ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মারকুটে স্বভাব, বেশি হুঁশিয়ার- শীতে নীরব, গ্রীষ্মে সক্রিয়

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৫ মে ২০১৫

মারকুটে স্বভাব, বেশি হুঁশিয়ার- শীতে নীরব, গ্রীষ্মে সক্রিয়

এসএম ইকবাল ॥ বগুড়ার সারিয়াকান্দী উপজেলায় যমুনার গ্রাসে বিলীন নান্দিয়ারপাড়ার মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর চরে বিপুল পরিমাণে অতিথি পাখি আসে। এসব চরে বিভিন্ন প্রজাতির জলজ পাখি পরিযায়ী হয়ে আসে এবং যায়। সেই সঙ্গে একদল নামীদামী সৌখিন শিকারি নৌকা ভাড়া নিয়ে এসব পাখি শিকারের পাশবিক আনন্দে মেতে ওঠে। তখন চলতি বছরের জানুয়ারি গড়িয়ে ফেব্রুয়ারি মাস চলছিল। দু’একটা হাঁসের আগমনের বার্তা ছাড়া তেমন কোন সংবাদ নেই। ততদিনে যমুনার পানির স্তর এতটাই নেমে গেছে যে, নান্দিয়ারপাড়া এবং ডাকাতমারা চরের দক্ষিণে এক বিশাল কোলা বা বদ্ধ জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে অনেক শীতের পাখি এসেছে। পাখিগুলো এতটাই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছিল যে, তাতে পাখিদের আসা-যাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করা ছাড়া ৩০০ এমএম লেন্স দিয়ে স্পষ্ট ছবি তোলা একেবারেই অসম্ভব। একঝাঁক হাঁস দূর থেকে এসে পানিতে বসছে আবার আরেকঝাঁক পানি থেকে উড়ছে। সে এক মনোরম দৃশ্য। ৭/৮ শ’ হাঁসের ঝাঁকের বুকচিরে চলে যাচ্ছে খেয়া নৌকা। যাত্রীরাও মহা আনন্দে উপভোগ করছে অতিথি পাখিদের কোলাহল। ভাবতে কষ্ট হয়, এই মহা মিলনমেলা কিভাবে মানুষ বন্দুকের গুলিতে স্তব্ধ করে দিতে পারে! শুধু পাখি দেখলে তো হবে না। প্রতিটি হাঁস প্রজাতিসহ নিখুঁতভাবে চিনতে হবে এই লেখককে। চেক লিস্ট তৈরি করতে হবে। তারপর তা জানাতে হবে দেশের মানুষকে। সেজন্য ছবি যত নিখুঁত তোলা যাবে পাখির প্রজাতি শনাক্ত করতে তত সহজ হবে। আবছা কুয়াশায় দূরে দুটো ঝোঁপের মতো বস্তুতে লেখকের চোখ আটকে গেল। দু’শ’ গজ দূরের ঝোঁপ দুটো, তাও আবার সাদা বকের সারিতে, পানির কিনারে। কী হতে পারে, ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যেতেই মাঝি বললÑ ওদিকে পানি কম, নৌকায় এক পা তুলতেই ঝোঁপ দুটো নড়ে উঠল। এবার বোঝা গেল, দুটো পাখি পাশাপাশি স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ঠোঁট পালকের মধ্যে গুজে আছে বলে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না কোন্ জাতের পাখি। আস্তে আস্তে সেদিকে যেতেই এত বড় পাখি দেখে প্রথমে ধারণা হলো শকুন জাতীয় কোন পাখি হবে হয়ত। ৫০ গজ এগুতেই পাখি দুটো ফের নড়াচড়া করে উঠল। দেখি, এটা এক অচেনা পাখি। বুঝতে অসুবিধা হলো না। আস্তে আস্তে ক্রলিং করে আরও ৫০ গজ এগুতেই টের পেয়ে ততক্ষণে ওরা সতর্ক। ছুরির ফলার মতো লম্বা ঠোঁট বের করল পালকের ভেতর থেকে। নিশ্চিত হওয়া গেল, এটা শকুন নয়। হাত দুটো যেন থর থর করে কাঁপছে । কাঁপা হাতেই ক্যামেরা তাক করা হলো পাখি দুটোর দিকে। এদিকে, পাখি দুটো পা মেলতে শুরু করেছে। পরক্ষণেই ওরা উর্ধ আকাশে উড়াল দিল। ঠিক শকুনের মতো অনেক বড় চক্রাকারে উড়তে উড়তে বহু উঁচুতে উঠে গেল। ক্রমে দৃষ্টির আড়ালে উর্ধ আকাশে মিলিয়ে গেল তারা। যে পাখির জন্য এত কষ্ট, সেই পাখিটি আসলে কালামানিকজোড়। অজয় হোম তাঁর ‘চেনা-অচেনা পাখি’ বইয়ে লিখেছেনÑজোড়ায় জোড়ায় সব সময় থাকে বলে মানিকজোড় নামটা আসেনি। নামটি এসেছে, এ পাখি মানিকপীরের নিত্যসঙ্গী ছিল বলে। এদের ইংরেজী নাম ইষধপশ ঝঃড়ৎশ এবং বৈজ্ঞানিক নাম ঈরপড়হবধ হরমৎধ. কালামানিকজোড় দৈর্ঘ্যে ৯৮ সেমি, উচ্চতা তিন ফুটেরও বেশি। ওজন প্রায় ৩-৩.৫ কেজি। এদের দেহের উপরিভাগের পালক কালো, তাতে বেগুনি আভা। বুকের পালক কালো। পেট থেকে পুচ্ছ পর্যন্ত সাদা পালকে আবৃত। উড়স্ত অবস্থায় থেকে সাদা পালকের বিন্যাস অনেকটা জেট প্লেনের মতো দেখায়। ঠোঁট এবং পা লম্বা, রঙ লাল। দেহের পালকগুলো লম্বা অনেকটা ঝোলানো। কালাজাঙ সাধারণত একাই বা জোড়ায় কখনও ছোট ছোট দলে থাকে। নিচু জমিতে, জলমগ্ন মাঠ, নদীর তীর, হ্রদ বা জলাভূমিতে বিচরণ করে। খাদ্য তালিকায় রয়েছে ব্যাঙ, সরিসৃপ, কাঁকড়া, শামুক, বড় পতঙ্গ, আটকেপড়া মাছ, বড় উড়ন্ত পিঁপড়ে। শীতে এরা নীরব থাকে। গ্রীষ্মের শুরুতে এরা খাদ্যের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। এপ্রিল-মে মাসে এরা প্রজনন করে। আমাদের দেশে এদের প্রজনন হয় না। সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া ও চীনের উত্তরাঞ্চলে উঁচু গাছে ডালপালা দিয়ে বানানো বড় মাচায় এরা ডিম পাড়ে। শরীফ খান তাঁর ‘বাংলাদেশের পাখি’ (২০০৮) বাইটিতে কালাজাঙ শিকারের একটা তথ্য দিয়েছেন বছরওয়ারি। তাঁর মা-ও ১৯৬৩ সালে একটি কালাজাঙ বন্দুকের গুলিতে শিকার করেছিলেন বাড়ির আঙিনার একটি গাছ থেকে । দূরে কোথাও ওটা বন্দুকের গুলি খেয়েছিল। শরীফ খান জানিয়েছেন, স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত কালাজাঙ প্রতিবছরই দু-একটা করে মারা পড়ত বৃহত্তর খুলনা জেলা এলাকায়। প্রতিবছরই দেখা মিলত ওদের । সর্বশেষ ২০০৯ সালে বাগেরহাট সদরের বাদোখালি বিলে একটি কালাজাঙ মারা পড়েছিল। তিনি আরও বলেন যে, কালাজাঙ অত্যন্ত চতুর ও হুুঁশিয়ার পাখি। বন্দুকের বা ক্যামেরার রেঞ্জে কাউকে পৌঁছাতে দেয় না সহজে। মারকুটে স্বভাবের। এর চেয়েও বেশি হুঁশিয়ার পাখি হলো এদেরই এক জাতভাই সাদা মানিকজোড় (ঙৎরবহঃধষ ংঃড়ৎশ). বহুকাল ধরে পাখিটি বাগেরহাট- খুলনা জোড়া উত্তরের হাওরে আসত। ১৯৯৬ সালে প্রায় ৩০০ গজ ক্রলিং করে একজন আলোকচিত্রী ফকিরহাটের বিল কোদালিয়া থেকে একটি পাখির লংশট নিতে পেরেছিলেন। তখন প্রাণিবিদ্যার ছাত্র ও এখন সুখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী মনিরুল খান পাখিটিকে শনাক্ত করেছিলেন ঙৎরবহঃধষ ংঃড়ৎশ বলে। শরীফ খানের বইটিতে এই সাদা মানিকজোড় শিকারের তথ্যও আছে। বৃহত্তর একটি হাওরে নব্বইয়ের দশকে একটি কালাজাঙ বন্দুক শিকারির গুলিতে মারা পড়েছিল। তিন বছর আগে সিলেটেরই একটি হাওরে একটি ধূসর সারস (ডেমোসিল ক্রেন) এক শিকারির বন্দুকের গুলিতে মারা পড়েছিল। স্থানীয় বন বিভাগ শিকারি ও মৃত পাখি পাকড়াও করেছিল। শরীফ খানের বই থেকে জানা যাচ্ছে যে, তারপর থেকে একজোড়া সাদা মানিকজোড় প্রতিমৌসুমেই উত্তরের হাওরে আসত, তিনি প্রতিবারেই মনিরুল খানকে খবর জানাতেন। ইতোপূর্বে দেখা গিয়েছিল ২০০৮ সালে। আর, সর্বশেষ ২০১৫ সালের এপ্রিলে শরীফ খান বিরল উপজেলার একটি বিলে একটি কালাজাঙ দেখেছেন। ড. রেজা খানের বই থেকে জানা গেছে যে, এরা অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি। মনিরুল খানের বইতে আছে, বড় বড় নদীতীরে দেখা যায় এদের । যেমন পদ্মা, যমুনা। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী খ--২৬ বইটিতে জানা যায়, আগে নিয়মিত শীতে বেড়াতে আসত কালাজাঙ। এখন তেমন আর আসে না। উত্তরবঙ্গের সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর ও কুড়িগ্রাম এলাকায় কালো মানিকজোড় অনিয়মিত পরিযায়ী হয়ে ৫/৬ বছর পর পর আসে। ভবিষ্যতে হয়ত প্রাক্তন পরিযায়ীর তালিকায় চলে যাবে। উল্লেখ্য, অতি বিরল সাদাগলী মানিকজোড়ের (ড়িড়ষষু-হবপশবফ ংঃড়ৎশ) ছবিও তোলা হয় এ বছরেরই গত ৪ মে। প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ পাখি শিকারিদের প্রতিহত করার পাশাপাশি উঁচুগাছ রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরী। উঁচুগাছে প্রজননকারী এবং আশ্রয় গ্রহণকারী পাখিদের জন্য আজ অশনি সঙ্কেত বেজে উঠেছে। এখন আর তেমন চোখে পড়ে না বয়স্ক শিমুল, পাকুড়, বট এবং তেঁতুলগাছ। ফলে এসব পাখি নিরাপদ আশ্রয় এবং প্রজনন আবাসস্থলের অভাবে আরও দ্রুত বিলুপ্তির পথ ধরেছে। আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা যায় মোল্লা রেজাউল করিমকে (উঋঙ বান্দরবান বন বিভাগ) তাঁর ‘শতবর্ষী বৃক্ষ বাঁচাও’ কর্মসূচী গ্রহণের জন্য।
×