ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ এক হাতে যাঁর বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ২৭ মে ২০১৫

সিডনির মেলব্যাগ ॥ এক হাতে যাঁর বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য

দেশে সাড়ম্বরে নজরুল জন্মবার্ষিকী উদযাপন হয়ে গেল। আমাদের জাতি ও রাষ্ট্রে অসামান্য প্রভাব এই কবির। তাঁকে যাঁরা পাঠ করেন বা জানেন তাঁদের কাছে তিনি একাধিক কারণে প্রণম্য। বিদ্রোহী কবির তকমা লাগিয়ে তাঁকে আগুনমুখী করার চেষ্টা চলছে অনেককাল ধরে। প্রশ্ন করে দেখুন কেন তিনি বিদ্রোহী বা কেন তাঁকে আমরা প্রথাবিরোধী ভাবছি? অনেকেই কোন জবাব দিতে পারবেন না। যেটা চালু বা প্রচার পেয়ে যায় সেটাই হুজুগে সর্বজনীন হয়ে দাঁড়ায়। অথচ নজরুলের বিদ্রোহী ভাবের চেয়ে প্রেমিক বা আবেগঘন বাঙালী ইমেজ কম কিছু নয়। জীবন ও সমাজের যাবতীয় বিশৃঙ্খলা আর অনাচারকে চাবুক মেরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কত কবিতা আর গানে যে সে চাবুক মারা শেকল ভাঙ্গার কথা আছে। যে কোন অনুষ্ঠানে আমাদের প্রিয় নাচ শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল। যে যখন গদিতে তখন তার শিকল ভাঙ্গার জন্য এর ব্যবহার। অথচ নতুন নতুন শেকলেই বাঁধা পড়ি আমরা। নজরুলের জন্য মায়াকান্নার মানুষরাই এখন সমাজপতি। সিলেটে তারা মুক্তবুদ্ধির মানুষকে চাবকাতে চায়। আবার সে পুণ্যভূমিতেই রক্তে ভাসা অনুজ জানায়, স্বপ্নের কোন মৃত্যু নেই। এ কেমন দেশ? এ কেমনতর সমাজ? কাজী নজরুল এবং তাঁর প্রতি যে আগ্রহ এবং উন্মাদনা এর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা থেকেই বোঝা যাবে কেন এসব ঘটে। আগেই বলেছি কোন কোন কবি কাব্য বা শিল্পের বাইরেও সমান দীপ্র। এঁদের প্রভাব এত বেশি সমাজে রাজনীতিবিদ বা অন্য পেশার মানুষরাও এদের কাছে হার মানেন। নজরুল বিদ্রোহের নামে আমাদের যে অপধারা অধর্ম অপশাসন বা ব্যবস্থাকে আঘাত করতেন সেটা অনুপ্রেরণার। চাইলেই সবাই তা পারেন না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও আমরা দেখেছি বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো বলে রোদন করেছেন। এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময় দূর করে দাও তুমি সর্বতুচ্ছ ভয় বলে প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু নজরুল ছিলেন বলিষ্ঠ। তাঁর আকুতি প্রেমে ছিল, সমাজের জন্য ছিল না। তিনি এই সমাজকে ভেঙ্গে নতুন এক অসাম্প্রদায়িক বাঙালী জাতির জন্য লড়াই করতেন। আশ্চর্যজনকভাবে সে তিনিই হলেন মৌলবাদী ও জাতীয়তাবাদীদের কথিত হাতিয়ার। যাদের জীবনে সব আদর্শ আর জীবনবোধ মূলত নজরুলবিরোধী তাদের কাছে তিনি কখনই নিরাপদ নন। নন বলেই আমরা তাঁকে ঘিরে প্রথম যে রাজনৈতিক মাতম দেখি তার উদগাতা স্বয়ং জিয়াউর রহমান। আজকের তরুণ-তরুণীরা জানে না জিয়ার আমলে একটি পোস্টারে দেশ ছেয়ে গিয়েছিল। জাতীয়তাবাদীরা এই পোস্টার দিয়ে দেশ ভরিয়ে প্রচার করতে চেয়েছিলেন জিয়াই হচ্ছে তখনকার নজরুল। এই ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়ায় পোস্টারটির ভাষায়। ছবিতে স্যান্ডো গেঞ্জি কাউবয় হ্যাট আর সালমান খান জাতীয় চশমা পরিহিত জিয়াউর রহমানের বুকে ছোট আকারের নজরুল। তাতে লেখা ‘আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি হেথা মহাবিপ্লব হেতু।’ সে বিপ্লব আর বৈপ্লবিক কাজগুলো যে কি তা এখন আর বলে বোঝাতে হয় না। যে পাকিস্তানী ভাবধারায় নজরুল কাফের তাঁর কবিতার চরণ সজীব করিব মহাশ্মশান হয়ে যায় গোরস্তান সে ভাবধারার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান হতে চাইলেন নজরুলের উত্তরাধিকারী। যেসব বুদ্ধিজীবী টক শো আর মিডিয়ায় জাতীয়তাবাদের লেজুড় বা তাদের জন্য মায়াকান্নায় ব্যস্ত তাদের উন্মুক্ত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলি প্রমাণ করে দেখানো যাবে সে সময় থেকে ছাত্রদল আর নজরুল শক্তির অবমাননার শুরু। বাংলাদেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতা আর সন্ত্রাসের কারণ হতে পারে নজরুল ইসলামই সন্দেহ জানিয়ে সাবধান করে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর লেখা বা জীবন আদর্শের একেবারে বিপরীত মেরুতে দাঁড়ানো বাংলাদেশী জেনারেলরা কোন এক কারণে সৈনিক নজরুলকে তাঁদের আপনজন মনে করে অনর্থ বাধাতে ছাড়েননি। এটাও আমাদের জাতীয় চরিত্রের এক ভয়াবহ দিক। সম্পূর্ণ কিছু জানা বা আত্মস্থ করার পরিবর্তে খাবলে খাবলে যা দরকার তা তুলে নেয়া। কথায় বলে অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়াবহ। জেনারেলরা ভাবলেন সৈনিক নজরুল মানেই তাঁদের পূর্বসূরি। এভাবে নিজেকে নজরুল সমগোত্রীয় করার হাস্যকর চেষ্টা এরশাদ আমলেও ছিল প্রবহমান। কামানের আগায় বসে বাঁশের বাঁশরী বাজানো ঘনশ্যাম ঝাঁকড়া চুলের কাজী কবিকে তাঁরা এভাবেই ভুল ব্যাখ্যায় নিয়ে আমাদের সর্বনাশে মেতে উঠেছিলেন। একবারও ভাবেননি নজরুল জেনারেল হতে চাননি। তিনি জেনারেল পাবলিকের জন্যে আগ্রাসী যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সৈনিকের মহান পেশাটি কিছুদিনের জন্য আপন করে নিয়েছিলেন। সেই মহান কবিকে এরা রাজনীতির ঘোলাজলে নামিয়ে এই দেশ ও কাব্যকলার পাশাপাশি রাজনীতির লোকসানের নিকট ভারি করে বিদায় নিলেও তার জের থামেনি। কোন দেশ বা জাতি যদি শান্তিতে না থাকে, তার জীবনে যদি শুধু মারামারি আর কলহ বয়ে যায় কি করে মাথা তুলে বাঁচবে? এভাবেই যদি সময় পার হয় নজরুল কোনদিনও তাঁর আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারবেন না। পারবেন না প্রেরণা বা ভরসা হতেও। একদিকে দম্ভ অহঙ্কার আর আমাদের বলে তাঁকে আগলে রাখা সীমাবদ্ধ করে তোলা, অন্যদিকে যথেচ্ছ আদর্শহীন কপট ব্যবহার। নজরুলের মতো আপোসহীন সংগ্রামী আর বালক-কিশোর প্রেমিক বাউ-ুলে নমস্যকে আমরা যেন রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পারি। তিনি এতেও আছেন বটে, তবে সে জায়গাটা একেবারে অধরা বা শয়তানদের নাগালের বাইরে কিছূু। বাস্তবে দেশ ও জাতির জীবনে এখন নজরুলের চিন্তা-চেতনা আর অসাম্প্রদায়িকতার বিকল্প নেই। তাঁর ভেতর যে মিলনকামনা, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যে জিহাদ আর আকুতি তার মর্মবাণী সরিয়ে তাঁকে দল বা সময়োপযোগী করার নিন্দনীয় দিকটি রুখতে হবে। মনে রাখা দরকার, তাঁর যে লেখা ও আদর্শ এ যুগের চাপাতি তাকেও ছেড়ে কথা বলত না। চাপাতি ও চাবুক উভয় অর্থে আমাদের সহায় আর ভরসা নজরুলকে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি। এ দেশ ও জাতির জন্য তাঁর আশীর্বাদ বড় প্রয়োজন। [email protected]
×