ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এবারের বিষয় ॥ ভূমিকম্প- বাংলাদেশ

সমাজ ভাবনা

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৮ মে ২০১৫

সমাজ ভাবনা

প্রস্তুতি হোক জোরেশোরে লুৎফর রহমান ও শিফুলী রহমান বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বিবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত দেশ। গত ২৫ এপ্রিল নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্প বাংলাদেশকে নতুনভাবে প্রস্তুতি নেয়ার বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা প্রতিহতে মানুষ খুব সামান্য ভূমিকা রাখতে পারে, তবে প্রতিরোধের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন এবং তা ব্যাপকভাবে। পূর্বে বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে যে হারে ক্ষয়ক্ষতি হতো তা এখন অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ২০০৭ সালে সিডরের সময় মানুষের প্রস্তুতি এবং সরকারের সচেতনতা অবশ্যই প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ ভূখ- মূলত ভূমিকম্পপ্রবণতার দিক থেকে তিন অংশে বিভক্ত। উত্তরবঙ্গ এ ক্ষেত্রে প্রথমভাগে, সঙ্গে পাহাড়ী অঞ্চল রয়েছে। এছাড়া রাজধানী ঢাকা রয়েছে দ্বিতীয় অংশটিতে। তিন নম্বরে বা অপেক্ষাকৃত কম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল পটুয়াখালী এবং বরিশাল। সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্পের অতি প্রবণতার কারণ ভারতীয় এবং ইউরোপীয় প্লেট বাউন্ডারি। এটি বাংলাদেশের উত্তরে নেপাল-ভুটান সীমান্তের পূর্ব-পশ্চিমে ২৭০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এ প্লেট বাউন্ডারিতে মিয়ানমারের প্লেট সরে আসায় ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতা এবং ভয়াবহতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির যে আভাস বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন তা গা শিউরে উঠার মতো। ঢাকা শহরে প্রায় ৫-৬ লাখ ভবন। এগুলোর অধিকাংশ বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা হয়নি। ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার প্রায় ৩০ শতাংশ ভবন ধসে পড়বে। হতাহত হবে তিন লাখ মানুষ, ক্ষয়ক্ষতি হবে অর্থমূল্যে তিন বিলিয়ন ডলার। এখন প্রশ্ন আমরা কতটুকু প্রস্তুত এই প্রলয়ঙ্করী বিভীষিকার জন্য। নেপালের ভূমিকম্প আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। এখন আমাদের প্রস্তুতি নেয়ার সময়। যে কোন সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হবেই এই চিন্তা রেখেই প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমানো যায়। মিডিয়াই আমাদের এই সচেতনতার প্রধান নিয়ামক বলে মনে করি। কারণ এখন বাংলাদেশের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে ডিশ, পত্রিকা বা রেডিও নেই। সুতরাং মিডিয়ার সব মাধ্যমেই ভূমিকম্প সচেতনতামূলক এবং ভয়াবহতা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করা যেতে পারে। মূল উদ্যোগটা পালন করতে হবে সরকারকেই। জাতি হিসেবে আমরা দ্রুত কোন বিষয়ে খাপ খাইয়ে নিতে পারি। সুতরাং ভূমিকম্পের প্রস্তুতি বাংলাদেশে জোরেশোরে শুরু হোক এই কামনা। সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা থেকে চাই সুপরিকল্পনা মোঃ জামাল উদ্দিন বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সর্ম্পকে পূর্বাভাস পেলেও ভূমিকম্প সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়ার মত কিছু এখনও আবিষ্কার হয়নি। সাম্প্রতিক কালে নেপাল, ভারত সহ কয়েকটি দেশে ভূমিকম্পন হয়, এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণ নাশ ঘটে। এসব দেশের ভূমিকম্পের ফলে বাংলাদেশও ব্যাপকভাবে কেঁপে ওঠে। রাজধানী ঢাকা ভৌগোলিকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কারণ প্লেটের সংযুক্ত স্থলের খুব সন্নিকটে অবস্থিত। নেপালে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে যে পরিমাণ ক্ষয় ক্ষতি ও মৃত্যু হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে নেপালের ৪০-৫০ বছর সময় লেগেযাবে। রাজধানী ঢাকা দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে ১ কোটির ও বেশি মানুষ বাস করে। যদি ৮ মাত্রা বা তার বেশি কোন ভূমিকম্প এখানে হয়, তাহলে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে এখানেই। এমন আশঙ্কা ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনার প্রায় ৭০ শতাংশ মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়বে। কারণ দুর্বল অবকাঠামো ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ। দালানগুলো একটির সাথে অরেকটি ঘেষে ওঠানো। অত্যাধিক লোকজনের বাস, জেলা শহর বা উপজেলা শহরগুলোতে ইটের গাঁথুনি দিয়ে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই দালান তৈরি করা। সর্বোপরি সচেতনতা, সুকাঠামো ও সুপরিকল্পনার অভাবে এদেশের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হতে পারে। ভূমিকম্পনপ্রবণ এলাকায় দীর্ঘদিন ভূমিকম্প না হলে সেখানে প্লেটের সংযোগ স্থলে শক্তি জমা হয়ে বড় ভূমিকম্প হতে পারে। ভূমিকম্প যেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তাই শুধু ভূমিকম্পের ঝুঁকি পরিমাপ করে পরিকল্পনার মাধ্যমে ঝুঁকি কমিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। বাংলাদেশে সে রকম প্রস্তুতি কোথায়? এ জন্য বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রকৌশল ও প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া; নিম্নাঞ্চলে বালু ভরাট করে নির্মিত বাড়ি শনাক্ত করা ও এজাতীয় ভবন নির্মাণ বন্ধ করা। শহরে ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ স্থাপনা চিহ্নিত করে ভূমিকম্প মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ভারী শিল্পকে শহরের বাইরে নেওয়া, ভূমিকম্পন সহনীয় স্থাপনা নির্মাণ করা, বিল্ডিং তৈরিতে যাচাই করে অনুমতি দেওয়া এবং বিল্ডিং কোড মেনে চলা। ভূমিকম্পের ভয়াবহতা সম্পর্কে এবং ঝুঁকি এড়াতে জুরুরী অবস্থায় তাড়াহুড়ো না করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা। দেশের প্রচারমাধ্যমে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে, অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপন প্রচার করা। সর্বোপরি সচেতনতা, সুপরিকল্পনা দিয়ে ঝুঁকি কমানো যায়। যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ভূমিকম্পে করণীয় সম্পর্কে কিছুই জানে না, তাদেরকে জানানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের ভূমিকম্প মোকাবেলার মত শক্তি খুবই কম। ফলে সচেতনতা সুপরিকল্পনার মাধ্যমে বড় ধরনের ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখন থেকে নিতে হবে। না হলে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগই সকল স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে পারে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূমিকম্প ও সুনামির আশঙ্কা এস এম মুকুল বাংলাদেশ এশিয়ার দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর অন্যতম। আমাদের শহরগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নগর কার্যক্রম সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোগের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ক্রমেই বেড়ে চলছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট অঞ্চলের গড়ে ওঠা অসংখ্য অপরিকল্পিত নির্মাণ কাঠামো ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবেলায় কতটা সক্ষম সে ব্যাপারে যথেষ্ট আশঙ্কা আছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সুনাম আছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলার অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু সুনামি ও ভূমিকম্পের মতো বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নেই। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে সৃষ্ট সুনামিতে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার লোক মারা যায়। তাই সুনামি আঘাত হানলে তা মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু সেটা নিয়ে সবার মনেই সংশয় থেকেই যায়। জানা গেছে, ভূতাত্ত্বিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প এবং তা থেকে সৃষ্ট সুনামির ঝুঁকি রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে তীব্র ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশসহ বঙ্গোপসাগরের উত্তরাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় সুনামি আঘাত হানার আশঙ্কা প্রবল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ অঞ্চলের ৫০০ কিলোমিটার এলাকায় ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেরও আশঙ্কা আছে। ফলে ইন্দোনেশিয়ার মতো বাংলাদেশের উপকূলেও ভয়াবহ সুনামি দেখা দিতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা নগরীর অর্ধেকেরও বেশি ভবনের ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। পুরান ঢাকায় প্রকৌশলীদের পরামর্শ, ডিজাইন বা সাহায্য ছাড়াই তৈরি হয়েছে ৬০ শতাংশ বাড়িঘর। ৬৫ শতাংশ বাড়িই ইট-সুরকির তৈরি। সমীক্ষায় প্রাপ্ত উপাত্ত দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় ৫ দশমিক ৫ রিখটার স্কেল মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এবং ৭ থেকে ৮ রিখটার স্কেল মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দালানকোঠা, ভবন বা ঘরবাড়ি ধসে পড়বে। ঢাকার প্রায় ৬৫ শতাংশ এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে নরম মাটিতে কিংবা জলাশয় ভরাট করা জায়গায় ৯ থেকে ১৪ তলা ভবন তৈরি। এতে ভূমিকম্পে পুরো বাড়িই ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভূমিকম্প ঝুঁকি থেকে বাঁচতে বাড়িঘর নির্মাণের সময় প্রকৌশলীদের দিয়ে নক্সা তৈরি, তত্ত্বাবধান ও জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় পাড়ায়, মহল্লায় স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সেখানে জনসাধারণের পাশাপাশি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, টেকনিশিয়ান, মিস্ত্রি ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত পেশাজীবীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্থানীয় সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, পূর্ত বিভাগ, বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গ্যাস, টিএ্যান্ডটি বোর্ড, অগ্নিনির্বাপণ বিভাগ ইত্যাদি সংস্থার উদ্ধারকারী দল, প্রয়োজনীয় লোকবল ও সরঞ্জামাদিসহ সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত এবং সমন্বিত থাকা উচিত। জনসাধারণকে ভূমিকম্প মোকাবেলায় সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক মহড়া অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা জরুরী। সঠিক বিল্ডিং কোড অনুসরণ, ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিকায়ন, ফায়ার সার্ভিসের যন্ত্রপাতি ও দুর্যোগ মোকাবেলায় দক্ষ জনবল তৈরি ক্ষয়ক্ষতি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। দক্ষ জনবল তৈরিতে প্রয়োজনে বিদেশী বিশেষজ্ঞ টিমের সাহায্য নেয়া উচিত। ভূমিকম্পের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে জনগণ এবং সরকারকে আরও সচেতন হতে হবে। বিশে^র সর্বত্র এখন ভূমিকম্পের যে ভয়াবহ আশঙ্কা বিরাজ করছে, কখন জানি প্রাকৃতিক বিপর্যয় ল-ভ- করে দেয় কোন্ জনপদ এই আশঙ্কা সবার মনে। তাই মনে প্রশ্ন জাগেÑ এই আশঙ্কাময় বাস্তব পরিস্থিতি মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ? ঢাকা থেকে সাহস রাখতে হবে কানিজ ফাতেমা ওনিশা সাহস হারালে চলবে না, ভূমিকম্পের সময় মাথা ঠা-া রাখতে হবে। দুয়েক তলা ভবন হলে সে সময় দৌড়ে ঘরের বাইরে যাওয়াই শ্রেয়। বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে দ্রুত বেরোতে না পারলে খাট বা টেবিলের নিচে আশ্রয় নেয়া ভাল। কাঁচের জানালা থেকে দূরে থাকতে হবে। সবাই একযোগে সচেতনভাবে কাজ করলে ভূমিকম্পের মতো অন্যরকম মহাদুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব। ঝিলতুলি, ফরিদপুর থেকে ত্রুটিপূর্ণ স্থাপনাবহুল রাজধানী আকরাম খান ইতোমধ্যে দেশের অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, রাজধানী ঢাকার ৯৫ শতাংশ স্থাপনাই ত্রুটিপূর্ণ। বিল্ডিং কোড দূরের কথা, মালিকের ইচ্ছা ও পরিকল্পনায় রাজমিস্ত্রিদের পরামর্শে এই মহানগরীর অধিকাংশ বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি টিনশেডের উপযোগী দেয়ালের ওপর তিন তলা ভবন, তিন তলার ওপর নয় তলা ভবন নির্মাণ করেছেন অতিলোভী ও অবৈধভাবে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া ব্যক্তিগণ। ঢাকামুখী জনস্রোত অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় একদিকে আবাসিক সঙ্কটের চাহিদা পূরণ, অন্যদিকে কর্মমুখী জনস্রোতকে কাজে লাগাতে লাভজনক ব্যবসা-বাণিজ্য ও কলকারখানা গড়ে তুলতে মালিক মহাজনরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ঢাকার আয়তন বেড়েছে রাতারাতি, হাল্কা ও ভারি স্থাপনাও নির্মিত হয়েছে যত্রতত্র মাটির বহন ক্ষমতা পরীক্ষা করা ছাড়াই। শুধু খাল, বিল, পুকুর, ডোবাই নয়, রাজধানীর বর্জ্য ফেলা হয় যেসব স্থানে নিয়ন্ত্রকারী কর্তৃপক্ষ ও মালিকদের যোগসাজশে তার ওপরও গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল আকৃতির বহুতল ভবন ও কারখানা। কেবল ঢাকা মহনগরীতেই নয়, দেশের অন্যান্য শহর-বন্দরেরও অবস্থা প্রায় একই। যানজট কমাতে এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, উড়াল সেতু, পাতাল রেল ইত্যাদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে বহুতল ঢাকারও স্বপ্ন দেখছি আমরা। এতসবের পরও ঢাকাকে রক্ষা করা যাবে কিনা, ছাপ্পান্নœ হাজার বর্গমাইল এলাকা থেকে ঢাকামুখী জনস্রোত বন্ধ হবে কিনা, সে বিষয়গুলো কেউ ভেবে দেখছি না। ঢাকাসহ বাংলাদেশকে ভূমিকম্পপ্রবণ বলে গণ্য করা যায়। ১১৮৫ খ্রিস্টাব্দে সর্বশেষ ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ইতিহাস আছে। যার মাত্রা রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বেশি ছিল বলে জানা যায়। ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার ও মধুপুর এলাকার টিলারগুলোর উৎপত্তি ওই ভূমিকম্পের ফলেই হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কারিগরি ত্রুটি ও নি¤œমানের নির্মাণ সামগ্রীর কারণে দেশে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে শুধু ঢাকা নগরীতেই ৮৫ শতাংশ স্থাপনা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। প্রাণহানির আশঙ্কা কমপক্ষে ৬০ শতাংশ। সবচেয়ে বড় কথা, এমনটি হলে ঢাকার রাস্তা পরিষ্কার করতে সময় লাগবে ৩ বছর, উদ্ধার কাজ শুরু করতেই চলে যাবে ১২০ দিন। এমনকি প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ উদ্ধার কাজে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি ও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে যাবে, যে কারণে দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা। সম্প্রতি নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির খবরে আশঙ্কা, উদ্বেগ, পরামর্শের যে ঝড় বইছে আগামী এক দেড় মাসের মধ্যে হয়ত আমরা সব ভুলে যাব। ভবিষ্যতে কোন ভয়াবহ দুর্যোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ ঢাকা মহানগরী যদি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, সেদিন কে, কার কাছে এতসব অনিয়ম, অবহেলার বিচার চাইবে সেটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ-দাতা, অভিযুক্ত এবং দ-প্রার্থীর শূন্যতা যেন সেদিনের জন্য অপেক্ষা না করে। দেশের যে কোন শহর বা নগরের নগরায়ন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি যে ত্রুটিপূর্ণ এটাই সত্য। যেহেতু ভূমিকম্প প্রতিরোধের সক্ষমতা মানুষের নাই, সেহেতু এখন থেকেই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। ভূমিকম্প কবলিত কোটি মানুষের জীবন এবং সম্পদ বাঁচাতে অবিলম্বে ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তর করতে হবে। ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং প্রশাসনিক দফতরসমূহ নতুন রাজধানীতে ভূমিকম্প সহনীয় স্থাপনা নির্মাণ করে সংরক্ষণ করতে হবে। আমাদের শহর বন্দরের ভবনে বসবাসকারী সকল মানুষ ভবন থেকে বেরিয়ে এলে দাঁড়ানোর মতো রাস্তা বা খোলা জায়গাটুকু যে নাই সে কথা বিবেচনা করে সবার আগে নগরায়নের নিয়মনীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতেই হবে। মধুখালী, ফরিদপুর থেকে এক সেকেন্ডেই! শারমিম সুলতানা মিম ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা’ কথাটি আজব হলেও গুজব নয়। তার প্রমাণ মিলেছে কয়েক দফা ঘনঘন ভূমিকম্পে। বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে দেশের মানুষের মনকে নাড়া দিতে বেশ সক্ষম হয়েছে। গত ২৫ এপ্রিল ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ছিল নেপাল এবং পরে তা আঘাত হানে বাংলাদেশে। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। পরের দিন ২৬ এপ্রিল ও গত ১২ মে মিলে কয়েক দফায় আঘাত হানে ভূমিকম্প। এতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় শহরের উঁচু কিছু দালান হেলে পড়ে এবং চরম দুর্ভোগের ভেতরে পড়ে মানুষজন। আতঙ্কিত মানুষ তাদের জানমাল রক্ষার্থে নেয় বিভিন্ন পদক্ষেপ। কিন্তু বলতেই হচ্ছে ধ্বংস হয়ে যেতে শুধু একটা সেকেন্ডই যথেষ্ট সময়। তাই সাবধানের কোন মার নেই। আমাদের একটু সাবধানতাই অনেক বেশি কিছু রক্ষা করতে পারে। ভূমিকম্পের সময় প্রধান কাজ হলো ফাঁকা স্থানে অবস্থান করা। গ্রামাঞ্চলের মানুষজন সহজেই ফাঁকা স্থানে যেতে পারে। কিন্তু যারা শহরে থাকি তাদের ফাঁকা জায়গায় থাকাটা বেশ কষ্টসাধ্য। রাজশাহী থেকে এ কেমন আচরণ রাজীব চক্রবর্তী সবকিছু ভালই চলছিল, হঠাৎ কেন যেন প্রকৃতির ব্যবহারে মানুষের মনে চিন্তার ঝড় বইছে। আতঙ্কে আজ বাংলাদেশের মানুষ। আবারও ভূমিকম্পকে চিনল নতুন করে। যেদিন প্রথম ভূমিকম্প হলো আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, আর ফোনে কথা বলছিলাম। হঠাৎ মাথা ঘুরছে, কিন্তু না, লোকজনের ছোটাছুটি দেখে মনে হলো কিছু একটা হয়েছে। তারপর যা হয়। আমিও রোদের ভেতর রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাই। ছোট থেকে এখনও এমন ভূমিকম্প আর দেখিনি, মনে হয় ভূমিকম্প রাজত্ব করছে আমাদের এই দেশে। তার পরও কিছু করার নেই প্রকৃতির এই আচরণে। কিন্তু একটু হলেও মনে দাগ লাগে নেপালের ভূমিকম্পে কত মানুষ মারা গেছে। ঈশ্বর, এইভাবে মানুষ মেরো না। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, মানুষের একটাই ভাবনা, যে কোন সময় আবার ভূমিকম্প হতে পারে। আরও কিছু মানুষ আছে ভূমিকম্পের পর থেকে সবারই মাথা ঘুরছে। নালিতাবাড়ী, শেরপুর থেকে
×