ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নীলুফার বেগম

মা দিবস ॥ আমার মা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১০ মে ২০১৫

মা দিবস ॥ আমার মা

আমার মায়ের নাম সুলতানা বেগম। তিনি দেখতে ছিলেন ছোটখাটো, গায়ের রং ছিল শ্যামলা। ত্বক ছিল পেলব ও মসৃণ। নাকের গড়ন ছিল খাড়া। চোখ ছিল টানা টানা। স্বভাব ছিল কোমল, ধীরস্থির ও শান্ত প্রকৃতির। চলনে-বলনে ছিলেন মার্জিত ও স্বল্পভাষী। সহজ কথায়, তিনি ছিলেন শ্যামলা সুন্দর ও সংবেদনশীল মনের মানুষ আর সবকিছুতেই ছিল তাঁর পরিমিতিবোধ। মায়ের জন্ম চাঁদপুরের পূর্ব শ্রীরামদির (বর্তমানে চাঁদপুর পুরান বাজারের মিউনিসিপ্যাল এলাকার অন্তর্গত স্থান) মিয়াবড়ির (তখন মিয়াবাড়ি বলতে জমিদার বাড়ি বোঝাত) ফয়েজ মঞ্জিলে আনুমানিক ১৯০৭ সালে। সে সময় এ দেশে ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলন চলছিল। আমার মায়ের বাবার নাম মুহাম্মদ ফয়েজ পাটোয়ারী (পরবর্তীতে চৌধুরী পদবীতে ভূষিত হন) আর মায়ের নাম জোবেদা বেগম। মায়ের দাদার নাম মুহাম্মদ হাশেম পাটোয়ারী, দাদীর নাম আকরামুন্নেসা। নানার নাম মোহাম্মদ আমজাদ পাটোয়ারী আর নানীর নাম আজিজুন্নেসা। মায়ের দাদা ও নানা ছিলেন শিক্ষিত ও একই পরিবারের লোক অর্থাৎ আপন ভাই। তাঁরা দুই ভাই বিশেষ করে আমজাদ পাটোয়ারী অনেক সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন সারা জীবন। পূর্ব শ্রীরামদি চৌধুরী বাড়ি হতে লোহার পুল পর্যন্ত পৌরসভার দীর্ঘ পাকা রাস্তাটি আমজাদ আলী রোড নামে তাঁর স্মৃতি বহন করছে। আর দাদী-নানী ছিলেন সহোদর বোন। তাঁরা দু’জনেই আরবি, ফার্সী ও বাংলায় লেখাপড়া জানতেন। এমনকি বন্দুক চালাতেও জানতেন। স্বামী হাশেম পাটোয়ারীর অকাল মৃত্যুর পর ভেঙ্গে না পড়ে তিনি কয়েক মাসের শিশুপুত্রকে বুকে নিয়ে যতেœর সাথে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলেন। মায়ের কিশোরী বয়সে (১৯২০ সালের দিকে) দেশে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন চলছিল। মায়ের বাবা ও মামারা ঐ সব আন্দোলনের সঙ্গে কখনো প্রত্যক্ষ বা কখনো পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ঐ সব আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল এদেশ থেকে ইংরেজদের উৎখাত করা। দেশের ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় সকলের মধ্যে ঐক্যবোধ ছিল ঐ একটি বিষয়ে (ঐ ঐক্যবোধের বিষয়টি পরবর্তীতে মায়ের বিবাহিত জীবনে শ্বশুরবাড়ির লোকদের সাথে একাত্মতাবোধ গড়ে ওঠার ব্যাপারে প্রভাব ফেলে)। মায়ের বাবা ও মামারা একই গোষ্ঠীর লোক ছিলেন। তাঁদের দুই বাড়ির মাঝখানে ব্যবধান হিসেবে সুপারি বাগান ও একটা মস্তবড় দীঘি ছিল। এই জন্য তাঁদের বৃহৎ এক পরিবারের লোক বললেও চলে। তাঁরা বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। চাঁদপুরের লবণ, চাল ও পাটের ব্যবসা তাঁদের একচেটিয়া ছিল। চাঁদপুর ও আখাউড়ার প্রায় সবরকমের গুদামগুলো ছিল তাঁদের। তাছাড়া চাঁদপুর থেকে লাকসামের রেললাইন বসাবার কন্ট্রাক্টও ছিল তাঁদের হাতে। ঘোড়াচালিত ফিটন বা জুড়ি গাড়ি করে তাঁরা চলাফেরা করতেন। আমার মা ছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের বড় সন্তান। তাঁর আরও দুই ভাই ও দুই বোন ছিল। মায়ের পরের ভাই কলকাতার হেয়ার স্কুলে পড়তেন। ছোট ভাইটি গণি স্কুলে পড়তেন। আমার মা ও তাঁর বোনেরা পড়তেন বহির্বাটিতে প্রতিষ্ঠিত গার্লস স্কুলে। মায়ের হাতের লেখা ছিল গোটা গোটা সুন্দর। আঠারো বছর বয়সে ১৯২৬ সালে আমার মা সুলতানা বেগমের বিয়ে হয় আমার বাবা আশেক আলী খানের সাথে। আমার বাবার ছিল এটা দ্বিতীয় বিয়ে। বাবার প্রথম স্ত্রী ছোট্ট একটি কন্যা সন্তান রেখে মারা যান। আমার বাবা ছিলেন সুদর্শন, সুপুরুষ ও সুশিক্ষিত। তৎকালীন (১৯১৮) চাঁদপুর মহকুমার প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েট (চরিতাভিধান বাংলা একাডেমী পৃ: ৭৬)। বাবা বিটিতেও ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছেন। আমার মায়ের মামার প্রতিষ্ঠিত গণি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। মায়ের দাদী গণি স্কুলের নবীন শিক্ষকের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে ও বাগ্মী প্রজ্ঞায় গুণমুগ্ধ ছিলেন। তাঁকে চিনতেন। সুদর্শন ও সুশিক্ষিত বলে কদরও করতেন। তাঁর মনের সুপ্ত ইচ্ছা ছিল, নাতনিকে ঐ যুবকের সাথে বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই হিসেবে রাখবেন ও ‘সুন্দপদিয়ার’ তালুক দেবেন নাতজামাইকে উপঢৌকন হিসেবে। সবকিছু দেখে ও বিবেচনা করে এক কন্যা সন্তানের পিতার কাছে নাতনিকে বিয়েও দিলেন নির্দ্বিধায়। আমার বাবা ছিলেন ভীষণ রকমের স্বাধীনচেতা লোক। বিয়ের পর দাদীর সুপ্ত প্রস্তাব প্রকাশিত হলে পরে তিনি ঐ তালুক নিতে রাজি হলেন না। ঘরজামাই হিসেবে জমিদার পরিবারে থাকতেও চাইলেন না। আমার মাও তা মেনে নিলেন। এরপর স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকরি নিয়ে চাঁদপুর থেকে চলে গেলেন। পরবর্তীতে আমার বাবা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলা স্কুলের/সরকারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। বাবা ছিলেন সচ্ছল গৃহস্থ বা কৃষক পরিবারের ছেলে। সংগ্রাম করে পড়াশোনা করেছেন। অন্যদিকে মা জমিদার পরিবারের কন্যা। মার জীবনে ছিল চাকচিক্য। তবুও তিনি আমার বাবার বাড়ির লোকজন, আত্মীয়স্বজনদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের দর্শন, ধনী-দরিদ্রের ঐক্যবোধ ও খ্রীস্টান মিশনারিদের সেবাধর্মী প্রভাব এই ক্ষেত্রে অনেকটা কাজ করেছে। মা সুলতানা বেগমের গর্ভে একে একে আমরা সাত ভাই-বোন জন্ম নিলাম। প্রথম মায়ের গর্ভের বোনসহ আমরা চার বোন ও চার ভাই। বড় আপা ছিলেন আমাদের সবার মধ্যমণি ও সকলের মাথা। আমরা মায়ের পরে তাঁকেই জানতাম। বড় আপা এই মায়ের গর্ভের সন্তান নন এ কথা কখনও অনুভব করিনি মায়ের হৃদয়ের উদারতা ও বড় আপার আপন বোধের জন্য। আমরা ছোট সাত ভাই-বোন মাতুল্য বড় বোনের স্নেহ ও নেতৃত্ব নির্দ্বিধায় ও অকপটে মেনে নিয়েছিলাম। বাবা স্কুল শিক্ষক। সীমিত আয়। আমাদের জীবনযাপন ছিল সহজ-সরল। নানা/মামা বাড়ির বিলাসিতা আমাদের তেমন স্পর্শ করেনি। সীমিত আয় থেকে বাবা তাঁর ভাইপোদেরও পড়াতেন। মাও গরীব দুঃখীদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। বাবা ১৯৪৬ সালে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে সরকারী চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সেই সময়ে বাবার চাকরিস্থল থেকে মা একেবারে গ্রামের বাড়িতে চলে এলেন। বাবার অবসর গ্রহণের আগে বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। বাকি সাতজন সবাই লেখাপড়ায় রত। ভীষণ আর্থিক টানাপোড়েন চলছিল। মা ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ যোগাবার জন্য উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাপের বাড়ির এক টুকরো সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। মা আমাদের গ্রামের বাড়ি গুলবাহারে গাভী পালতেন। নিজ হাতে দুধ দোহাতেন। হাঁস-মুরগি পালতেন। গাছ-গছালি লাগাতেন। খেজুরের গুড় বানাতেন। মুড়ি ভাজতেন। সময়ের হাত ধরে মার জীবন এগিয়ে চলে। একে একে বোনদের বিয়ে হয়। উচ্চশিক্ষিত বড় ছেলে চাকরিতে রত। মেজ ছেলে পড়া শেষে চাকরিতে যোগ দিতে যাচ্ছে। ছোট ছেলে দুটির পড়াশোনা চলছে। এই সময়ে সংগ্রামী মায়ের শরীর ভাল যাচ্ছিল না। ছোটবেলার হাঁপানি রোগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সংসারের আর্থিক টানাপোড়েন তখনও পুরো কাটেনি। তিনি শয্যাশায়ী হলেন না। তবে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলেন। এইভাবে সংসারের কাজকর্মের মাঝেই ১৯৬১ সালের ২১ মার্চ তিনি ৫৪ বৎসর বয়সে কথাবার্তা বলতে বলতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আমার সেজ বোন তখন উপস্থিত ছিলেন। তাঁর অকালমৃত্যুতে স্বামী, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন ও উপকৃত দীন-দুঃখী সবাই খুবই মর্মাহত হয়। বাড়ির সামনে মায়ের বাঁধানো কবর। আমরা ভাই-বোনেরা যে যখন বাড়ি যাই তাঁর কবর জিয়ারত করি। মাকে খুঁজি। তাঁকে পেতে চাই অসীমের মাঝে। লেখক : সাবেক যুগ্ম সচিব
×