ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শ্বশুরবাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার পর বার্নৎ ইউনিটে ৬ দিনের মৃত্যুযন্ত্রণা

পাপিয়াকে প্রাণ দিতে হলো শুধুই গায়ের রং কালো বলে

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৯ মে ২০১৫

পাপিয়াকে প্রাণ দিতে হলো শুধুই গায়ের রং কালো বলে

আজাদ সুলায়মান ॥ কালো হবার অপরাধে প্রাণ দিতে হলো অন্তঃসত্ত্বা পাপিয়াকে। শাশুড়ি-দেবর যখন তাকে পুড়িয়ে মারে তখনও পাপিয়া জানতে চেয়েছিল, কি তার অপরাধ? তিনি যে কালো সেটা তো আর নতুন করে জানা নয়। বিয়ের বছরদেড়েক পর তাদের মনেইবা কেন গায়ের রঙটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল? স্বামীই বা কি করে ওদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই অভিযোগে অভিযুক্ত করে? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর না জেনেই পাপিয়াকে পাড়ি দিতে হয়েছে চিরতরে। ছয়দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যাওয়ার পর যখন শুক্রবার পাপিয়ার লাশ ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট থেকে বের করা হয়, পাশের বেডের দর্শনার্থীদের মুখেও ছিল বিস্ময়ভরা অনুযোগ। ওরা কেমন মানুষ? গায়ের রং কালো হওয়াটা কি অপরাধ? আল্লাহ যারে যেভাবে ভাল মনে করেন সেভাবেই দুনিয়াতে পাঠান; তাতে মানুষের কি? পাশের বেডের রাহেলা আরও অবাক হন যখন তিনি শুনতে পান পাপিয়ার বিয়েটাও প্রণয়ের। তা হলে তো কালোই ভাল লেগেছিল স্বামীর। তারপর কেন এত বিতৃষ্ণা জাগে? বার্ন ইউনিটেও জানাজানি হয়েছে, শরীরের বর্ণচ্ছটা যে কালো সেটা তো প্রেমিক স্বামী বেশ ভাল করেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছে। কারণ, বিয়েটা তো আর দশটা সেটেল্ড ম্যারেজের মতো ছিল না। দীর্ঘকাল ছিল তাদের জানাশোনা। ছিল ঘনিষ্ঠতা। ভালবাসার বর্ণিল স্বপ্নে বিভোর হয়েই পাপিয়াকে ঘরে এনেছিল প্রেমিক স্বামী আশিকুল হক। শুক্রবার যখন এ প্রতিবেদন তৈরি করি তখন পাপিয়ার মরদেহ ছিল একটি এ্যাম্বুলেন্সে, কিশোরগঞ্জের এক অজপাড়াগাঁয়ের পথে। সেখানে চলছিল তার লাশ গ্রহণের প্রস্তুতি। তাকে পুড়িয়ে মারার কাহিনী ততক্ষণে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসনেও বেশ নাড়া পড়ে। কারণ, পাপিয়াকে স্বামীর বাড়িতে যখন গত শনিবার আগুনে পোড়ানো হয় তাকে প্রাথমিকভাবে জেলা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। তারপর অবস্থার অবনতি ঘটলে নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিক্যালে। এখানে ছয়দিন ধরে চলে তার চিকিৎসা। কিন্তু দুর্ভাগ্য। তাকে এত বেশি পোড়ানো হয়েছে যে পরিণতি যা ঘটার তাই হয়েছে। অকালমৃত্যুর করুণ কাহিনী রেখেই পাপিয়া চলে যান না-ফেরার পথে। পাপিয়ার হত্যাকা- স্বামী ও বাপেরবাড়ি এলাকায় চরম ক্ষোভের সঞ্চার করে। সেখানকার বিবেকবান মানুষের মনে নাড়া দেয় এ কাহিনী। পাপিয়া কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার বাটিঘাগড়া গ্রামের মোঃ নজির মিয়ার মেয়ে। এলাকাবাসীর প্রশ্ন, কতই বা বয়স তার? বড় জোর আঠারো থেকে উনিশ। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের সাধককালী গ্রামের এক অতিদরিদ্র ঘরের তরুণী। বছরকয়েক আগে তার এক দূরাত্মীয় যুবক আশিকুল হক তাকে দেখে। তারপর যাওয়া-আসার সুবাদে একে অপরকে ভাললাগার অনুভূতি প্রকাশ। গরিব ঘরের মেয়ে বিয়ে যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল বাবা-মায়ের। আশিকুলের প্রস্তাবে রাজি না হয়েও তো উপায় ছিল না। বিয়ের পর স্বামীর ঘরে কিছুদিন ছিল ভালমন্দে। তারপর শুরু শনির দশা। শাশুড়ির ঘ্যান ঘ্যানানি। একে তো বৌ কালো। এমন কালো মেয়ের ঘরে যে জন্মাবে সেও তো কালোই হবে। এমনসব অভিযোগে স্বামীর মনও বিষিয়ে তোলা হয়। স্বামী সময়ের ব্যবধানে ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে। এক পর্যায়ে মেয়ে কালো হওয়ার অপবাদ দিয়ে চাওয়া হয় যৌতুক। স্বামীর পক্ষে মুখ খুলে সেটা না চাওয়া হলেও তার বাবা-মা বেশি চাপের মুখে রাখে পাপিয়াকে। সেটা তো কিছুৃতেই সম্ভব নয়। যৌতুকের উপায় কি? সঙ্গতি না থাকায় যৌতুক দেয়া সম্ভব হয়নি। আর কালো হওয়াটা তার দ্বিতীয় অপরাধ। এ জন্যই হিংস্র হয় তার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির লোকজন। চলে তার ওপর শারীরিক অত্যাচার-নির্যাতন। বিশেষ করে মেয়ে কালো হওয়ায় শ্বশুরবাড়ির কেউ তাকে বউ হিসেবে মেনে নিতে চায়নি। স্বজনদের অভিযোগ, বিয়ের পর গর্ভে থাকা অবস্থায় প্রথম সন্তানকে জোর করে স্বামী মেরে ফেলে। পরে আবারও গর্ভে একটি সন্তান আসে। এই সন্তানটিও মেরে ফেলতে চাপ দেয়। তখন এর কারণ জানতে চাইলে স্বামী বলে, তোর গায়ের রং কালো। তোর গর্ভে যে ছেলেমেয়ে হবে তাও কলো হবে। তুই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যা। কিন্তু এতে অস্বীকার করলে শরীরে কোরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ বিষয়ে করিমগঞ্জ থানার ওসি বজলুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান,ঘটনার দিন পাপিয়া বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়িতে আসে। তখনই শাশুড়ি- দেবরের সঙ্গে বাধে ঝগড়া। এক পর্যায়ে তারা ওর শরীরে কেরোসিন দিয়ে আগুন দেয়। তারপর তাকে আনা হয় কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে। এখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যালে। তিনি জানান,ঘটনার সময় স্বামী পাশে ছিল কি ছিল সেটার কোন প্রত্যক্ষদর্শী মিলেনি। তবে সদর হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় পাপিয়া নিজ মুখে অভিযোগ করেন, তাকে শাশুড়ি-দেবর মিলে আগুন দেয়। তাদের যেন বিচার হয়। ঢাকা মেডিক্যালে আনার পর পাপিয়ার বাবা নজির মিয়া জানান, শনিবার সকালে স্বামী আশিকুল হক, শ্বশুর আনোয়ারুল হক খোকন, শাশুড়ি পারুল বেগম, দেবর মাসিকুল হক ও ফুফুশাশুড়ি হাওয়া বেগম কেরোসিন ঢেলে তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ হয়। তাকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আনা হয়। এখানেই চিকিৎসাধীন বৃহস্পতিবার মারা যান। ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শঙ্কর পাল বলেন, কিশোরগঞ্জের গৃহবধূ পাপিয়া আক্তারকে গত শনিবার বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তার শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় তিনি আশঙ্কাজনক অবস্থায় ছিলেন। এ ঘটনার পরের দিন পাপিয়ার বড়ভাই সিরাজুল ইসলাম ৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলায় স্বামী আশিকুল হক, শাশুড়ি পারুল আক্তার, দেবর মাসিকুল হক, শ্বশুর আনোয়ারুল হক ও ফুফুশাশুড়ি হাওয়া বেগমকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ঘটনার পর পালানোর চেষ্টাকালে প্রতিবেশীরা দেবর মাসিকুলকে আটক করে থানায় সোপর্দ করেন। পরে তাকে আসামি হিসেবে দেখানো হয়। বাকিরা পলাতক । করিমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বজলুর রহমান বলেন, ঘটনার পর পরই পাপিয়ার স্বামীরবাড়িতে পুলিশ নিয়ে গেছি। সেখান থেকে ধাওয়া করে এক অভিযুক্ত দেবরকে আটক করা হয়। তাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। বাকিরা পলাতক। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
×