ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুড়াপাড়ার জমিদার বাড়ি

কালের গহ্বরে ঢাকা পড়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৭ মে ২০১৫

কালের গহ্বরে ঢাকা পড়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি

মীর আব্দুল আলীম ॥ প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি কালের গহ্বরে ঢাকা পড়লেও এর নিদর্শন চিরকাল অম্লান। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার জমিদার বাড়িটি তেমনই এক স্মৃতিচিহ্ন। এ বাড়িটিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে রূপগঞ্জের ইতিহাস, কৃষ্টি, সভ্যতা। আর আজকের এই কোলাহলপূর্ণ জনবসতি। শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে মহাকালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এ জমিদার বাড়ি। ছায়া নিবিড় পরিবেশে গড়ে ওঠা মনোমুগ্ধকর এ জমিদার বাড়ি যে কারও মন কাড়বে। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার মুড়াপাড়া এলাকায় ৫২ বিঘা জমির ওপর এই প্রকা- জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। জমিদার রাম রতন ব্যানার্জি তৎকালীন মুড়াপাড়া জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং জমিদারদের উর্ধতন ষষ্ঠ পুরুষ। তিনিই মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন করেন। রাম রতন ব্যানার্জির ছেলে পীতাম্বর ব্যানার্জি এবং তার ছেলে প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জি শাহজাদপুরের জমিদারি কিনে জমিদারি বিস্তৃত করেন। কথিত আছে, জমিদারি কেনার সূত্র ধরে প্রতাপ ব্যানার্জির সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। ১৮৮৯ সালে প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জির পৈতৃক এজমালি পুরনো বাড়ি ত্যাগ করে এ প্রাসাদের পেছনের অংশ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জির ছেলে বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জি ১৮৯৯ সালে প্রাসাদের সামনের অংশের একতলা ভবন নির্মাণ ও সেখানে দু’টি পুকুর খনন করার পর হৃদরোগে মারা যান। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের প্রথম গ্রাজুয়েট। বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জির দুই সুযোগ্য সন্তান জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জি ও আশুতোষ চন্দ্র ব্যানার্জি ১৯০৯ সালে প্রাসাদটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। এ অঞ্চলে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জির নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। কারণ তিনি দু’বার দিল্লীর কাউন্সিল অব স্টেটের পূর্ববঙ্গ হতে সদস্য নির্বাচিত হন। জমিদার জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জি প্রজা সাধারণের কল্যাণে স্থাপন করেছেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কেটেছেন পুকুর। এই জনহিতকর ইতিহাসের উল্টাপিঠেই রয়েছে অত্যাচার আর নির্যাতনের বহু ঘটনা। রয়েছে অসংখ্য স্মৃতি। বিশাল এ জমিদার বাড়িটিতে রয়েছে মোট ৯৫ কক্ষ। নাচঘর, আস্তাবল, উপাসনালয়, ভা-ার, কাছারিসহ সবই ছিল। বিশালাকৃতির প্রধান ফটক পেরিয়ে ঢুকতে হয় ভেতরে। অন্দর মহলে রয়েছে আরও দু’টি ফটক। সর্বশেষ ফটক পেরিয়ে মেয়েদের স্নানের জন্য ছিল শান বাঁধানো পুকুর। পুকুরের চারধার উঁচু দেয়ালে ঘেরা। এখানে বাইরের মানুষের প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তখন এটি ছিল নীরব এক অন্তপুরী। তবে বর্তমান দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিকেল হতেই অন্দর মহলের পুকুরের চারধার যুবক-যুবতীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বাড়ির সামনে রয়েছে আরও একটি বিশাল পুকুর। পুকুরটির চারদিক নকশি কাটা ঢালাই লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। আর চারদিকে চারটি শান বাঁধানো ঘাট। দিঘী বলেও কেউ মনে করতে পারেন। পুকুরজুড়ে টলমল করছে পানি। এত স্বচ্ছ পানি বোধ করি এ অঞ্চলে আর নেই। এ পুকুরের পানির বৈশিষ্ট্যটাই অন্য রকমের। পানিতে জমিদার বাড়ির প্রতিচ্ছবি যেন ঢেউয়ের তালে দোলে। মূলত এ পুকুরটি তৈরি করা হয়েছে বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যই। পুকুরের পরিমাপটাও অনেকটা প্রতিচ্ছবির হিসাব মিলিয়েই তৈরি করা। পুকুর সংলগ্ন মন্দির, মন্দিরের বড় দু’টি চূড়া রয়েছে। প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। এর প্রবেশদ্বারগুলো খিলান দিয়ে নির্মিত। মন্দিরের মূল কক্ষ বেশ ছোট, অন্ধকার। মন্দিরের বাঁ পাশ ঘেঁষে ছায়াঘেরা শান্ত-শ্যামল বিশাল আম্রকানন। গাছগুলো বেশ পুরনো। একই মাপের ঝাঁকড়া গাছ, ডালপালা ছড়ানো। অনেকটা ছাতার মতো, অসংখ্য গাছ। প্রায় প্রতিটি আমগাছের গোড়া পাকা করা। এখানে আছে সারি সারি পান ও সুপারি বাগান। এ ছাড়া জমিদার বাড়ির প্রবেশমুখেই সারি সারি ঝাউগাছ। প্রতিবছর এখানে আসে পিকনিক পার্টি। এছাড়া সারা বছর ধরেই এখানে থাকে দর্শণার্থীদের ভিড়। বিদেশী পর্যটকরাও আসেন এ বাড়িতে। এ বাড়িকে ঘিরে এ যাবত বহু চলচ্চিত্র, মিউজিক ভিডিও এবং টিভি নাটকের শূটিং হয়েছে। মূলত এ অঞ্চলের বহু স্মৃতি যুগ যুগ ধরে বহন করছে এ জমিদার বাড়িটি। নয়ন জুড়ানো রূপগঞ্জের এ জমিদার বাড়ির ভেতরের অপরূপ কারুকাজ, নিপুণ হাতের শিল্পকর্ম দেখে আজও পর্যটকরা বিস্মিত হন। ঢাকা থেকে রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার জমিদার বাড়িতে আসতে সময় লাগে ৪০-৫০ মিনিট। বাসে কিংবা বেবিট্যাক্সিতে আসতে পারেন এখানে। রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ অথবা গুলিস্তান থেকে মুড়াপাড়ার বাসে চেপে এলে ভাড়া লাগবে ১৫ টাকা। সিএনজিতে লাগে ১২০ টাকার মতো। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রূপগঞ্জের রূপসী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এলে বেবিট্যাক্সি অথবা রিক্সাযোগে পিচঢালা রাস্তায় সহজেই আসা যায় এ জমিদার বাড়িতে।
×