ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশসমূহের পারমাণবিক চুক্তি

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২৯ মে ২০১৫

ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশসমূহের পারমাণবিক চুক্তি

মে মাসের প্রথম তিন সপ্তাহ আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। এই দেশে এই সময়ে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশসমূহের মধ্যে সম্ভাব্য পারমাণবিক চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে বিষয়টি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা ইরানের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র তৈরি ও তার বিস্তারণ সম্পর্কে একটি চুক্তিতে উন্নীত হওয়ার সমঝোতা ঘোষণা করেছেন। এ সমঝোতার ভিত্তিতে আগামী জুন মাসে এ চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গ অবয়বে সম্পাদিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এই চুক্তিতে এক পক্ষ ইরানের বিপরীতে দ্বিতীয় পক্ষ হিসেবে ছয় দেশ যথাÑ যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও চীন স্বাক্ষর করবে বলে জানা গেছে। চুক্তি স্বাক্ষর পূর্ব সমঝোতায় এই ছয় দেশ পি৫+১ জাতি হিসেবে এই সমঝোতায় পৌঁছার প্রক্রিয়ায় পরিচিতি লাভ করেছে। এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থা হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নও যুক্ত হয়েছে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পি৫+১ দেশসমূহে এই মে মাসে বেশ উষ্ণ আলোচনা চলছে। ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণকল্পে গবেষণা ও কর্মকা-ের সুনির্দিষ্ট তথ্য লাভ করে। এর আগে ইরান পারমাণবিক অবর্ধন চুক্তি (ঘঁপষবধৎ ঘড়হ-চৎড়ষরভবৎধঃরড়হ ঞৎবধঃু-ঘচঞ) স্বাক্ষর করেছিল। এই প্রেক্ষিতে ২০০৬ সালে ইরান পারমাণবিক অবর্ধন চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ অঃড়সরপ ঊহবৎমু অমবহপু-ওঅঊঅ) যথা প্রয়োজন পদক্ষেপ নেয়ার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলকে অনুরোধ জানায়। ২০০৬ থেকে শুরু করে চারবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের বলে ইরানের ওপর তার পারমাণবিক কর্মসূচী সীমিত ও বন্ধ করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপণ করে। নিরাপত্তা কাউন্সিল তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইরানকে এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সির সঙ্গে সেদেশে স্থাপিত সব পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করতে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা দিতে এবং (পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয়) ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সব কার্যক্রম বন্ধ করার আহ্বান জানায়। এই সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের সনদের ৭ম পরিচ্ছেদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইন অনুগামী সংশ্লিষ্ট সবপক্ষের জন্য কোন ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিপালনীয়। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের ওপর অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইরানের প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত তেল ও গ্যাস রফতানি বন্ধ বা সীমিতকরণ, ইরানের পেট্রো-রসায়ন শিল্পে শিল্পোন্নত দেশসমূহ থেকে প্রযুক্তি রফতানি বন্ধকরণ, যুক্তরাষ্ট্রে গচ্ছিত ইরানের ডলার সম্পদ হিমায়িতকরণ, ইরানের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ, মোটরযান উৎপাদনে সহযোগিতা প্রত্যাহার, শিল্প ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে যোগসূত্র সীমিত করে এবং যথেষ্ট অর্থ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার পাওয়া থেকে ইরানকে দূরে সরিয়ে দেয়। এই প্রেক্ষিতে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াত উল্লাহ খোমেনি ইরানের সব পারমাণবিক গবেষণা ও কার্যক্রম ধর্মবিরুদ্ধ বলে এক ফতোয়া দেন। এই ফতোয়া যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও অন্যান্য রাষ্ট্র অবিশ্বাস্য বলে প্রত্যাখ্যান করে। ২০১৩ সালে হাসান রৌহানী ইরানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধ বা সীমিত করে পশ্চিমের মিত্র দেশের সঙ্গে সে দেশের সম্পর্ক আবার উন্মোচন ও স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেন। এই সময়ে এই প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মাস্কাটে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত দেন। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সির প্রতিবেদন অনুযায়ী ইরানে বেশ সংখ্যক পারমাণবিক গবেষণা ও উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। এদের মধ্যে প্রধান হলো (১) তেহেরান গবেষণা রিএক্টর, (২) ইস্পাহান ইউরেনিয়াম রূপান্তর কেন্দ্র, (৩) নাতানজ জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ গবেষণাগার, (৪) ফোর্দ জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র (৫) আরাক পারমাণবিক গবেষণাগার এবং (৬) বোসেহের পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র। পি৫+১ দেশসমূহ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধারণা, এ সব গবেষণাগার ও কেন্দ্রের বাইরেও ইরান পারমাণবিক ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জনের জন্য অনেক প্রচেষ্টা বিভিন্ন স্থানে অববায়িত করেছে। এ ক্ষেত্রে ইসরাইলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশকে বিস্তারিত ও সময়ান্তরিক অতিরঞ্জিত তথ্য সরবরাহ করেছে। ২০০৬ সাল থেকে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক শক্তি ও গবেষণা সীমিতকরণ বিষয়ে পি৫+১ দেশসমূহ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমঝোতা বা চুক্তির মৌল সূত্র হিসেবে দাবি করেছে যে, ইরান পারমাণবিক মারণাস্ত্র উৎপাদন করবে না বলে ঘোষণা দিলে বা চুক্তি করলে ঐ সব দেশ ও সংস্থা অসামরিক ও শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের লক্ষ্যে ইরানকে পারমাণবিক জ্বালানি সমৃদ্ধ করতে পারমাণবিক অবর্ধন সম্পর্কিত চুক্তি (ঘঁপষবধৎ ঘড়হ-চৎড়ষরভবৎধঃরড়হ ঞৎবধঃু-ঘচঞ), যা ইরান এর আগে স্বাক্ষর করেছিল- তার আওতায় সহযোগিতা করবে ও সহায়তা দেবে। কয়েকবার আলোচনার পর ২০১৩-এর ২৪ নবেম্বর জেনেভায় একটি যৌথ কর্মসূচীর পরিকল্পনার মোড়কে ইরান ও পি৫+১ দেশসমূহের মধ্যে এ সম্পর্কিত বিষয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি হতে শুরু করে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের কয়েকটি অংশের ওপর স্বল্পকালীন স্থিতাবস্থা আরোপ করে ইরানের ওপর বিপক্ষ দেশসমূহ কর্তৃক আরোপিত যোগাযোগ বিষয়ক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসমূহ শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের সূত্র অনুযায়ী ভবিষ্যতে একটি সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে ২০১৪-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে আলোচনা করে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫-তে চূড়ান্ত চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে উভয়পক্ষ গঠনশীল ঐকমত্যে পৌঁছেন। এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুইজারল্যান্ডের লুজানে ২০১৫-এর ২৬ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত অনুপুঙ্খ আলোচনা ও দরকষাকষির পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক উচ্চপ্রতিনিধি ফেডেরিকা মোঘেরিনি এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ যুক্তভাবে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের কাঠামো বিষয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছান। এই সমঝোতায় গৃহীত সূত্র অনুযায়ী বলা হয়, ২০১৫-এর ৩০ জুনের মধ্যে এর ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত চুক্তি সম্পাদন করা হবে। এই সমঝোতা অনুযায়ী যুগ্মভাবে ঘোষণা করা হয় যে : ১. ইরান শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে যাবে এবং এই প্রক্রিয়ায় তার জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ ক্ষমতা ও মাত্রা এবং সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের মজুদ সুনির্দিষ্ট সময়সীমার ভেতর রাখা এবং নাতানজে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ছাড়া এই ক্ষেত্রে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনের জন্য অন্য কোন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত করা হবে; ২. ফোর্দয়ে প্রতিষ্ঠিত জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রটি পারমাণবিক পদার্থ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হবে এবং সেন্ট্রিফিউজ বা কেন্দ্রাভিগ শক্তি বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়ন পারস্পরিকভাবে সম্মত কাঠামোর আওতায় সম্পাদিত হবে; ৩. আরকে অবস্থিত ভারি পানি বিষয়ক গবেষণার রিএক্টরটি আন্তর্জাতিক যৌথ উদ্যোগের আওতায় নতুনভাবে নির্মাণ করে মারণাস্ত্র উৎপাদন অনুপযোগী কেন্দ্রে রূপান্তর করা হবে; ৪. ইরান কোন ইউরেনিয়াম পুনর্প্রক্রিয়াকরণের কার্যক্রমে হাত দেবে না এবং পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি দেশে না রেখে বর্হিবিশ্বে রফতানি করবে; ৫. আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি ইরানের পারমাণবিক গবেষণা ও উৎপাদন সম্পর্কিত সব বিষয়ে তত্ত্বাবধান করবে এবং এর বিপরীতে ইরান অসামরিক ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার, উৎপাদন, সরবরাহ এবং গবেষণা সম্পর্কিত বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে। এই সহযোগিতা পারমাণবিক নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ও অনুসরণীয় হবে; ৬. ইরান কর্তৃক করণীয় ও গ্রহণীয় এই সব কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর তাদের আরোপিত সব পারমাণবিক এবং আর্থিক নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেবে; এবং ৭. এই পদক্ষেপ নেয়ার শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি ইরান কর্তৃক তার দেয়া উপরোক্ত প্রতিশ্রুতিসমূহ রক্ষা করেছে কি না তা তদারক ও বীক্ষণ করবে। উপরোক্ত যৌথ ঘোষণাকে ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা ‘ঐতিহাসিক সমঝোতা’ বলে বিবৃত করেছেন এবং বলেছেন যে, এই সমঝোতা এই ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার নির্ধারিত মৌল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। বিভিন্ন সূত্র, বিশেষত এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির তরফ থেকে দেয়া তথ্য সংবলিত বিভিন্ন বিবৃতিতে জানা গেছে যে, এই ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মৌল লক্ষ্য ইরানকে ন্যূনপক্ষে এক যুগ পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে অসমর্থ এবং এই সময়ে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার মাধ্যমে ইরানকে পৃথিবীব্যাপী প্রবৃদ্ধির ধারায় সম্পৃক্ত এবং গণতান্ত্রিক ও মুক্তচিন্তাবিশিষ্ট সমাজে উন্নীত করে পরবর্তী যুগসমূহে ইরানের পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরির কার্যক্রম থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। এই সব লক্ষ্য অর্জন হলে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি ধর্মভেদ সে এলাকায় অস্থিতিশীলতা আনবে না। ইরানের রাষ্ট্রপতি হাসান রৌহানী ৩ এপ্রিল বলেছেন, এই ক্ষেত্রে তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করবেন এবং এসব প্রতিশ্রুতি ইরানের জাতীয় স্বার্থের কাঠামো অনুগামী হবে। এর বিপরীতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ৩ এপ্রিল বলেছেন, তারা এই সমঝোতা পছন্দ করেন না এবং তাদের মতে এই ধরনের সমঝোতা ইসরাইলের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এর আগে নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সভায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আমন্ত্রিত না হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সম্পাদনীয় এই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে আসেন। এর পরে ৯ এপ্রিল ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খোমেনি ঘোষণা করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ কর্তৃক ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাদি আগে প্রত্যাহার না করলে ইরান উপরোক্ত সমঝোতা অনুযায়ী সে সব দেশ ও সংস্থার সঙ্গে কোন চুক্তি সম্পাদন করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সভাপতি করকেল প্রকারান্তরে প্রস্তাবিত চুক্তি সমর্থন বা অনুমোদন করবেন বলে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। স্মর্তব্য, সিনেট কর্তৃক অনুমোদিত না হলে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক কোন চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে আপাত দৃশ্যমান মতানৈক্য সম্ভবত প্রস্তাবিত চুক্তিতে বিবৃত কার্যক্রমকেন্দ্রিক, মূল বিষয়ভিত্তিক নয়। খোমেনির এই ঘোষণার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পি৫+১ রাষ্ট্রসমূহ এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। আশা করা যাচ্ছে যে, গোপন ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনার ভিত্তিতে কোন্্ কাজটি আগে বা পরে কিংবা যুগপতভাবে হবে সে সম্পর্কে মতবিরোধ অচিরেই দূরীভূত হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট শেষ পর্যায়ে চুক্তিটি অনুমোদন করবে। রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেট এই ধরনের চুক্তি অনুমোদন না করলে তার বিকল্পে গত শতাব্দীর গ্যাট (এঅঞঞ) চুক্তির মতো একই রকম ধারা সংবলিত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা যেতে পারে বলা হচ্ছে। স্মর্তব্য, গ্যাট চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট অনুমোদন না করার জন্য এটিকে সমঝোতা স্মারক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবায়িত করে। এই প্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে লুজানে যে সমঝোতায় গত মার্চ ও এই এপ্রিলে এই বিষয়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে, সে অনুযায়ী একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি এ বছরের জুন মাসে ইরান ও পি৫+১ দেশসমূহের মধ্যে সম্পাদন করা সম্ভব হবে। ইরান ও পি৫+১ দেশসমূহের মধ্যে উপরোক্ত চুক্তি সম্পাদনের কতিপয় তাৎপর্য রয়েছে। এক. চুক্তির পরে ইরান তার তেল ও গ্যাসসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ নির্বিঘেœ এবং অধিকতর লাভজনকভাবে বিদেশে রফতানি করতে সক্ষম হবে। এর ফলে তেল ও গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজারে সম্প্রতি হ্রাস পাওয়া মূল্য অধিকতর হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এই সম্ভাবনা তেল ও গ্যাস আমদানিকারক স্বল্প উন্নত দেশসমূহের জন্য লাভজনক হবে। আর ইরান এসব রফতানি থেকে লব্ধ অতিরিক্ত আয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে ইরানের হিমায়িত সম্পদ এখন মুক্ত করে সে দেশের উন্নয়নে প্রযুক্ত করতে সমর্থ হবে। দুই, ইরানের অধিকতর উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আদান-প্রদান ইরানকে একটি মূলত ধর্মীয় রাষ্ট্র থেকে আধুনিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত করতে সহায়ক হবে। রাজতন্ত্র থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইরানের যে মাত্রায় প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিকতা অর্জনের হওয়ার পথে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল, তা পরে দৃশ্যত রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে সংশ্লিষ্ট করে থমকে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়। বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী হয়েও ইরান যতটুকু আধুনিক ও প্রগতিশীল এবং কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হতে পারত, তা সম্ভবত অনেকাংশে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে গেছে। প্রস্তাবিত চুক্তি ইরানকে সেই ইপ্সিত লক্ষ্যের দিকে ফিরিয়ে আনবে বলে মনে করা যায়। তিন, ইরানের সঙ্গে প্রস্তাবিত চুক্তি সম্পাদিত হলে উৎপাদন এবং আর্থিক ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে পি৫+১ দেশ ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ অধিকতর বিস্তৃত ও লাভজনকভাবে তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিকভাবে আদান-প্রদান ও বিনিয়োগ প্রযুক্ত করতে সমর্থ হবে। এই প্রক্রিয়ায় তেল ও গ্যাস উৎসারিত অধিকতর আয়ের বলে ইরান স্বদেশে সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী বিদেশী মুদ্রার বাজার ও নিকাশ ঘর গড়ে তুলতে পারবে। চার, এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও বিবর্তনের ফলে ইসরাইলের সঙ্গে ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়ে তা পৃথিবীর এই এলাকায় স্থিতিশীলতা ও শান্তি অর্জনে সহায়ক হবে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব, যার সাম্প্রতিক প্রতিফলন ইরাক-ইসলামিক রাষ্ট্রের যুদ্ধ, ইয়ামেনের হাউতি মতবাদীদের মাঝে সৌদি আরবীয় সুন্নি মতবাদীদের সশস্ত্র সংগ্রাম চুক্তি পরবর্তীকালে নিবারণ করা সহজতর হবে। একই সঙ্গে ইসরাইলের চরম বিরোধিতাকে অবজ্ঞা করে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের পক্ষ থেকে ইরানকে সহযোগিতাকরণ মধ্যপ্রাচ্যে রাষ্ট্রীয় শক্তির ইতিবাচক ভারসাম্য আনা সহজতর করবে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলভুক্ত ছয় দেশ অধিকতর সংহত অবস্থান নিয়ে এলাকায় বিস্তৃত সহযোগিতার পথ ও পন্থা উন্মুক্ত করবে। এই প্রেক্ষিতে এই চুক্তি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মধ্যপ্রাচ্য নীতি সফলকরণে বিশেষ মাত্রায় সহায়ক হবে। পাঁচ ও সর্বশেষ, প্রস্তাবিত চুক্তি সম্পাদন সফল হলে শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের লক্ষ্যে পারমাণবিক গবেষণা ও কার্যক্রম বিস্তারণের একটি কাঠামো সব রাষ্ট্রের জন্য অনুসরণীয় অবয়বে পাওয়া যাবে। ফলত এই ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান এবং উত্তর কোরিয়া তাদের অনুসৃত পারমাণবিক গবেষণা ও কার্যক্রম অন্যান্য পারমাণবিক পরাশক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণীয়ভাবে ও মাত্রায় প্রযুক্ত করতে পারবে এবং ফলত প্রাযুক্তিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গোলাকায়িত পৃথিবীর অগ্রগতি ইতিবাচক ও ত্বরান্বিত হবে। লেখক : রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী
×