ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তিনি এসেছিলেন তাই ...

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ১৭ মে ২০১৫

তিনি এসেছিলেন তাই ...

মানুষের কিছু কিছু অপেক্ষার দিন থাকে। জাতি হিসেবে বাঙালীরও তেমন কিছু অপেক্ষার দিন ছিল, আছে। স্বপ্ন পূরণের আকাক্সক্ষা যেদিন থেকে মানুষের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই অপেক্ষার পালা মানুষের। যেমন মেঘের আড়াল থেকে সূর্যের আকাক্সক্ষা, যেমন গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বৃষ্টির আকাক্সক্ষা, যেমন শীতের শুষ্কতার পর বসন্তের আকাক্সক্ষা- তেমনি কিছু কিছু দিনের আকাক্সক্ষা, যে দিনগুলো মানুষের মুক্তির সোপানে এক একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথাও উল্লেখ করতে পারি। বেশি দিনের কথা নয়, প্রায় সাড়ে চার দশক। বাঙালী জাতির এই শ্রেষ্ঠ অর্জন কি এতটাই সহজ ছিল? তার জন্য স্বপ্ন দেখতে হয়েছে। মানুষের মনে সঞ্চারিত করতে হয়েছে সেই স্বপ্নের বীজ। তৈরি করতে হয়েছে আকাক্সক্ষা। মানুষ কিন্তু সহজে জীবনকে হাতের মুঠোয় তুলে নেয় না। জীবনের প্রতি মানুষের সহজাত যে মায়া, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন এমন বীজমন্ত্র, যা জীবনকে তুচ্ছ ভাবতে শেখায়। শেখায় জীবন বাজি রাখতে। একাত্তরে বাঙালী জীবন বাজি রেখে বিশ্বকে দেখিয়েছিল, সে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। যুদ্ধের মাঠে নিজেকে ঠেলে দেয়ার আগে যে রাজনৈতিক প্রস্তুতি ও কমিটমেন্ট লাগে, তার জন্য তৈরি হতে হয়েছিল বাঙালী জাতিকে। জিনিসটা একদিনের ব্যাপার যে নয়, তা বুঝতে অসামান্য মেধার প্রয়োজন নেই। স্বাধীনতার জন্য বাঙালীর অনেকদিনের আকাক্সক্ষা ছিল, সেই আকাক্সক্ষা পূরণ হয়েছিল। তার জন্য জীবন দিতে হয়েছে। অনেক মূল্য আমাদের স্বাধীনতার। স্বাধীনতা অর্জনের পরও কিন্তু পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। সেই ষড়যন্ত্রের বলি হতে হয়েছে জাতির জনককে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ১৯৭৫ সালের সেই ভয়াল কালরাত্রির পর বাঙালীর নতুন এক অপেক্ষার পালা শুরু। কী সেই অপেক্ষা? এবার একটু পেছনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর দেশে সামরিকতন্ত্রের জংলি শাসনের শুরু। সে এক কালো অধ্যায়। সেই কালো অধ্যায়ের এক পর্যায়ে কারফিউ গণতন্ত্রও এসেছিল দেশে। কিন্তু তখন তো আর বুক ভরে শ্বাস নেয়ার অবকাশ নেই। নেই মুখ ফুটে সত্য কথাটি বলার মতো পরিবেশ। তখন কেমন ছিল দেশের অবস্থা? এক ছড়াকার লিখেছিলেন, ‘খুনের গুণে পুরস্কৃত সেবার দায়ে ফাঁসি’। বাস্তবতাও তো ছিল সেরকমই। জাতির জনকের খুনীদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল। নেয়া হয়েছিল তাদের নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা। দেশের মাটিতে তাদের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে ভেবেই তৎকালীন জংলি শাসকগোষ্ঠী তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেয় ‘প্রাইজ পোস্টিং’ দিয়ে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে উচ্চপদে বসানো হয় বঙ্গবন্ধুর খুনীদের। এবং এসব সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করার মতো অবস্থা তখন তো দেশে ছিল না। যেখানে কারাগারের মধ্যে পোশাকধারী সেনাসদস্যরা ঢুকে গুলি করে জাতীয় নেতাদের হত্যা করে, সেই দেশে সাধারণ মানুষ কী করে বলে তাদের স্বপ্ন ও আশা-আকাক্সক্ষার কথা। কাজেই অপেক্ষায় থাকতে হয়। একটি সময়ের অপেক্ষা, যে সময় থেকে আবার নতুন স্বপ্নের বীজ বপন হবে হৃদমাঝারে। নতুন স্বপ্নে পথ চলার জন্য এবার বাঙালীকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অর্ধযুগ। সে এক দীর্ঘ সময় বটে! নিজেদের মতো করে গলা খুলে গান গাইবার স্বাধীনতা ফিরে পেতে, নিজেদের আশা-আকাক্সক্ষা ও ঘৃণার কথা মুখ ফুটে বলার মতো পরিবেশ ফিরে পেতে এই সময়টা একটু দীর্ঘ। কারণ স্বাধীনতার সুবাতাস বুক ভরে নেয়ার আগেই অন্য এক পরাধীনতার শুরু হয়ে যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে। এই নতুন পরাধীনতার নাগপাশ ছেঁড়ার স্বপ্ন দেখার শুরুও ওই সময় থেকেই। সেই থেকে শুরু নতুন এক অপেক্ষার। যে অপেক্ষার পালা শেষ হয় ১৯৮১ সালের আজকের দিনে। এ কথা সবারই জানা যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে জনগণের সরকারকে সরিয়ে চেপে বসা শাসকগোষ্ঠীর শাসন শুরু হয় বাংলাদেশে। আজ ১৭ মে সেই চেপে বসা শাসকগোষ্ঠীর গদিতে প্রথম ঝাঁকুনি দেয়ার দিন। এই দিনে এক সর্বস্বহারা নারী ফিরেছিলেন পিতৃভূমিতে, একা। তবে তাঁর সেই ফিরে আসার ভেতর দিয়ে তিনি প্রমাণ করতে পেরেছিলেন, ইচ্ছাশক্তির চেয়ে শক্তিশালী আর কিছু নেই। সেদিনই প্রমাণ হয়ে যায়, মানুষের ভালবাসার চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই। জনগণের ভালবাসার চেয়ে বড় কোন সম্পদ ও অর্জন যে নেই, বাংলার মাটিতে এটা সেদিন নতুন করে আবার প্রমাণ হয়েছিল। কারও কারও ফিরে আসার ভেতর দিয়ে প্রজ্বলিত হয় নতুন আশার প্রদীপ। অন্ধকার কেটে যায়। দূর হয় অমানিশা। হারিয়ে যাওয়া পথ যেন হঠাৎ কোন জাদুর পরশে সামনে এসে পড়ে। দিশাহারা মানুষ খুঁজে পায় এমন পথের সন্ধান, যে পথ তাঁকে নিয়ে যাবে অভীষ্ট লক্ষ্যে। ১৭ মে বাঙালীর জন্য সেই পথ খুঁজে পাওয়ার দিন। কারণ এই দিনে দেশের মাটিতে ফিরে এসেছিলেন তিনি। না, একেবারেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না তাঁর ফিরে আসার পথটি। পথের বাঁকে বাঁকে ছড়ানো ছিল বাধার কাঁটা। সেই কাঁটার ভয় উপেক্ষা করেই তিনি ফিরেছিলেন দেশের মাটিতে, মানুষের ভালবাসায় ভরসা রেখে। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের কিছুদিন আগেই তিনি গিয়েছিলেন প্রবাসে বিজ্ঞানী স্বামীর কাছে। এরপর দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসিত প্রায় অনিশ্চিত জীবন। বাবা-মা-ভাই হারানোর বেদনার ক্ষত বুকের গহীনে। আগামী দিনের অনিশ্চয়তা। প্রবাসেও জীবননাশের শঙ্কা। তারপরও কিন্তু দেশের মাটিতে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধান্বিত হতে হয়নি তাঁকে। জ্যৈষ্ঠের এক বর্ষণসিক্ত দিনে তিনি ফিরে এসেছিলেন বাংলার মানুষের কাছে, মুক্তির অগ্রযাত্রা ও বিপ্লবের নেত্রী হিসেবে। একবুক কান্নায় ভেসে তিনি ফিরেছিলেন স্বজনহারা স্বদেশে। তবে একেবারেই তো স্বজনহীন ছিলেন না তিনি। বাংলার মানুষই তো আপনজন। তাঁর স্বদেশে ফেরা মানেই তো মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসা। আবার নতুন আশার বীজ বোনা। তিনি মানুষের মনে আশার বীজ বুনে দিয়ে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। জাতির অগ্রযাত্রায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। আজ সেই ঐতিহাসিক দিন। আজকের এই দিনেই তিনি ফিরে এসেছিলেন তাঁর অনিবার্য শেকড়ে। ফিরেছিলেন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার ব্রত নিয়ে। সেই ব্রত সাধনায় এখনও তাঁর পথচলা। তিনি এসেছিলেন বলেই সামরিকতন্ত্রের উর্দির ভেতর থেকে মুক্তি পেয়েছিল গণতন্ত্র। তিনি এসেছিলেন বলেই স্বৈরাচার বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিল বাংলার মাটি থেকে। তিনি এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ নতুন এক পরিচয়ে পরিচিত হতে পেরেছে পৃথিবীতে। তিনি এসেছিলেন বলেই আন্তর্জাতিক নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছে বাংলাদেশ। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ আজ বাংলাদেশ। সমুদ্র জয়ের ইতিহাস রচিত হয়েছে তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে। তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন বলেই ৪২ বছরের বাধা পেরিয়ে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হয়েছে স্থলসীমান্ত চুক্তি। তিনি এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ পা রেখেছে প্রগতির পথে। এসেছিলেন, তাই আজ আমরা উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতে পারি। তিনি এসেছিলেন বলেই তো একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হচ্ছে আজ বাংলাদেশে। সম্ভব হচ্ছে রায় কার্যকর। যেমন জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কার্যকর হয়েছে রায়। তিনি এসেছিলেন, তিনি আছেন, তাই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে বাংলাদেশ। তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আজ ১৭ মে তাঁর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের দিনটিকে তাই স্মরণ করি নতুন করে। লেখক : ভিয়েনা প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক [email protected]
×