ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নভেরা নেভার নয়

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৯ মে ২০১৫

নভেরা নেভার নয়

প্রায় সাড়ে চার দশক ছিলেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে। শিল্পচর্চা ত্যাগ না করলেও দেশবাসী তাঁর নতুন শিল্পের স্বাদ পায়নি; এক ধরনের অন্তরালবাসিনীই হয়ে ছিলেন তিনি। এমনকি আমরা যেন ভুলতেই বসেছিলাম তিনি জীবিত আছেন! অথচ বুধবার তাঁর মৃত্যু সংবাদ দেশে পৌঁছানোর পর এ কয়দিন বয়স্কদের ভেতর তাঁর জন্য মমতা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ এবং নবীনদের তীব্র কৌতূহল থেকে যে সত্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হলো ভাস্কর নভেরা এই বাংলার শিল্প ভুবনেরই যেন এক প্রাণভোমরা। শিল্পীদের পীঠস্থান বলে পরিচিত প্যারিসে জীবন কাটিয়ে দিলেও তাঁকে বাঙালী ঠিকই স্মরণে রেখেছে এবং জীবদ্দশায় যা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, প্রাপ্য সেই সম্মান তিনি পাবেন। বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যের পথিকৃৎ হিসেবে ইতিহাসে অবশ্য তাঁর স্থান আগে থেকেই নির্ধারিত। জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে উঠতে পারেন কয়জন? তাঁকে নিয়ে জীবনী উপন্যাস রচিত হয়েছে, নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র। শিল্পী জীবনের উন্মেষপর্বে, ১৯৬১ সালে, ভাস্কর হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি; পরে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। নভেরার প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৬০ সালে, কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে। ‘ইনার গেজ’ শিরোনামের ওই প্রদর্শনীটি কেবল নভেরারই নয়, তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানেই ছিল কোন ভাস্করের প্রথম একক প্রদর্শনী। শিল্পস্রষ্টা হিসেবে নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের থেকে অগ্রবর্তী। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের বাংলাদেশে একজন নারীর শিল্পী হয়ে ওঠা ছিল কঠিন ও বিরুদ্ধ এক যাত্রা। সে সময়টায় নভেরা বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় এনে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিকমান। একে বিপ্লব বলাই সঙ্গত হবে। ভাস্কর্যশিল্পে তাঁর শিক্ষাটা ছিল আন্তর্জাতিক। আধুনিক শিল্পকলার তীর্থস্থান লন্ডন, ফ্লোরেন্স ও ভেনিসে ভাস্কর্য বিষয়ে শিক্ষা নেন নভেরা। শুধু বাংলাদেশেই প্রথম ভাস্কর্য প্রদর্শনীটি হয়েছিল তাঁর সৃজিত ভাস্কর্য দিয়ে এমন নয়, ১৯৭০ সালের অক্টোবরে নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যের প্রদর্শনীটি ছিল ব্যাঙ্ককে ধাতব ভাস্কর্যের প্রথম মুক্তাঙ্গন প্রদর্শনী। তাঁর তৃতীয় একক প্রদর্শনী হয় প্যারিসে, ১৯৭৩ সালে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে প্যারিসে তাঁর পূর্বাপর কাজের এক শ’ দিনব্যাপী একটি প্রদর্শনী হয়। মাঝে প্রায় চার দশক তাঁর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হয়নি। এ থেকে বোঝা যায় নিঃসঙ্গ নির্জন বাস তাঁর জন্য ছিল শিল্পখরার কাল। স্বদেশ ও স্বজাতির সঙ্গে সম্পর্ক ও সংযোগ ছাড়া কেবল অভিমান ভরা একাকিত্ব শিল্প সৃষ্টির জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। একইভাবে উপেক্ষায় অনাদরে শিল্পীকে দূরে ঠেলে দিলে তাও সুখকর হয় না। নভেরার জীবন বাস্তবতা থেকে তাই স্বাধীনচেতা শিল্পীদের নিশ্চয়ই কিছু শেখার আছে। ভাষা শহীদদের স্মরণে গড়া শহীদ মিনারের অন্যতম রূপকার হয়েও নভেরা আহমেদ স্বাধীনতা-পূর্বকালে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। আপন কীর্তির এই অস্বীকৃতি তাঁকে করে তুলেছিল তীব্র অভিমানী। যদিও সেই শহীদ মিনার এখন বাঙালীর চিরন্তন শিল্পরূপ হয়ে বিরাজমান ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে। তাই নভেরা নেভার নয়। আমাদের দৃষ্টির সামনেই রয়েছে তাঁর কালজয়ী কিছু সৃষ্টি। জাতীয় জাদুঘর শিল্পশালায় এবং সামনের প্রাঙ্গণে রয়েছে নভেরার ভাস্কর্য, ঢাবি পাঠাগার ও শাহবাগ গণগ্রন্থাগার মিলনায়তনের মধ্যকার দেয়ালে আছে তাঁর করা কিছু ফ্রেস্কো-ম্যুরাল। এখন দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নভেরার শিল্পকর্ম যথাযথ সংরক্ষণের কাজটি শুরু করতে হবে। প্রয়োজনে প্যারিস ও ব্যাঙ্কক থেকে তাঁর প্রতিনিধিত্বশীল শিল্পকর্ম দেশে নিয়ে এসে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়ার কথাও ভাবতে হবে। এছাড়া তাঁর নামে ভাস্কর্য শিল্পীদের জন্য একটি বার্ষিক পুরস্কারের প্রবর্তন করেও এই অসাধারণ ভাস্করের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানো যায়।
×