাগরিকের নাগরিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ৭. প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলমানরা কি শতাব্দীর পর শতাব্দী, এমনকি হয়ত একটা সময় আসবে যখন পৃথিবীর মানুষ অন্য গ্রহ, উপগ্রহ থেকে খনিজসম্পদ আহরণ করবে বা ঐসব মানুষের বসবাসের অনুকূল পরিবেশের গ্রহ-উপগ্রহে বসতি স্থাপন করবে। তখনও কি মুসলমানরা একদল দরিদ্রের সন্তানের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখবে? কথা হলো, এদের কর্তাব্যক্তি মোল্লা-মৌলবীরা, বিশেষত জামায়াত-শিবিরের নেতারা তো তাদের সন্তানদের মাদ্রাসা শিক্ষা দেননি। দিয়েছেন অগ্রসর জীবনের লক্ষ্য অর্জনে সম্ভব ইংরেজীভিত্তিক পাশ্চাত্য ধরনের শিক্ষা। এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে! ইসলাম যেখানে বৈষম্য বর্জন করতে বলে, নারী ও দরিদ্রের জন্য সাম্য নিশ্চিত করতে বলে, সেখানে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ ‘মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠিত করে এর ভেতর কঠোর নিয়ম, খেলাধুলা, সঙ্গীত, নাটক, ছবি আঁকা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিশু, কিশোর-তরুণদের মুক্ত, তাদের নিজ দেশের সংস্কৃতিচর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করে! অথচ বিকৃত যৌনাচার কিন্তু তারা বন্ধ করতে পারে না। এই সঙ্গে নির্দয় প্রহার, শুষ্ক ধর্মীয় তত্ত্ব পাঠ দ্বারা আর কতকাল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বন্দী করে রাখবে? বহু আগে টোল উঠে গেছে। যেহেতু শিশু-কিশোর-তরুণদের জন্য টোল-শিক্ষা যুগের চাহিদার পক্ষে অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল এবং এ কথা তো স্বীকার করতেই হবে যে, হিন্দু ধর্মে অন্য ধর্মকে স্বীকার করে বলা হয়েছে, যত মত তত পথ। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা তাদের দেব-দেবীদের নিয়ে যত রঙ্গ-ব্যঙ্গ, তামাশা-নাটক ইত্যাদি করেন, তার ফলেই হিন্দু ধর্ম সব সময় একটা খরস্রোতা, সজীব প্রাণবন্ত নদীর মতো বয়ে চলেছে, যা যুগের সঙ্গে অনুসারীদের তাল মিলিয়ে চলতে বাধা দেয় না, বরং সাহায্য করে। সেজন্য এই ধর্মে পুরোহিত-ধর্মীয় নেতাদের কোন স্বধর্মীয় বা বিধর্মীকে ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’ ইত্যাদি ঘোষণা করে ভিন্ন মতাদর্শের জন্য কতল করার রুচিহীন, বর্বর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয় না! সুতরাং হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানÑ এদের শিশু, কিশোর, তরুণদের ‘মাদ্রাসা’ জাতীয় কোন বদ্ধ, কঠোর, আলো-আনন্দহীন প্রতিষ্ঠানে বন্দী করতে কোন প্রতিষ্ঠান তাদের ধর্মগুরুরা পরিচালনা করে না। সবাই সে কারণে সাধারণ আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে, হচ্ছে যুক্তিবোধসম্পন্ন, আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। এর মূল্য কি বাঁশের কেল্লা অনুসারীরা বিন্দুমাত্র উপলব্ধি করে? এক কথায় বলা চলে, মার খাচ্ছে শুধু মুসলমান পরিবারে জন্ম নেয়া শিশু, কিশোর, তরুণেরা! তাদের আনন্দ-বিনোদন, পোশাক, খেলাধুলা, পড়াশোনার ওপর নজরদারি করছে যারা, তারাই ভিন্ন মতাদর্শীকে ‘মুরতাদ’, ‘কাফের’ ইত্যাদি ঘোষণা করে মুসলিম কিশোর-তরুণদের মানুষ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করছে! এই হত্যার আহ্বান কি পুরোপুরি রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়? ভুল শিক্ষা আর কতকাল চলবে এবং এই বেআইনী ‘মুরতাদ’, ‘কাফের’, ‘কতলযোগ্য’ ঘোষণা দ্বারা যুক্তিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ তরুণদের হত্যার জন্য অন্য তরুণদের মগজধোলাই চলবে? কবে ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’ ঘোষণাকে নিষিদ্ধ করা হবে? এটা তো জানা কথা, হজের জন্য গিয়ে কেউ কেউ সৌদি আরবে চাঁদাবাজি করেছে। অনেক যুদ্ধাপরাধী তো লন্ডন থেকে চাঁদা তুলেছে আর হত্যাকারী, খুনী, জঙ্গী তৈরি করে, নিজেরা নিরাপদ, ধনসম্পদপূর্ণ নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করে! সরকারকে বলব, সমাজকে এগিয়ে নিতে যারা যুগোপযোগী জ্ঞান ও আদর্শ চর্চা করছে, তাদের মুরতাদ, কাফের, অ-ইসলামী ঘোষণা করাকে ফতোয়ার মতো অবৈধ ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে। একই সঙ্গে রাজীব, অভিজিত, দীপ, অনন্তÑ সবার হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। দেশকে পেছনে অন্ধকার যুগে নিয়ে যাওয়ার কাজে রত অন্ধকারের শক্তিকে জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য উৎখাত করতে হবে, দেশ ও জাতিকে বাঁচানোর স্বার্থে। যে কোন মূল্যে এই অন্ধকারের এই অপশক্তিকে রুখতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×