উত্তম চক্রবর্তী/ বাবু ইসলাম, শাহজাদপুর থেকে ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সংঘর্ষের বদলে শান্তি, বিভাজনের বদলে ঐক্য এবং ধ্বংসের বিরুদ্ধে চিরদিন সৃষ্টির গান গেয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালে তিনি ইংরেজ প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আমাদের দেশের কিছু মানুষের মধ্যে সেই চেতনা ও মানবতাবোধ আসে না কেন? যখন পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ মারা হয়, তখনও তাদের বিবেক জাগ্রত হয় না কেন? অনেকে কেন মানুষকে পুড়িয়ে হত্যাকারীদের পদলেহন করে, তাদের দল করে এবং ভোট দেয়- তা বোধগম্য নয়। আর বাংলাদেশ উল্টো পথে চলুক তা আমরা চাই না। দেশের আর্থ-সামাজিক মুক্তি অর্জনই আমাদের লক্ষ্য। শুক্রবার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বড়াল ও গোহলা নদী পরিবেষ্টিত মনোমুগ্ধকর ও স্মৃতিবিজড়িত বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল হিমাংশু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়ির সন্নিকটে কবিগুরুর ১৫৪তম জন্মজয়ন্তীতে শাহজাদপুর পাইলট হাইস্কুল মাঠে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গবেষণা ও স্মৃতিকে ধরে রাখার লক্ষ্যে শান্তিনিকেতনের আদলে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত এ স্থানেই স্থাপিত হতে যাচ্ছে দেশের ৩৫তম সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্প-সাহিত্যে বিশেষায়িত উচ্চ শিক্ষাঙ্গন হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পাবে। পাশাপাশি এখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য, সংস্কৃতি, নাট্যকলাসহ বিভিন্ন বিষয়েও পড়াশুনার সুযোগ পাবেন শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শাহজাদপুরের ন্যায় কবিগুরুর সকল স্মৃতিবিজড়িত স্থান সংরক্ষণ এবং কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আরেকটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবকল্যাণ, শান্তি, সাম্যের চেতনাবোধ সৃষ্টির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫ পরবর্তী সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ও তাদের পদলেহনকারীদের এখনও আমরা দেখি। তিন মাস ধরে খালেদা জিয়া ও বিএনপি-জামায়াত মিলে আন্দোলনের নামে মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। অন্তঃসত্ত্বা মা, ছোট শিশুকে পুড়িয়ে মেরেছে। এরপরও কিছু মানুষ হত্যাকারী দলের সঙ্গে কিভাবে থাকে, তা বুঝি না। আসলে এরা নিজেদের লাভের অংশ দেখে তাদের (বিএনপি-জামায়াত) সঙ্গে থাকে, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করলেও তাদের বিবেক জাগ্রত হয় না। তারা শুধু চোখ ধাঁধানো জৌলুসই শুধু দেখে, মানুষের কষ্ট-বেদনা তারা দেখে না।
শাহজাদপুরে জাতীয় পর্যায়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য শাহজাদপুরে এ সরকারী আয়োজন করা হলেও তীব্র মানুষের স্র্রোতে তা শেষ পর্যন্ত বিশাল জনসভায় রূপ নেয়। পুরো প্যান্ডেল ছাপিয়ে শাহজাদপুর পাইলট হাইস্কুলের বিশাল মাঠ পেরিয়ে চতুর্দিকের রাস্তা লোকেলোকারণ্য হয়ে পড়ে। আর প্রধানমন্ত্রীর আগমন এবং শাহজাদপুরে জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনে উপলক্ষে শাহজাদপুরবাসী ছাড়াও সিরাজগঞ্জ জেলার মানুষের মধ্যে পরিণত হয়েছিল উৎসবমুখর পরিবেশ।
বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে সিরাজগঞ্জ রোড হয়ে উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর এবং পাবনার কাশিনাথপুর থেকে বাঘাবাড়ি হয়ে শাহজাদপুর পর্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ডিজিটাল তোরণ, ব্যানার- ফেস্টুনে বর্ণিলভাবে সাজানো হয়েছিল। সকাল দশটায় মূল অনুষ্ঠান শুরুর কথা থাকলেও আটটার মধ্যেই চারদিক থেকে মানুষের ঢলে পুরো এলাকা ভরে ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে পুরো এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছিল নিñিদ্র নিরাপত্তা বলয়। দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এই প্রথম শাহজাদপুরে প্রধানমন্ত্রীর আগমনে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাস-উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষকে দীর্ঘপথে টানানো মাইকের সামনে দাঁড়িয়েই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে শুনে বাড়ি ফিরে যেতে হয়।
সকাল নয়টায় ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারযোগে শাহজাদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হন প্রধানমন্ত্রী। দশটায় বাঘাবাড়ি হেলিপ্যাডে নেমে সরাসরি অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান তিনি। এরপর শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আয়েজিত জাতীয় পর্যায়ের এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আকতারী মমতাজ। স্মারক বক্তব্য রাখেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও স্থানীয় সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক বিল্লাল হোসেন।
প্রধানমন্ত্রী রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ছাড়াও সিরাজগঞ্জে নির্মিত আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, সিরাজগঞ্জ বিদ্যুত কেন্দ্রের সম্প্রসারিত কার্যক্রম, ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি, জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় এবং যমুনার পাড়ে শেখ রাসেল শিশু পার্ক উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানস্থলে স্থানীয় নেতাদের দাবিতে প্রধামন্ত্রী করতোয়া নদীর ওপরে নরিনা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে তাঁতিসহ স্থানীয় সব পেশার মানুষের উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণেরও ঘোষণা দেন। ভিস্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠান শেষে দর্শক সারিতে বসে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। কবিগুরুর শাহজাদপুরের কাছারি বাড়িতে বসে লেখা দুটি ছিন্নপত্র পাঠ করে শোনান দেশের খ্যাতনামা নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. দীপু মনি, রাজশাহীর সাবেক মেয়র এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, এ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর, অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত এমপি, আবদুল মজিদ ম-ল এমপি, তানভীর ইমাম এমপি, হাবিবুর রহমান এমপি, তানভীর শাকিল জয়, মুশফিকুর রহমান মোহনসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্বকবির নানা সৃষ্টির ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কবিগুরু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে মর্যাদা দিয়ে বিশ্বসভায় নিয়ে গেছেন, আর আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। মানবমুক্তির পথে রবীন্দ্রনাথের আকাক্সক্ষাও পূরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কেননা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন ভারত ব্রিটিশের জগদ্দল পাথর থেকে রক্ষা পাবে। আমাদের ব্রিটিশদের হাত থেকে রক্ষা পেলেও পাকিস্তানের শোষণে পড়তে হয়েছে। জাতির জনক সেই শোষণ থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। স্বাধীনতা দিয়েছেন। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির মর্যাদা আমরা পেয়েছি, যেটা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথেরও আকাক্সক্ষা ছিল। কবিগুরুর সেই আকাক্সক্ষা পূরণ করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ভূখ-ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছিল গভীর আত্মিক সম্পর্ক। তাঁর লেখায় মানবতা ও অসাম্প্রদায়িকতাবোধের পাশাপাশি বিপ্লবী চেতনাও ফুটে উঠেছে। তিনি কখনও অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার মেনে নেননি। কবিগুরু জমিদার হলেও প্রজাবৎসল ছিলেন। তিনি প্রজাদের চুষে খেতেও আসেননি। বরং তার জমিদারির অনেকটাই কৃষক ও প্রজাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। আর রবীন্দ্রনাথই এ অঞ্চলে স্বল্পসুদে ক্ষুদ্র ঋণ প্রবর্তন করেন। নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থের প্রায় সবটাই তিনি সমবায় ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করেন।
কৃষিক্ষেত্রে কবিগুরুর অসামান্য অবদানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রজাদের কল্যাণে ক্ষুদ্র ঋণ, সমবায় ও কৃষিব্যাংক প্রতিষ্ঠাসহ কৃষকদের সামাজিক সহযোগিতা করেছেন। তিনি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন। আধুনিক চাষাবাদের জন্য রবীন্দ্রনাথই প্রথম এ এলাকায় ট্রাক্টর আমদানি করেন। আর কৃষিক্ষেত্রে এসব বিপ্লবের ক্ষেত্র হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন পূর্ব বাংলাকেই। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথ নিজের সাড়ে চার হাজার বিঘা জমি গোচারণ ভূমি হিসেবে কৃষকদের দান করেছিলেন। যার ওপর ভিত্তি করে শাহজাদপুর অঞ্চলে দুগ্ধ খামার গড়ে ওঠে। আজও এখানকার মানুষের জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস দুগ্ধ উৎপাদন। এ অঞ্চলে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলার ঘোষণাও দেন প্রধানমন্ত্রী।
কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব খাতে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সরকারের সাফল্যে ও উন্নয়নের বিবরণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ কাজ করে চলেছে। আমরা চাই বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে করে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে। এদেশের মানুষ শান্তিতে থাক, তারা উন্নত জীবন পাক, তাদের কল্যাণই আমাদের মূল লক্ষ্য। সেভাবেই আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তিনি বলেন, জাতির পিতা এদেশের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। তাঁর স্বপ্ন সফল করে ২০২১ সালের মধ্যে আমরা দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশে পরিণত করতে চাই। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ২০২০ সালকেও আমরা পালন করব একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘সোনার তরী’ কবিতার দুটি চরণ আবৃত্তি করার পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে জঙ্গী দমন করেছেন। কেবল একজন জঙ্গীই দমনই বাকি আছে। যিনি গত তিন মাস ধরে মানুষ হত্যা করেছেন, শিশু হত্যা করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই জঙ্গীকেও দমন করা হবে। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের সদ্য প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ ২৫ বছরে আর মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদ ২২ বছর সরকার পরিচালনা করে তাদের দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও এই সময় দেয়া হলে তিনিও বাংলাদেশকে দ্রুততম সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করবেন।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, শিক্ষাখাতে নতুন প্রজন্মের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বেই নতুন প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে আমরা দেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন করতে চাই।