ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হাবিবুর রহমান স্বপন

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৮ মে ২০১৫

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান সরকার। বিশ্ব যিনি বাংলা এবং বাঙালীকে সম্মানের আসনে বসিয়েছেন তিনি বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয় করায় আমরা জাতি হিসেবে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে যাচ্ছি, এ কথা বলা যায়। কারণ রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে বাংলা ও বাঙালীর আত্মপরিচয় অপরিপূর্ণ থাকে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে ময়মনসিংহের ত্রিশালে বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবার জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথের নামে শাহজাদপুরে বিশ^বিদ্যালয় হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি সুখবর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন ছিল না বা তাঁর কোন শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র ছিল না। শিশুকালে কিছুদিন স্কুলে গিয়েছিলেন, তবে স্কুলের শিক্ষাপদ্ধতি তাঁকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। যিনি কলেজ কিংবা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়েননি, তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বিশ^ভারতী বিশ^বিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন স্বশিক্ষিত। জীবনের বিশ^বিদ্যালয় থেকে যে জ্ঞান বা শিক্ষা তিনি অর্জন করেছিলেন তা আমাদের জন্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ রচিত গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা, চিত্রশিল্প আমাদের বাংলা সাহিত্যের ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর চিঠিও সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। গান, সে তো চিরজাগ্রত। রবীন্দ্রপ্রতিভা মহাকাশের সঙ্গে তুলনীয়। গ্রহ-নক্ষত্রের দ্বারা যেমন মহাকাশ সুসজ্জিত, রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সেই গ্রহ, নক্ষত্রের মতোই চিরভাস্বর হয়ে আছে। বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোন বিষয় খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে রবীন্দ্রনাথ বিচরণ করেননি। রবীন্দ্রসাহিত্যের আবেদন চিরন্তন। আমরা মনে করি, যতদিন বাংলা ভাষা, বাঙালী জাতি থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু নেই, তিনি চিরঞ্জীব। তাঁর কাছে আমরা ঋণে আবদ্ধ; রবীন্দ্রনাথ যেমন ঋণী পূর্ব বঙ্গের নদী, বিল, প্রকৃতি ও জনমানুষের কাছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন। কি করলে শিশুর মনে শিক্ষা বা বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায় সেটিও তিনি ভেবেছেন। অযথা শিক্ষার্থীদের বাড়তি বই পড়া বা তাদের ওপর অতিরিক্ত পড়ার চাপ তিনি পছন্দ করতেন না। শিশু-কিশোরদের চপলতা, লাফ-ঝাঁপ, গাছে চড়া কিংবা দুষ্টুমি তিনি খারাপ চোখে দেখতেন না। ‘ছুটি’ গল্পের মধ্যে শিশুদের পানিতে ঝাঁপ দেয়া, তাদের মারামারি, পানির মধ্যে গাছের গুঁড়ি ফেলা, ফুল চুরি করা ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন। ফটিক চরিত্রটি শাহজাদপুর থেকেই তিনি পেয়েছিলেন। তিনি শিশুদের উপযোগী বই লিখেছেন। সেটি সহজ পাঠ (সচিত্র), পাঠ্যপ্রচয়, ছুটির পড়া, ইংরেজি সোপান, ইংরেজি সহজ শিক্ষা, পাঠ সঞ্চয়, আদর্শ প্রশ্ন ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর উদ্ভাবিত শিক্ষানীতি অনুসরণ করে অনেক শিশুপাঠ্য বই রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা চিন্তার একটি প্রধান এবং উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রদান। তিনি মনে করতেন, শিক্ষা কার্যকর ও জীবন-ঘনিষ্ঠ না হওয়ার কারণ মাতৃভাষা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব প্রদান না করা। তিনি বাংলার সঙ্গে ইংরেজীর সমন্বয় সাধনের কথা বলেছেন। এ দুয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমেই শিক্ষা সফল হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি থেকে শিশুদের শিক্ষা নেয়ার পদ্ধতি পছন্দ করতেন। তিনি মনে করতেন অত্যাবশ্যক শিক্ষার সঙ্গে স্বাধীনপাঠ না মেশালে ছেলে ভাল করে মানুষ হতে পারে নাÑ বয়োপ্রাপ্ত হলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থেকে যায়। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আর একটা ত্রুটি হচ্ছে ছাত্রদের বেশি পড়ানোর প্রবণতা।’ রবীন্দ্রনাথ শিক্ষানীতিতে যথাসম্ভব কম পড়িয়ে বেশি শেখানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘ছাত্রদের বুদ্ধি ও শক্তি বিবেচনা করিয়া শিক্ষকদের কাজ করিতে হইবে।’ পতিসরে রথীন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (১৯৩৭ খ্রি.) রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকদের সম্বন্ধ যেন অকৃত্রিম স্নেহের এবং ধৈর্যের দ্বারা সত্য ও মধুর হয়, এই আমার উপদেশ।’ বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষা-সংস্কার প্রবন্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের শিক্ষা ব্যবস্থায় গোলমেলে অবস্থা এবং রোম আক্রমণে সেখানে শিক্ষার বেহাল দশার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘যখন পুরো ইউরোপে বিদ্যা শিক্ষার বেহাল অবস্থা তখন আইরিশ বৈরাগীগণ বিদ্যা এবং খ্রিস্টধর্মের নির্বাণপ্রায় শিখা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন।’ রবীন্দ্রনাথ উক্ত প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ছেলেদের মধ্যে ছেলেমানুষের যে স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর তাহা স্বদেশের সম্বন্ধে ইংরেজ ভালোই বোঝে। তাহারা জানে, এই চাঞ্চল্যকে দমন না করিয়া যদি নিয়মিত পুষ্ট করা যায়, তবে ইহাই একদিন চরিত্র এবং বুদ্ধির শক্তিরূপে সঞ্চিত হইবে। এই চাঞ্চল্যকে একেবারে দলিত করাই কাপুরুষতা সৃষ্টির প্রধান উপায়। ছেলেদের যাহারা যথার্থ হিতৈষী, তাহারা এই চাঞ্চল্যের মধ্যে প্রকৃতির শুভ উদ্দেশ্য স্বীকার করে, তাহারা ইহাকে উপদ্রব বলিয়া গণ্য করে না। এই জন্য বালোচিত চাপল্যের নানাবিধ উৎপাতকে বিজ্ঞলোকেরা স¯েœহে রক্ষা করেন। ইংল্যান্ডে এই ক্ষমাগুণের চর্চা যথেষ্ট দেখা যায়Ñ এমনকি, আমাদের কাছে তাহা অতিরিক্ত বলিয়া মনে হয়। নিজে চিন্তা করিবে, নিজে সন্ধান করিবে, নিজে কাজ করিবে, এমনতরো মানুষ তৈরি করিবার প্রণালী এক, আর পরের হুকুম মানিয়া চলিবে, পরের মতের প্রতিবাদ করিবে না, ও পরের কাজে জোগানদার হইয়া থাকিবে মাত্র, এমন মানুষ তৈরির বিধান অন্যরূপ।’ রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষের জন্য দুটি অত্যাবশ্যকীয় শক্তি হচ্ছে চিন্তাশক্তি ও কল্পনা-শক্তি। বাল্যকাল থেকে চিন্তা ও কল্পনার চর্চা না করলে তার উন্মেষ ঘটে না। উপরোল্লিখিত প্রবন্ধটি পর্যালোচনা করলেই পরিষ্কার হয় রবীন্দ্রনাথ শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কতটা ভাবনা-চিন্তা করেছেন। তিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে শিশুদের শিক্ষার বিষয়টি ভেবেছেন। স্কুলের শিক্ষা রবীন্দ্রনাথকে টানেনি। তাই স্কুলের প্রতি তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল না। তিনি মনে করতেন সব বই পড়ার মতো নয় বা পড়ার উপযোগী নয়। ভাল বই মানুষকে প্রকৃত মানুষে রূপান্তর করতে পারে। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার স্ফুরণ হয়েছিল পূর্ববাংলায় এসে। চেকোস্লাভিয়ার প-িত ডক্টর জাবিতেলের ভাষায় ‘রবীন্দ্রনাথ মানুষ ও কবি হিসেবে যা হয়ে উঠেছিলেন তা হতে পারতেন না যদি পূর্ববাংলার গ্রামদেশে না আসতেন।’ বাংলাদেশের শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসরে তিনি জমিদারি দেখতেন। তৎকালীন ইউসুফশাহী পরগণাভুক্ত শাহজাদপুরের জমিদারি ছিল নাটোরের রানী ভবানীর। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে তা ক্রয় করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯০-এর ১৩ জানুয়ারি থেকে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাহজাদপুরের জমিদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর রবীন্দ্রনাথের কাকার পুত্রগণ শাহজাদপুরের অংশ বা জমিদারি পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুর উচ্চবিদ্যালয় পরিদর্শন করেন ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি। বিদ্যালয়টিতে ঠাকুর জমিদারদের আর্থিক সাহয্যে ছিল। এছাড়াও তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথের নামে পতিসর, কামতা ও রাতোয়ালে তিনটি ইংরেজী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। কালিগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন পাঠশালা। শিলাইদহে অবস্থানকালে তিনি প্রজাদের জন্য, বয়স্কদের জন্য শিক্ষক রেখে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রতি মাসে শাহজাদপুর থেকে ১৫ সের ঘি যেত। আর এই ঘি সরবরাহ করতেন রাউতারা গ্রামের গিরীশচন্দ্র ঘোষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিরীশচন্দ্র ঘোষের আবেদনের প্রেক্ষিতে পাঁচ শ’ টাকার বিনিময়ে সোনাই নদীর চরে তাকে এক শ’ বিরানব্বই বিঘা জমি গো-চারণের জন্য খারিজ দাখিল দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাক্ষরিত অর্ডার বুকে ১৩০২ বঙ্গাব্দের ২৯ চৈত্র সেটির প্রমাণ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুমাত্র গো-চারণের জন্য জমিই দেননিÑ তিনি উন্নত শাহিওয়াল জাতের ষাঁড় এনে গাভী প্রজননের মাধ্যমে উন্নত গো-সম্পদ সৃষ্টির ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই গরুর জাত এখন ‘পাবনা ব্রিড’ নামে পরিচিত। বুড়ি পোতাজিয়া ও রামকান্তপুর নামের মৌজায় এখনও রবীন্দ্রনাথের জমিদারির জমি খাস হিসেবে চিহ্নিত। এটি অত্র এলাকায় বাথানভূমি হিসেবে পরিচিত। এর আয়তন ১২শ’ একর। উক্ত জমি এখন মিল্কভিটার চারণভূমি। বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা ফ্যাক্টরি থেকে পশ্চিম বরাবর এই জমির অবস্থান। বড়াল, গোহালা এবং সোনাই নদীর পলি বিধৌত এলাকা। উক্ত জমিতেই হতে যাচ্ছে রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর ভিত্তিপ্রস্তর বা শিলান্যাস করবেন। শাহজাদপুর থেকে পতিসর এবং শিলাইদহের দূরত্ব প্রায় সমান। চলনবিলের পতিসরে কৃষি অনুষদ এবং কুষ্টিয়ার শিলাইদহে অপর একটি অনুষদ অথবা গবেষণা ইউনিট করার পরিকল্পনা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। বিশ^ভারতীর আদলে শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন করা হলে এটি হবে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত এক বিশ^বিদ্যালয়। বাংলার প্রকৃত রূপ এখানে সৃষ্টিকর্তা ঢেলে রেখেছেন। তিন নদীর সঙ্গমস্থল বা মোহনায় রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয়টি হয়ে উঠবে বাঙালীর মিলন কেন্দ্র। লেখক : সাংবাদিক
×