ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অন্তত দশটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে

মোদির ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি ও সন্ত্রাস দমন প্রাধান্য পাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২২ মে ২০১৫

মোদির ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি ও সন্ত্রাস দমন প্রাধান্য পাচ্ছে

তৌহিদুর রহমান ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফরে ঢাকা-দিল্লীর মধ্যে অন্তত দশটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে। দুই দেশের মধ্যে ঋণ সুবিধা, বাণিজ্য, পরিবহন, নৌ-চলাচল, বিদ্যুত, সড়ক যোগাযোগ, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে এসব চুক্তি সইয়ের লক্ষ্যে চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বেশ কয়েকটি চুক্তির নবায়ন করা হবে। ঢাকা সফরকালে আলোচনায় গুরুত্ব পাবে তিস্তা চুক্তি ও সন্ত্রাস দমন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, আগামী ৬ ও ৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৩৬ ঘণ্টার সফরে ঢাকায় আসছেন। সফরকালে দুই দেশের মধ্যে যেসব চুক্তির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলার মধ্যে সরাসরি বাস সার্ভিস চালু, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি ও নবায়ন, নৌ-ট্রানজিট প্রটোকলের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং নবায়ন, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি, বিদ্যুত সহযোগিতা চুক্তি, নতুন ঋণ চুক্তি ইত্যাদি। এছাড়া শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে আরও বেশ কয়েকটি চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে। তিস্তা চুক্তি ও সন্ত্রাস দমন ॥ এ বিষয়টিই নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে সন্ত্রাস দমন ও তিস্তা চুক্তি আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। এ সফরে তিস্তা চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে এ সফরে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের প্রধান দুই অমীমাংসিত ইস্যুর একটি সীমান্ত চুক্তির ইতোমধ্যেই সুরাহা হয়েছে। এখন রয়েছে তিস্তা চুক্তি। মোদির সফরের মধ্যে দিয়েই তিস্তা চুক্তির জট খুলতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন কূটনীতিকরা। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে অন্যতম ইস্যু রয়েছে সন্ত্রাস ও জঙ্গী দমন। দুই দেশের মধ্যে আলোচনার অন্যতম এজেন্ডায় রয়েছে এ ইস্যুটি। বাণিজ্য চুক্তি ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় এই চুক্তি নবায়ন করা হবে। চুক্তি অনুযায়ী উভয় দেশই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থার আলোকে উন্নয়নশীল ও পারস্পরিক সুবিধার জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উন্নয়নে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহজীকরণের জন্য উভয় সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে একমত পোষণ করবে। উভয় দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধিতে নির্দিষ্ট পণ্যসামগ্রী, বাণিজ্য বৃদ্ধি ও বহুমুখী করতে দু’দেশের অসামঞ্জস্য বিবেচনা রেখে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ। বাণিজ্য সংক্রান্ত সব লেনদেন ও মাশুল সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রায় কার্যকর ও স্ব স্ব বিনিময় প্রবিধি অনুযায়ী সম্পন্ন হবে। বাংলাদেশ ও ভারত বাণিজ্য চুক্তির মধ্যে তেরোটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এতে সীমান্ত বাণিজ্য সহজীকরণে আলাদা চুক্তির মাধ্যমে মঞ্জুর হওয়ার কথাও উল্লেখ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশ ও ভারত বাণিজ্য চুক্তি সই হয়। এই চুক্তি ২০০৯ সালে পুনরায় সই হয়েছে। চুক্তিটি কোন ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই ২০১২ সালে নবায়ন করা হয়। এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৩১ মার্চ। এবার দুই দেশের মধ্যে আগামী পাঁচ বছরের জন্য নতুন করে বাণিজ্য চুক্তি সই হবে। নৌ-ট্রানজিট প্রটোকল ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নৌ-যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে নৌ প্রটোকল চুক্তি রয়েছে। তবে এ চুক্তির মেয়াদ এবার বাড়ানো হয়েছে। আগে এ চুক্তির মেয়াদ ছিল তিন বছর। এখন এ চুক্তির মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ‘প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট এ্যান্ড ট্রেড’ শিরোনামে এই নৌ-প্রটোকল রয়েছে। ১৯৭২ সালে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে নৌ-প্রটোকল সই হয়। এর পর বিভিন্ন সময়ে এ চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবে এবারের চুক্তিতে নতুন সংশোধনী আনা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভারত বা বাংলাদেশের নৌ-পথ ব্যবহার করে তৃতীয় কোন দেশে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। প্রটোকলটি আগে দ্বিপাক্ষিক ছিল। এখন তৃতীয় পক্ষ সংযুক্ত করা হয়েছে। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নেপাল ও ভুটানকে টার্গেট রাখা হয়েছে, যেন দুই পক্ষেরই (বাংলাদেশ-ভারত) সুবিধা হয়। দুই পক্ষ আলাপ-আলোচনা করে সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান করবে। উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূল দিয়ে জাহাজ চলাচল নিয়ে একটি চুক্তির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এ চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে উপকূল দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করতে পারবে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে এ চুক্তির নাম ‘কোস্টাল শিপিং এগ্রিমেন্ট’। এ ব্যবস্থার ফলে দুই দেশের মধ্যে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করবে। এতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ দুই দেশের সড়কপথের ওপর চাপ অনেকটা কমবে। সাশ্রয়ী মূল্যে ও স্বল্প সময়ে দুই দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে। তাছাড়া দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে এটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। দুই দেশের মধ্যে ইতোমধ্যেই প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছে। তবে মোদির সফরকালে এ চুক্তির চূড়ান্ত সই হবে। বর্তমানে ভারত থেকে সমুদ্রপথে পণ্য আনতে হলে মুম্বাই বা বিশাখাপত্তম বন্দর থেকে শ্রীলঙ্কা বা সিঙ্গাপুরে যায়। সেখান থেকে বাংলাদেশের জাহাজে করে চট্টগ্রামে আসে। এতে একটি পণ্যবাহী কার্গো চট্টগ্রামে আসতে ২৫Ñ৩০ দিন সময় লাগে। আর এক টন পণ্যের ভাড়া দিতে হয় প্রায় ১১০ ডলার। উপকূলীয় জাহাজ চলাচল শুরু হলে অন্ধ প্রদেশের কাকিনাড়া বা বিশাখাপত্তম থেকে পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর বা মংলা বন্দরে আসতে সময় লাগবে মাত্র তিনদিন। খরচ হবে টন প্রতি ৩০Ñ৩৫ ডলারের মতো। জাহাজ চলাচল চুক্তি হলে খরচ কমবে প্রায় ৩৩ শতাংশ। ১০০ কোটি ডলার ঋণ চুক্তি ॥ অবকাঠামো ও উন্নয়ন খাতে নতুন করে আরও ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এর আগে ২০১০ সালে ভারতীয় ক্রেডিট লাইনের আওতায় বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দেয় ভারত। এরপর চলতি বছর বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে নতুন করে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তার প্রস্তাব করা হয়। মোদির ঢাকা সফরের সময় এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এর আগে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে ১২ জানুয়ারি ৫০ দফা যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। সেখানে ভারতীয় ক্রেডিট লাইনের আওতায় বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত সরকার। এর মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ৮০ কোটি ডলার ঋণ এবং বাকি ২০ কোটি ডলার হচ্ছে পদ্মা সেতু উন্নয়নে অনুদান। সেই অর্থ এখনও বিভিন্ন ধাপে ধাপে দেয়া হচ্ছে। বিদ্যুত নিয়ে সমঝোতা চুক্তি ॥ মোদির ঢাকা সফরের সময় বিদ্যুত ও জ্বালানির বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুত ও জ্বালানি সরবরাহের লক্ষ্যে একটি সমঝোতা চুক্তির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে আরও বিদ্যুত আনার লক্ষ্যে এ চুক্তি হবে। এছাড়া মোদির সফরে ত্রিপুরার পালাটানা থেকে বাংলাদেশে অতিরিক্ত বিদ্যুত সরবরাহ, এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ত্রিপুরার বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত বাংলাদেশকে সরবরাহ ও নেপাল ও ভুটান থেকে ভারতের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুত আনার বিষয়ে আলোচনা হবে। আরও যেসব চুক্তি ॥ বাংলাদেশ থেকে পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা দূর করতে দুই দেশের মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের সমুদ্র সীমার সম্পদ আহরণে সমুদ্র অর্থনীতি খাতে সহযোগিতা করবে ভারত। এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এদিকে আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা বাস সেবা চালুর লক্ষ্যে একটি চুক্তির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ। এই সেতু ভারত নির্মাণ করবে। এই সেতু নির্মাণ নিয়ে একটি চুক্তি হবে। শিক্ষা-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিনিময়ে সমঝোতা স্মারক সই হবে।
×