ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানীতে অর্ধশত ছিনতাইচক্র সক্রিয়

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৩১ মে ২০১৫

রাজধানীতে অর্ধশত ছিনতাইচক্র সক্রিয়

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর ৪৯ থানা এলাকায় অন্তত ৩ শতাধিক স্পটে অর্ধ শতাধিক সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয়। প্রতিবছর রাজধানীতে ছিনতাই হচ্ছে প্রায় ৪ হাজার সংখ্যক। কোটি কোটি টাকার ছিনতাই হচ্ছে। এ সময়ে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হচ্ছে অর্ধশতাধিক, আহত হচ্ছেন দুই সহস্রাধিক। আকস্মিকভাবে সম্প্রতি ছিনতাই বেড়ে গেছে রাজধানীতে। ডিএমপি ও ডিবি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্র জানায়, দিনে দুপুরে গত সপ্তাহে রাজধানীর মগবাজারে অস্ত্রের মুখে ৩৩ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ইস্কাটনে। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এমনকি ছিনতাইকারীদের হাতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু ছিনতাই হওয়া টাকা, স্বর্ণালংকার উদ্ধার হওয়ার ঘটনা কদাচিত। এমনকি ফিল্মি স্টাইলে কমান্ডো অপারেশন চালানোর মতো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। ছিনতাইকারীদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলোও উদ্ধার হচ্ছে না। ছিনতাইকারীদের উপদ্রব এতই বেড়ে গেছে, গত ছয় মাসে যেসব ছিনতায়ের ঘটনা ঘটছে তার একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় না টাকা উদ্ধার হয়েছে, না ছিনতাইকারী ধরা পড়েছে। এমনকি ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। রাজধানীর জনাকীর্ণ রাস্তায় প্রকাশ্যে দিবালোকে গুলি করে লাখ লাখ টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। মিরপুরের রূপনগর থানাধীন প্রশিকা ভবন মোড়ে স্বপ্ন সুপার শপ সংলগ্ন রাস্তায় ছিনতাইকারীরা বিকাশ এজেন্ট ও এক মোবাইল কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির গাড়িতে এলোপাতাড়ি গুলি করে ৯০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ছিনতাইকৃত টাকা অদ্যাবধি উদ্ধার হয়নি। গ্রেফতার হয়নি ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরাও। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে গোড়ান এলাকার ছিনতাইকারীরা আব্দুস সালাম (২৮) নামে এক দোকান কর্মচারীকে গুলি করে নগদ ২০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সাইদুল নামে আরেক কর্মচারীকে নিয়ে রিকশাযোগে দোকানের ২০ লাখ টাকা ঢাকা ব্যাংকের গোড়ান শাখায় জমা দিতে যাচ্ছিলেন। ব্যাংকের অদূরে ২টি মোটরসাইকেলে করে ২ জন ও হেঁটে ৪ দুর্বৃত্ত তাদের রিকশা গতিরোধ করে। তারা টাকা ভর্তি ব্যাগটি ছিনিয়ে নেয়ায় চেষ্টা করে। পরে তারা না দিলে ছিনতাইকারীরা তার বাম পায়ে ২ রাউন্ড ও ডান পায়ে ১ রাউন্ড গুলি করলে আহত অবস্থায় পথচারীরা তাকে প্রথমে খিদমা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের হার্ট ফাউন্ডেশনের সামনে থেকে ছিনতাইকারীরা আব্দুল আজিজ (৩০) নামে গ্রামে ফেরত এক রিকশাচালককে কুপিয়ে ১৫০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। পরে তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সম্প্রতি এ ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, বড় অঙ্কের টাকা ছিনতাই কিংবা ছিনতাইকারীদের হাতে খুন বা জখম হলে থানা পুলিশ ও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর ঘটনা জানাজানি হয়। কিন্তু সামান্য টাকা ছিনতাই হলে বা প্রাথমিক চিকিৎসায় আরোগ্য লাভের ঘটনা ঘটলে থানা, পুলিশ, হাসপাতাল, সংবাদ মাধ্যমে আসে না। আবার বেশিরভাগ সময়ই ছিনতাইয়ের শিকার যারা হন তারা থানা পুলিশের বাড়তি ঝুট ঝামেলা এড়ানোর জন্য তাদের শরণাপন্ন হন না। থানা পুলিশও তাদের এলাকায় অপরাধ কম হয়েছে তা উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে দেখানোর জন্য অনেক সময়ে ছিনতাই-সহ অপরাধের ঘটনা নথিভুক্ত করতে অনুৎসাহ বোধ করেন। এ কারণে থানা পুলিশের পরিসংখ্যানে কোন দিনই প্রকৃত ছিনতাইয়ের ঘটনার চিত্র ফুটে ওঠে না। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার রেকর্ডে যেসব স্থান স্পর্শকাতর ও ছিনতাইয়ের স্পট এবং যেসব স্পটে হরহামেশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে তার মধ্যে মালিবাগের এসবি অফিসের সামনে থেকে কাকরাইল মোড়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ১ নম্বর গেট থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনের আগে পীরজঙ্গি মাজার, শান্তিনগর মোড় থেকে ইস্টার্ন প্লাজা মার্কেট, মিরপুর-১ নম্বর গোলচত্বর থেকে টেকনিক্যাল মোড়, মহাখালী বাস স্ট্যান্ড থেকে গুলশান শ্যুটিং ক্লাব, মহাখালী কাঁচাবাজার, পান্থপথ মোড় থেকে ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে কাজলার পাড়, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে জনপথ মোড় হয়ে ধলপুর সিটি, মেরুল বাড্ডা থেকে রামপুরা ব্রিজ, মৌচাক থেকে মগবাজার মোড়, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া, বাবুবাজার ও হাতিরঝিল প্রকল্পের মতো স্পটে দিন-দুপুরে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। এছাড়াও নগরীর বিভিন্ন এলাকার গলিতেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা অধিকাংশ তরুণ। এদের মধ্যে রয়েছে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিার্থীরাও। নেশার টাকা জোগাড় করতে এসব তরুণ অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছে বলে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের তালিকায় যেসব ছিনতাইচক্র তৎপর আছে, তাদের মধ্যে রয়েছে বাড্ডার সোহেল, গুলশানের নাসির, ল্যাংড়া বাচ্চু, কাইল্যা সেন্টু, মিরপুইর‌্যা আকতার, এতিম মনির, ইমু, জাকির, আরিফ, সুলতান, জাহাঙ্গীর ও সাগর গ্রুপ। মিরপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া ও উত্তরায় ছিনতাইকারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে খলিফা গ্রুপ। মতিঝিল ও ওয়ারী এলাকার নেতৃত্বে রয়েছে মকবুল গ্রুপ। এদের প্রতি গ্রুপে ৭-৮ জন করে থাকে ওরা। প্রত্যেক দলের রয়েছে একাধিক মোটরসাইকেল। দিনের বেশির ভাগ ছিনতাইকালে দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেল ব্যবহার করে। প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসযোগেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। অনেক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়েও ছিনতাই-সহ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ছিনতাইকারীরা একেক সময় একেক ধরনের কৌশল অবলম্বন করে ফলে তাদের ধরতে অনেকটাই বেগ পেতে হচ্ছে। অধিকাংশ ছিনতাইকারী মোটরসাইকেলে আগ্নেয়াস্ত্র ও চাপাতি বহন করে থাকে। টার্গেট করা ব্যক্তিকে প্রথম চাপাতি দিয়ে আঘাত করা হয়। এতে কাজ না হলে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িতদের বেশি টার্গেট করছে দুর্বৃত্তরা। ছিনতাইকারীদের একটি অংশ এখন ছিনতাইকালে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে, পুলিশ পরিচয়ে দেহ তল্লাশির নামে যাত্রীদের নামায় রিক্সা বা গাড়ি থেকে।
×