ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পুকুর জলাধার ও বিভিন্ন উৎস চলে যাচ্ছে ব্যক্তি দখলে

উপকূলীয় জনপদে নিরাপদ পানির হাহাকার

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৭ মে ২০১৫

উপকূলীয় জনপদে নিরাপদ পানির হাহাকার

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা ॥ প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে মেয়েকে নিয়ে গৃহবধূ শ্যামলীর সকাল থেকে অপেক্ষা দু’কলস পানির জন্য। ভোর থেকে লাইনে বসে বেলা ১০টায় ট্যাপে বসাতে পেরেছে তার কলস। শুধু ঢেবুখালি নয়, কলাবাড়িয়া, বাবুরাবাদসহ এই পানি প্রকল্পের চারধারের ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরের গ্রামগুলোর বেশিরভাগ পরিবারের নারী, শিশু, পুরুষদের অপেক্ষা করতে হয় এক কলস মিষ্টি ও নিরাপদ পানির জন্য এই আটশত বিঘা পানি সরবরাহ প্রকল্পে। নিরাপদ ও মিষ্টি পানির জন্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের তিন জেলায় চলছে হাহাকার। এক কলস পানির জন্য উপকূলের মানুষদের ছুটতে হচ্ছে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের অন্য গ্রামে। এক কলস খাবার পানি সংগ্রহের জন্য দিতে হচ্ছে দীর্ঘ লাইন। পরিবারের নারী, পুরুষসহ শিশুদেরও এই পানির জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করতে হয়। তীব্র দাবদাহের মধ্যে সকাল থেকে দুপুর, আবার দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানির জন্য অপেক্ষা উপকূলবাসীর প্রতিদিনের রুটিন ওয়ার্ক। এই অঞ্চলের মিষ্টি পানির পুকুর, জলাধার ও উৎসগুলো চলে গেছে ব্যক্তি দখলে। সমস্যা ও সঙ্কট সমাধানে খুলনা ডিসি অফিসে অনুষ্ঠিত ‘পানি-অধিকার : দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের বাস্তবতায় আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সংলাপে আলোচকরা সমন্বিত উদ্যোগ, জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানো ও জলাধার রক্ষার সুপারিশ করেছেন। পানি ও স্যানিটেশন অধিকার-চাই সার্বজনীন বাস্তবায়ন-এর আওতায় এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেল্থ ও পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে সংলাপটি আয়োজন করে। সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আব্দুস সামাদ। এদিকে সিডর ও আইলাপরবর্তী দীর্ঘ সময়েও উপকূলীয় জনপদে নিরাপদ পানি সরবরাহের স্থায়ী কোন ব্যবস্থা ও সমাধান হয়নি। লবণাক্ততার এই কারণে এই অঞ্চলে বেশিরভাগ স্থানে গভীর নলকূপ প্রকল্পে সফলতা মেলেনি। মিষ্টি পানি ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত হাজার হাজার সরকারী পুকুরগুলো এখন ব্যক্তি দখলে ইজারা নিয়ে মাছ চাষ হচ্ছে। বিভিন্ন জেলা পরিষদ থেকে এগুলো লিজ দেয়া হয়। এ সকল অনেক পুকুরের সঙ্গে পিএসএফ পদ্ধতি চালু থাকলেও মাছ চাষের কারণে উপকূলীয় এলাকার সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী পুকুরের মিষ্টি পানির সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাপক হারে চিংড়ি চাষের ঘেরের কারণে লবণ পানি এখন চুইয়ে মিষ্টি পানির পুকুরে ঢুকে পড়ছে। ফলে মিষ্টি পানির আধারগুলোও নষ্ট হচ্ছে। খুলনা বিভাগের দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও কয়রা উপজেলা, বাগেরহাটের রামপাল, মংলাসহ সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদে চলছে বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য হাহাকার। অনেক স্থানে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে যেয়ে এক কলস পানি ৪০ পয়সা বা ৫০ পয়সা দিয়েও কিনতে হচ্ছে। অনেক স্থানে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে পুকুর খনন করা হলেও স্থানীয়রা এগুলো সংরক্ষণ ও ব্যবহার করতে পারছে না। উপকূলবাসীর নিরাপদ পানি সঙ্কটের এই সমস্যা সমাধানের জন্য সংলাপে বক্তারা পানির অধিকার ও পানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ ও জন সম্পৃক্ততা বাড়ানোর উপর জোর দিয়েছেন। উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সকল পুকুরের ইজারা বাতিল করে সকলের জন্য উন্মুক্ত করা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলের বিদ্যমান সুপেয় পানির উৎসগুলো রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারের পানি নীতিতে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার বিয়য়কে অন্তর্ভূুক্তকরণ, স্বাভাবিক প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য পানির উৎসগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা, বৃৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পানকরা ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করা, এই অঞ্চলের জলাধারগুলোকে রক্ষা করা, পানির ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানো, খালগুলোকে উন্মুক্ত করার সুপারিশ করা হয় সংলাপ বৈঠক থেকে। খুলনার জেলা প্রশাসক, মোঃ মোস্তফা কামালের সভাপতিত্বে সোমবার অনুষ্ঠিত এ সংলাপে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত ও পরিবেশ অধিদফতর খুলনার পরিচালক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার পানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত ও সহযোগী অধ্যাপক মোঃ আতিকুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী পীযূষ কৃষ্ণ কু-ু। সংলাপে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, সংবাদকর্মী, সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
×