ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নেপালে বন্যার বিরূপ প্রভাব পড়বে না বাংলাদেশে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৭ মে ২০১৫

নেপালে বন্যার বিরূপ প্রভাব পড়বে না বাংলাদেশে

শাহীন রহমান ॥ নেপালে ভূমিকম্পের ফলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও এর কোন প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না। একই কারণে দেশে কোন বন্যার আশঙ্কাও করছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে বাংলাদেশের বন্যা নির্ভর করছে মূলত বর্ষা মৌসুমের অতিবৃষ্টি ও বৃষ্টির ফলে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির ওপর। তবে তারা বলছেন, এবারের সিজনাল প্যাটার্ন অনুযায়ী বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এর সঙ্গে নেপালের ভূমিকম্প সৃষ্ট বন্যার কোন সম্পর্ক নেই। যদি বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি হয় এবং তাপমাত্রার কারণে অধিক পরিমাণ বরফ গলতে শুরু করে তাহলেই কেবল দেশে বড় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। গত ২৫ এপ্রিল ও ১২ মে নেপালে পরপর বড় দুটি ভূমিকম্প হয়। এর ফলে নেপালে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় নেমে আসার পাশাপাশি সেখানে বড় ধরনের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ভূমিকম্পের ফলে নেপালের পাহাড়ের প্রায় চার হাজার ফুট উপর থেকে বরফের চাঁই ও পাথরখ- ভেঙ্গে পড়ার কারণে নেপালের প্রধান নদীগুলোর গতিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে পানি উপচে পড়ে নদী উপত্যকা এলাকায় অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে নেপালে লাংতাং উপত্যকার আটটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া পিসাং নদী উপত্যকায় একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও নেপালের অন্যতম প্রধান নদী কালিগ-ক নদীর গতিপথ বরফ ও পাথরখ- পড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর এই গ-ক নদীর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এ অঞ্চলে প্রধান নদী গঙ্গার। বিশেষজ্ঞদের মতে গঙ্গার বেশিরভাগ পানি আসে নেপালের কালিগ-ক, কোশি, কার্নালী থেকে। কার্নালী নদী নেপাল থেকে ৪০ ভাগ পানি বয়ে গঙ্গায় নিয়ে আসে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালের এসব বড় নদীতে চারহাজার ফুট উচ্চ পাহাড় থেকে বরফ ও পাথরখ- ভেঙ্গে পড়লেও তাৎক্ষণিকভাবে এসব নদী উপচে আশপাশের এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়ে পড়তে পারে। যদিও এসব বরফগলা পানির সবটুকুই বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়বে। কিন্তু ভাটির দেশ হওয়ার কারণে নেপালের বন্যার সরাসরি কোন প্রভাব পড়বে না বাংলাদেশে। বর্ষা মৌসুমে কেবল অতিবৃষ্টি হলে বন্যা হতে পারে। তাদের মতে হিমালয়ের বরফ অনেক আগেই গলতে শুরু করেছে। ভেঙ্গে পড়া বরফখ-ের কারণে নেপালেই ভয়াবহ বন্যা দেখা দিতে পারে। তাৎক্ষণিক ওভার ফ্লো হতে পারে। এ বিষয়ে পরিবেশ, পানি ও নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ইনামুল হক বলেন, হিমালয়ের বরফখ- তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আগেই গলতে শুরু করেছে। নেপালে নদীতে ভেঙ্গে পড়া বরফখ- গলে বাংলাদেশের ভেতরে কোন বন্যার সৃষ্টির আশঙ্কা নেই। তাৎক্ষণিকভাবে এর একটা প্রভাব নেপালে পড়লেও বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা নেই। আগামী বর্ষা মৌসুমেও কোন প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে কেবল অতিবৃষ্টি হলে বন্যার আশঙ্কা বেড়ে যায়। কিন্তু অতিবৃষ্টির পূর্বাভাস এখনই দেয়া সম্ভব নয়। এছাড়া বর্ষার শুরুতে যদি দেশে অতিবৃষ্টি দেখা দেয় তাহলে হিমালয় অঞ্চলে অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা কমে যায়। দেশে বন্যা নির্ভর করছে অতিবৃষ্টির ওপর। অন্য কিছুর সঙ্গে দেশের বন্যা হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। পরিবেশ, পানি ও নদী বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ এত ভাটিতে অবস্থিত যে নেপালের প্রভাব এদেশে পড়ার কোন আশঙ্কা নেই। দেশে বন্যা হলে অতি বৃষ্টির কারণে হতে পারে। এটা যে কোন বর্ষা মৌসুমেই হতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে বরফের চাঁই পড়ে নেপালের নদীগুলোর ওভার ফ্লো হওয়ার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। যদিও তিনি বলেন, হিমালয় থেকে নেমে আসা বরফ গলা পানি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়বে। কিন্তু এ কারণে দেশের ভেতরে বন্যার আশঙ্কা নেই। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক শাহ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বন্যা নির্ভর করে মূলত অতিবৃষ্টি, বেশি তাপমাত্রার কারণে বরফগলা পানি এবং পাহাড়ী ঢলের ফলে নেমে আসা পানির ওপর। তিনি বলেন, এসব বিষয়ের ওপর সাধারণত বন্যা পরিস্থিতি নির্ভর করলেও নেপালের বন্যার কোন প্রভাব এদেশে পড়বে না। তবে তিনি উল্লেখ করেন নেপালের বন্যার কোন প্রভাব না থাকলেও এবার সিজনের প্যাটার্ন অনুযায়ী বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে এবারের মৌসুমের শুরুতে অধিক বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে। এ কারণেই এবার বন্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে তা নির্ভর করছে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর। এছাড়া আর অন্য কোন কারণে দেশে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। যদিও বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন নেপালের প্রধান প্রধান নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর সম্পর্ক রয়েছে। তাদের মতে ভৌগোলিকভাবে গঙ্গা নদীর উৎপত্তি ভারত থেকে হলেও গঙ্গার বেশিরভাগ পানি আসছে নেপালের কালীগ-ক, কোশি ও কার্নালী নদী থেকে। এর মধ্যে কার্নালী নদী থেকে গঙ্গা নদীতে ৪০ ভাগ পানি প্রবাহিত হয়। অপর দিকে নেপাল থেকে ভারতের বিহারে ঢুকে কালীগ-ক হয়ে গেছে গ-ক। গত ২৫ এপ্রিল ও ১২ মে নেপাল থেকে উৎপত্তি হয় ভয়াবহ মাত্রার ভূমিকম্প। এছাড়া হিসেবে পরিচিত ভূমিকম্প পরবর্তী কম্প হয়েছে বহুবার। আর এ বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে পাহাড়ের চার হাজার ফুট উঁচু নদীখাতে বহু দিন ধরে জমে থাকা বরফের চাঁই এবং ছোট-বড় পাথর নেপালের প্রধান প্রধান নদীতে আছড়ে পড়েছে। এতে নেপালে নদীর গতিপথ বন্ধ হয়ে উপত্যকা এলাকার অনেক গ্রাম তলিয়ে গেছে। বদলে গেছে ওইসব উপত্যকার ভৌগোলিক চেহারা। ভূতাত্ত্বিক জরিপে দেখা গেছে নেপালের ভূমিকম্পের ফলে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে লাংতাং নদী উপত্যকা। এ উপত্যকার এই বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে নেমেছে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা, মার্কিন ভূ-বিজ্ঞান (ইউএসজিএস) এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট (আইসিআইএমওডি)-র একটি যৌথ সমীক্ষক দল। লাংতাং নিয়ে আইসিআইএমওডির টাস্কফোর্স নেপাল সরকারকে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে এলাকায় এখন পাথর আর গলতে থাকা বরফের চাঁই ছাড়া কিছু নেই। এসব সংস্থার পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, পরপর তিনটি ভূমিকম্প আর আফটারশকের কারণে নেপালের আশপাশের পাহাড় থেকে পাথর আর বরফ নেমে এসেছে পিসাং নদীতে। জলের প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে নদীতে। পাহাড় জুড়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ফাটল। তার কোনও একটা দিয়ে বিপুল জলরাশি বেরিয়ে এলে তা পাহাড় নেমে আসা পানিতে নিম্ন পিসাং উপত্যকার গ্রামগুলোকে পুরো ভাসিয়ে দিতে পারে। এছাড়া আগামী বর্ষা মৌসুম ঘিরেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে উপর থেকে যখন বিপুল জলরাশি এসে পিসাং নদীর বুকে জমা হবে, তার পরিণতিও একই রকম ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এসব কারণে নেপালে নদীর গতিপথ বদল এবং হঠাৎ জলপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ভারতেও।
×