ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাতক্ষীরায় নোনা পানির জনপদে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ বেষ্টনি

আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত ॥ ৫শ’ পরিবার এখনও বাঁধে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৫ মে ২০১৫

আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত ॥ ৫শ’ পরিবার এখনও বাঁধে

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা ॥ ৬ বছর আগে আইলার তা-বে ওদের সব হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি নদী ভাঙ্গনে ওদের মাথা গোঁজার শেষ স্থানটুকুও হারিয়ে গেছে কপোতাক্ষে। সাতক্ষীরার আশাশুনির দুর্গম প্রতাপনগর ইউনিয়নের সুভদ্রকাটি, চাকলা আর রুইয়ার বিল এলাকায় গত ৬ বছর ধরে বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছে আইলায় ক্ষতিগস্ত প্রায় পাঁচশ’ পরিবার। দীর্ঘদিনেও ওদের পুনর্বাসনের জন্য কোন ব্যবস্থা হয়নি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন রবিবার জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারী আশ্রায়ণ প্রকল্পে ওদের পুনর্বাসনের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করা হলেও এই ফাইল সহকারী কমিশনার (ভূমি ) অফিসে আটকে আছে। সুভদ্রকাটি এলাকায় ১৩ একর সরকারী খাস জমি থাকলেও এই জমি প্রভাবশালী ব্যক্তিরা লিজ নিয়ে মাছ চাষ করায় এই গৃহহীনদের পুনর্বাসন করা যাচ্ছে না বলে তিনি অভিযোগ করেন। ২৫ মে আইলা তা-বের ছয় বছর পূর্তি হচ্ছে । উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ মজবুত করাসহ সবুজ বেষ্টনি প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি উঠেছে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার পক্ষ থেকে। পাশাপাশি জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড, রেজিলিয়ান্স ফান্ড ও পিপিসিআর ফান্ডসহ জাতীয় বাজেটে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক বরাদ্দের দাবি এলাকাবাসীর। এদিকে আইলা তা-বের পর থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁধকেটে লোনাপানি ঢুকানোর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার দাবি করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। গত ছয় বছর ধরে সাতক্ষীরার বিধ্বস্ত উপকূলীয় জনপদ গাবুরা, পদ্মপুকুর, ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরসহ বিস্তীর্ণ জনপদে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম চললেও এই উন্নয়ন কার্যক্রম চোখে পড়ে না। এই বিবর্ণ উন্নয়নচিত্র শুধু গাবুরাতে নয়। একই অবস্থা আইলা বিধ্বস্ত খুলনার কয়রা, দাকোপ, ও সাতক্ষীরার পদ্মপুকুরে । এদিকে আইলা তা-বে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর এলাকায় চলছে তীব্র খাবার পানির সঙ্কট। আইলা উপদ্রুত মানুষ খাবার পানির সঙ্কটে নাকাল হয়ে আছে। পানির জন্য হাহাকার উঠেছে গাবুরা ও পদ্মপুকুরে। নোনা মাটি আর নোনা পানির এ জনপদে হারিয়ে গেছে সবুজ বেষ্টনি। আইলার ছয় বছর পরও এ এলাকার পরিবেশগত কোন উন্নতি হয়নি। উপকূলীয় জনপদের বেড়িবাঁধগুলো জরাজীর্ণ। তিন বছর আগে বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে আইলা বিধ্বস্ত গাবুরায় খাবার পানির জন্য যে কয়টি পুকুর সংস্কার করা হয়েছিল এসব পুকুরে এখন মাছ চাষ হয়। হাঁস চলে নির্বিঘেœ। মানুষ গোসল করছে ইচ্ছামতো। অথচ এ পুকুরের সঙ্গে পাইপ বসিয়ে খাবার পানির জন্য তৈরি করা পিএসএফ থেকে পানি খেতে বাধ্য হচ্ছে এলাকাবাসী। আবার বেশিরভাগ পুকুর এখন ব্যক্তি দখলে নিয়ে মাছ চাষ হচ্ছে। সুন্দরবনাঞ্চলীয় সাতক্ষীরার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম আর আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের ১০টি গ্রামে আইলা তা-বের ক্ষত চলছে ৬ বছর ধরে। ক্ষতিগ্রস্ত সোয়া লাখ পরিবারের অর্ধেক মানুষ এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেনি। এসব পরিবারে চলছে অর্থনৈতিক বিপর্যয়। মাইগ্রেশনে চলে যাওয়া বেশিরভাগ পরিবার এখনও এলাকায় ফিরে আসতে পারেনি। সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার সূত্রানুযায়ী আইলা এলাকার ত্রাণ ও পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সরাসরি এবং দেশীয় বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে কমপক্ষে ১৮ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার অঙ্কের অর্থ ইতোমধ্যে ব্যয় করে ফেলেছে। দু-একটি সংস্থা বাদে বিপুল এ অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে অনেক। বিশেষ করে কাজের বিনিময়ে নগদ অর্থ, অন্যান্য সহায়তা, পানি ও স্যানিটেশন এবং গৃহনির্মাণ সহায়তায় দেয়া অর্থ ও সামগ্রী বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ এলাকার জনপ্রতিনিধিদের। তবে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, আইলা বিধ্বস্ত উপকূলীয় জনপদের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এখনও কাটেনি। আইলা বিধ্বস্ত উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ নিয়ে এলাকার মানুষের সেøাগান ছিল পরিকল্পিত বাঁধ চাই, জীবন জীবিকা ও সম্পদের নিরাপত্তা চাই। আইলার আঘাতে বিপর্যস্ত শ্যামনগরের গাবুরা পদ্মপুকুর ও আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের বাঁধ নির্মাণ নিয়ে এ আন্দোলন হলেও এই বাঁধ এখন ঝুঁকিমুক্ত নয়। সম্প্রতি আশাশুনির চাকলা বেড়িবাঁধ কয়েক দফা ভেঙ্গে গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জরাজীর্ণ বাঁধ সংস্কারে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অবস্থা বিবেচনা করে সর্বনিম্ম ২০ ফুট উঁচু, ১২০ ফুট তলা এবং ৩০ ফুট মাথা রেখে বাঁধ নির্মাণের দাবি উঠেছিল। কিন্তু এ দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। আইলার মতো আরও একটি দুর্যোগ আঘাত করলে গাবুরা, পদ্মপুকুর ও প্রতাপনগরের মানুষ ফের ভেসে যাবে এমন আশঙ্কা এলাকাবাসীর। এদিকে আইলা তা-বের ৬ বছর পরও উপকূলীয় এলাকায় নির্মিত হয়নি পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেন্টার। সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরের সুন্দরবন সংলগ্ন আটুলিয়া ইউনিয়নের বড় কুপট জনপদে একটি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণের দাবি এলাকবাসী করলেও সে দাবি পূরণ হয়নি। এই জনপদের প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোন সাইক্লোনে স্টোর বা আশ্রয়কেন্দ্র নেই। আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের একমাত্র সাইক্লোন সেন্টারটি এখন নদী ভাঙ্গনের ঝুঁকির মধ্যে। ঝড় জলোচ্ছ্বাসে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে হয় এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে। এখানে খাবার পানির জন্য নেই কোন গভীর নলকূপ। রিজার্ভ পুকুরগুলোও নষ্ট হয়ে আছে। লবণাক্ততায় ভাল ধান হয় না। জনপদ সংলগ্ন বেড়িবাঁধগুলো জরাজীর্ণ হয়ে আছে। আইলা পরবর্তী গত ৬ বছরে বাঁধগুলোতে যে সংস্কার কাজ হয়েছে এলাকাবাসীর মতে এই কাজ লোক দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়।
×